ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপি সম্পর্কে অমিত শাহর বক্তব্য প্রত্যাহার দাবি ফখরুলের

প্রকাশিত: ১০:৩৩, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯

বিএনপি সম্পর্কে অমিত শাহর বক্তব্য প্রত্যাহার দাবি ফখরুলের

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ভারতের লোকসভায় বাংলাদেশ, বিএনপি ও খালেদা জিয়ার সরকার সম্পর্কে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে বিএনপি। রবিবার বিকেলে বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ দাবি জানান। ফখরুল বলেন, ভারত সম্প্রতি তাদের আইনসভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস করেছে। যা ইতোমধ্যে আইনে পরিণত হয়েছে। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের পার্লামেন্টে উক্ত বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের পক্ষে যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে গিয়ে অযাচিতভাবে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। তিনি ঢালাওভাবে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশকে একই বন্ধনীতে চিহ্নিত করে যুক্তি হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন যে ইসলাম রাষ্ট্র ধর্ম হওয়ার কারণেই বাংলাদেশে অন্য ধর্মের মানুষ নিপীড়িত হচ্ছেন। ফখরুল বলেন, কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক এখন এক সোনালি অধ্যায়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, দুই দেশের নেতারা প্রায়ই এমন দাবি করে থাকেন। অথচ ভারতের লোকসভায় অমিত শাহ বলছেন, ‘সেই বন্ধুপ্রতিম বাংলাদেশেই হিন্দু- বৌদ্ধ-খ্রীস্টানরা এখনও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন’। ভারতীয় জনতা পার্টির সভাপতি ও ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পার্লামেন্টে তার বক্তব্যের এক পর্যায়ে আমাদের নেত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের নাম উচ্চারণ করে শিষ্টাচার বহির্ভূতভাবে সরাসরি অভিযুক্ত করে বলেন, ‘বাংলাদেশে বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ব্যাপক হারে সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়েছে। নির্যাতনের শিকার সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় ভারতে পালিয়ে এসেছে’। এর মাধ্যমে তিনি উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিএনপিকে সাম্প্রদায়িক নিপীড়নকারী দল হিসেবে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা চালিয়েছেন। বিএনপি মহাসচিব বলেন, বিতর্কিত এই বিলের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে অমিত শাহ বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন এখনও অব্যাহত আছে এবং সে কারণেই এই বিল আনা হয়েছে বলে ভারতীয় পার্লামেন্টে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্য উপস্থাপন করেছেন। বিল পাসের প্রাক্কালে লোকসভায় বক্তব্য প্রদানকালে অমিত শাহ আরও বলেন, বাংলাদেশে নরসংহার থামেনি, বেছে বেছে সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করা হচ্ছে। একাত্তরের পরও সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। অমিত শাহর এই বক্তব্যের পর ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র রাবীশ কুমার অমিত শাহের বক্তব্যকে একটি বিশেষ উদ্দেশে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে পরস্পরবিরোধী ও একপেশে মিথ্যাচার করেছেন। যদিও অমিত শাহ বলেছেন যে , এদেশে নির্যাতন অব্যাহত থাকার কারণেই এই বিল আনতে তিনি বাধ্য হয়েছেন। অপরদিকে রাবীশ কুমার উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অমিত শাহর বক্তব্য থেকে সরে এসে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারকে দায় মুক্তি দেয়ার একপেশে অপচেষ্টা চালিয়েছেন, যদিও বিগত এক দশকেরও অধিককাল ধরে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারই ক্ষমতা দখল করে আছে । ফখরুল বলেন, হিন্দুত্ববাদী ভারত প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও বিএনপির কাঁধে বন্দুক রেখে মিথ্যাচারের মাধ্যমে সম্পূর্ণ শিষ্টাচার বহির্ভূতভাবে এ অঞ্চলের রাজনীতিকে একটি অসুস্থ পরিবেশের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের কথা এড়িয়ে গিয়ে ইচ্ছাপ্রণোদিতভাবে বিএনপির মতো একটি অতি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে বিষোদগার করায় এটি প্রমাণিত হয় যে, বর্তমান ভারত সরকার তার সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য বাংলাদেশের জনগণের পরিবর্তে নতজানু আওয়ামী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে বেশি আগ্রহী। ফখরুল বলেন, বিএনপি দৃঢ়ভাবে মনে করে বিজেপির সভাপতি ও ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র রাবীশ কুমার উভয়ের বক্তব্যই দুঃখজনক ও অসত্য, অপব্যাখ্যামূলক, একপাক্ষিক, বৈষম্যমূলক, বিভ্রান্তিকর এবং চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। তাই ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্রের বক্তব্য আমরা প্রত্যাখ্যান করছি। বিএনপি মহাসচিব বলেন, ঐতিহ্যগতভাবে একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকারের সময় বরাবরই বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুণ্ণ ছিল। এমনকি বাবরি মসজিদ সঙ্কট এবং গুজরাট দাঙ্গার সময়ও খালেদা জিয়ার আমলে দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় ছিল। ফখরুল বলেন, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনকে অগণতান্ত্রিক, বৈষম্যমূলক, অসাংবিধানিক ও মানবতাবিরোধী আখ্যায়িত করে সারা ভারতে এখন প্রতিবাদ চলছে। কোথাও কোথাও এই প্রতিবাদ সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। বিশ্ব গণমাধ্যমও এ বিষয়ে সোচ্চার। কেবলমাত্র সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়কে টার্গেট করেই এ আইন প্রণীত হয়েছে বলে আজ জনমনে বিশ্বাস স্থাপিত হয়েছে। এমনকি ভারতের অমুসলিম সম্প্রদায়ের বিবেকবান মানুষও এই বৈষম্যমূলক আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করছে। মির্জা ফখরুল বলেন, ভারতে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব নির্ধারণের সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাপী সমালোচিত ও নিন্দিত হচ্ছে। জাতিসংঘ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ ও বিবেকবান জাতিগোষ্ঠী এহেন বৈষম্যমূলক আইনের কারণে চরমভাবে উৎকণ্ঠিত। ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশন (ইউএসসিআইআরএফ) মার্কিন প্রশাসনকে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি বিবেচনা করার সুপারিশ করেছে। আন্তর্জাতিক এই প্রতিক্রিয়ায় প্রমাণিত হয়, এই অসন্তোষ কেবলমাত্র ভারতের সীমান্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, ক্রমান্বয়ে তা গোটা উপমহাদেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে বিনষ্ট করবে। চরমভাবে আঘাত করবে এই অঞ্চলের শান্তিপ্রিয় জনগণের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চেতনা এবং ঐতিহ্যকে। যার সুদূরপ্রসারী কুপ্রভাবের শিকার হতে হবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমাদের সকলকে। ফখরুল বলেন, সম্প্রতি আমাদের সীমান্তবর্তী ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য অসমের ১৯ লাখেরও বেশি মানুষের নাম জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। যা উত্তর-পূর্ব-ভারতীয় বিভিন্ন রাজ্যসহ বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকদের মাঝে ব্যাপক উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের বৃহত্তম সীমান্তবর্তী ভারতীয় রাজ্য পশ্চিম বাংলায় এনআরসির মাধ্যমে এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে নাগরিকহীন করার ঘোষণা ভারতের ক্ষমতাসীন কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী ও বিজেপির কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য নেতৃত্বের তরফ থকে লাগাতারভাবে প্রচার ও প্রোপাগান্ডা চালানো হচ্ছে। পশ্চিম বাংলাসহ ভারতের অন্য রাজ্যে বিশেষ করে মুসলিম অধ্যুষিত রাজ্যগুলোতে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি করার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবেই সাম্প্রতিক নাগরিক সংশোধনী আইনটি সংসদে পাস করা হয়েছে বলে বিজেপি ঘোষণা দিয়েছে। ফখরুল বলেন, বিএনপি বিভিন্ন সময়ে আমাদের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এনআরসি বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। অথচ বর্তমান সরকার দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে অন্য সকল বিষয়ের মতো যারপরনাই উদাসীন এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য প্রদান করছে। সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা ঢালাওভাবে এনআরসি সমস্যাকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন। ভারতের মন্ত্রীরা এনআরসির মাধ্যমে বাদপড়া বাংলাভাষী মুসলিম নাগরিকদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার সুস্পষ্ট ঘোষণা দেয়ার পরও বাংলাদেশের সরকার নিরন্তরভাবে নির্বিকার ও নির্লিপ্ত। প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ভারত সফরকালেও এ বিষয়টি এ সরকার এজেন্ডাভুক্ত করতে পারেনি। এ ধরনের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকারের এহেন নতজানু ও দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের ফলেই মূলত আজকে প্রতিবেশী ভারতের পার্লামেন্টে সংখ্যালঘু নির্যাতন বিষয়ে বাংলাদেশ ও বিএনপি সম্পর্কে মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দায় চাপানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। মির্জা ফখরুল বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার যতই এনআরসিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়, এটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই এবং এর প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে নাবলে সাফাই গাইতে থাকুক না কেন, সম্প্রতি বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বাংলা ভাষাভাষী মুসলিমদের দেশের অভ্যন্তরে পুশ-ইন চলছে। যার বিরুদ্ধে খোদ ভারতেই প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের পাশাপাশি বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। যা মোকাবেলায় কিছু এলাকায় ইতোমধ্যেই পুশ-ইন প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়েছে। এ বিষয়ে ভারতের মানবাধিকার সংস্থা এসডিপিআর এর মন্তব্য হলো, ‘এরা বাংলাদেশ বা ভারতের নাগরিক তা নির্ধারিত হয়নি। তা হলে কেন তাদের এভাবে বাংলাদেশে পুশ-ইন করা হবে। যদি এরা বাংলাদেশের নাগরিকও হন, তবে কেন আইনী প্রক্রিয়ায় আদালতের মাধ্যমে তাদের বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে না এভাবে পাঠানো বে-আইনী।’ ফখরুল বলেন, প্রকৃতপক্ষে মিয়ানমার যেমন রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে নির্যাতনের মুখে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে, একইভাবে নাগরিকত্ব আইন এবং এনআরসি জটিলতায় সংখ্যালঘু ভারতীয় মুসলিমদের জোর করে বাংলাদেশে পুশ-ইন করার প্রক্রিয়া আমরা লক্ষ্য করছি। অথচ সরকার এনআরসি বিষয়টিকে বার বার ভারতের অভ্যন্তরীণ ইস্যু আখ্যায়িত করে এড়িয়ে যাচ্ছে। এনআরসি ইস্যুতে মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং ভারত থেকে সীমান্ত দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া সংখ্যালঘু ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে কোন মৌলিক ব্যবধান নেই।
×