ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ব্রিটেনে চার বঙ্গনারীর বিজয়

প্রকাশিত: ০৯:১২, ৬ জানুয়ারি ২০২০

 ব্রিটেনে চার বঙ্গনারীর বিজয়

সদ্যসমাপ্ত ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন চারজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত নারী। এই জয়ে বাংলাদেশের সবাই অত্যন্ত আনন্দিত এবং গর্বিত। এই চারজন নারী আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন ভিন দেশে প্রতিযোগিতায় নিজ যোগ্যতায় আমরাও জয়ী হতে পারি। ২০১০-এর নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন রুশনারা। ২০১৫ এর নির্বাচনে আরও দুজন উৎসাহী হয়ে প্রার্থী হয়েছেন এবং নির্বাচিত হয়েছেন। তরুণ রাজনীতিবিদ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ। মাত্র ১৬ বছর বয়সে লেবার পার্টির সদস্য হওয়া টিউলিপ এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গ্রেটার লন্ডন অথরিটি এবং সেইভ দ্য চিলড্রেনের সঙ্গেও কাজ করেছেন। ২০১০ সালে ক্যামডেন কাউন্সিলে প্রথম বাঙালী নারী কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ২০১৯ সালে আরেকজন নির্বাচিত হলেন। ভবিষ্যতে ব্রিটেনসহ অন্য দেশের রাজনীতিতে বাঙালীর অংশগ্রহণে এই চারজন প্রেরণা হয়ে থাকবেন। ২০১৯ অনুষ্ঠিত যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে নিজ দল লেবার পার্টির ভরাডুবি হলেও নতুন একজনসহ চার বঙ্গকন্যা ছিনিয়ে এনেছেন জয়ের মালা। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত বর্তমান এমপি রোশনারা আলী, টিউলিপ সিদ্দিক ও রূপা হকের সঙ্গে এবার নতুন আরেকজন আফসানা বেগমও এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচনে বড় ব্যবধানে বরিস জনসনের দল কনজারভেটিভ পার্টি জয় পেলেও আটকাতে পারেনি এই চার বঙ্গকন্যাকে। নির্বাচনে প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের কনজারভেটিভ পার্টি এবং জেরেমি করবিনের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি। নির্বাচনে দুই দলের হয়ে যারা লড়েছেন, তাদের মধ্যে অন্তত ১০ জন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টির বড় জয় এবং লেবার পার্টির ব্যর্থতার কারণে ভবিষ্যত নির্বাচনে তিনি লড়বেন না বলেও জানিয়েছেন। সম্পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েই বিজয়ী হয়েছেন ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি। ৩৬১ আসনে বিজয়ী প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের দল। অন্যদিকে লেবার ২০৩ আসনে জয় পেয়েছে। বরিস জনসন বলেছেন, ব্রেক্সিট সম্পন্ন করার জন্য তার সরকার নতুন করে শক্তিশালী ম্যান্ডেট পেয়েছে। পশ্চিম লন্ডনের অক্সব্রিজ আসনে জয়লাভের পর জনসন বলেন, এখনকার পর্যায়ে যা দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে, কনজারভেটিভ সরকার কেবল ব্রেক্সিট কার্যকর করাই নয়, বরং দেশকে একতাবদ্ধ করা এবং সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যও নতুন করে শক্তিশালী বার্তা পেয়েছে। এদিকে লেবার পার্টির ভরাডুবির জন্য ব্রেক্সিটকে দায়ী করেছেন করবিন। তিনি বলেন, ব্রেক্সিট এই দেশের সাধারণ রাজনীতিকে বিঘিœত করেছে। পুরো দেশ এখন দ্বিধাবিভক্ত। ১২ ডিসেম্বরে ব্রিটিশ জনগণ ৬৫০-সদস্যের হাউস অব কমন্স বা পার্লামেন্ট নির্বাচনের জন্য ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে এবং সে নির্বাচনে একক সরকার গঠনের জন্য কোন রাজনৈতিক দলকে কমপক্ষে ৩২৬-আসনে বিজয়ী হতে হবে। আর সেটাই দখল করে নিয়েছে বরিস জনসনের দল। নির্বাচনে বেশ কয়েকটা রাজনৈতিক দল অংশ নিলেও প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের তালিকায় রয়েছে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল কনজারভেটিভ পার্টি, প্রধান বিরোধী দল লেবার পার্টি, লিবারেল ডেমোক্রেটিস পার্টি, ব্রেক্সিট পার্টি ইত্যাদি দল। নির্বাচনের লক্ষণীয় দুটো দিক হলো, ২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের পরবর্তী মাত্র আড়াই বছর পরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। অর্থাৎ ২০১৭ সালে নির্বাচিত পার্লামেন্ট পূর্ণ মেয়াদ পূরণ করতে পারেনি। আর দ্বিতীয় দিকটি হলো, ১৯২৩ সালের পরে এবারই ডিসেম্বর মাসে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। অর্থাৎ ১৯২৩ সালের পরে এবং ২০১৯ সালের আগে ব্রিটেনে আর কখনও ডিসেম্বর মাসে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। ব্রিটেনের নির্বাচনকে অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হিসেবে অভিহিত করেছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। পর্যবেক্ষকদের মতে, ১৯৪৪ সাল পরবর্তী সময়ে জন্মগ্রহণকারী ব্রিটিশ নাগরিকদের জন্য ১২ ডিসেম্বরের নির্বাচন সর্বাধিক তাৎপর্যপূর্ণ এ কারণে যে, এ নির্বাচনের ফলাফলের ওপর ব্রেক্সিটের ভবিষ্যত নির্ভর করছে। প্রায় চার বছর আগে ২০১৬ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা-না থাকার প্রশ্নে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি গণভোটের আয়োজন করেছিল এবং কনজারভেটিভ পার্টি তখন ই.ইউ থেকে বের হয়ে আসার অঙ্গীকারও করেছিল। তার সেই গণভোটের রায় ব্রেক্সিটের পক্ষে এলেও ব্রেক্সিট বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয় টোরী সরকার। বরং ব্রেক্সিট ইস্যুকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশ জাতির অস্তিত্ব সঙ্কট দেখা দিয়েছে এবং পর্যবেক্ষকরা তাই বলছেন, আসন্ন নির্বাচনে ব্রেক্সিট সঙ্কটের একটা সমাধানের পথ বের হয়ে আসতে পারে! বিজয়ীরা ব্রেক্সিটের ভাগ্য স্থির করে ব্রিটেনকে অস্তিত্ব সঙ্কটের কবল থেকে রক্ষা করতে পারে। তাই এ নির্বাচনের প্রধান ইস্যুই হলো ব্রেক্সিট। এ কারণে এ নির্বাচনকে ‘ব্রেক্সিট নির্বাচন’ হিসেবে অভিহিত করেছেন রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা। আশা জাগানোর মতো খবর হলো, ব্রিটিশ সমাজ ব্যবস্থায় বাংলাদেশীরা এখন বোঝা নয়। তারা ব্রিটেনের ধারাবাহিক অগ্রযাত্রার বাহক। না, এটি কোন সস্তা বক্তব্য বা মন্তব্য নয়। ভিনদেশী গবেষকদের পরিসংখ্যানই এমন খবর দিচ্ছে। এ খবরটির গুরুত্বের দিক হলো এর প্রেক্ষাপট। কারণ ব্রিটেনে অতীতের পঞ্চাশ বছরের তুলনায় গত দশ বছরে বাংলাদেশী অভিবাসীর হার নেমে এসেছে প্রায় শূন্যের কোঠায়। মাত্র এক প্রজন্ম আগেও ব্রিটেনে এথনিক মাইনোরিটি কমিউনিটির পরিসংখ্যানে বাংলাদেশীরা ছিলেন পিছিয়ে পড়াদের তালিকায়। এখন সেটা অতীত। বাস্তবতা পাল্টে গেছে। যুক্তরাজ্যে এককভাবে বাংলাদেশী জনবহুল অঞ্চলের তালিকায় প্রথমেই রয়েছে টাওয়ার হ্যামলেটস। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটেনের স্থানীয় সরকার বিভাগে টাওয়ার হ্যামলেটস ছিল দেশটির সবচেয়ে কম কার্যকর এরিয়া। ২০০৯ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ বাংলাদেশীরা নানা ক্ষেত্রে দেশটির জাতীয় গড় অগ্রগতির চেয়েও অনগ্রসর ছিলেন। কিন্তু মাত্র নয় বছরের ব্যবধানে ইসলাম ফোবিয়ার মতো বহু বাধা, নেতিবাচকতা সীমাবদ্ধতাকে জয় করেছেন বাংলাদেশীরা। যুক্তরাজ্যের মূলধারার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেছেন তারা। দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের বাংলাদেশীদের অগ্রযাত্রার নেপথ্যে আছে তাদের মেধা, অভিভাবকদের আগ্রহ, পারিবারিক মূল্যবোধ। বিদেশ-বিভুইয়ে অসংখ্য কৃতীমুখ আছে, যাদের সাফল্য বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য কিংবা ইতালিতে প্রবাসী বাংলাদেশী বা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত সে সব সফল মানুষের কীর্তিগাথায় আমরাও গৌরবান্বিত হই। কেউ শিক্ষাক্ষেত্রে, কেউ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে, কেউ ক্রীড়ায়, কেউ ব্যবসায় উদ্যোগে কেউবা আবার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নিজেদের কৃতিত্ব দিয়ে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের নাম। আবার বিশ্ব রাজনীতিতেও বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কিংবা বিদেশী বাংলাদেশীদের অংশগ্রহণ ও সাফল্য আসছে হামেশাই। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে মূল ধারার রাজনীতিতে সবেমাত্র খুঁটি গাড়তে শুরু করেছে প্রবাসী বাংলাদেশীরা। ইতোমধ্যে স্থানীয় পর্যায়ের পাশাপাশি মার্কিন ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক শাসনেও জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশীদের অনেকে। যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে চারজন জন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এমপি রয়েছেন। স্থানীয় সরকারে অর্ধ-শতাধিক বাংলাদেশী কাউন্সিলর। সামনের নির্বাচনে লেবার পার্টি ক্ষমতায় গেলে ব্রিটিশ-বাংলাদেশী অন্তত একজন মন্ত্রিত্ব পাবেন, এটা মোটামুটি নিশ্চিত। বাংলাদেশের বাইরে কেবল ব্রিটেনেই নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী পাওয়ার সমূহসম্ভাবনা দিন-দিন বাড়ছে। যুক্তরাজ্যের মূলধারায় আমাদের প্র্রজন্মকে আরও এগিয়ে নেয়াসহ প্র্রতিবন্ধকতাগুলো সমন্বিতভাবে দূর করার সময় এখনই। লেখক : শিক্ষাবিদ [email protected]
×