ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

বনানী কবরস্থানে স্ত্রী আয়েশার কবরে সমাহিত

শ্রদ্ধা-ভালবাসায় স্যার ফজলে হাসান আবেদের চিরবিদায়

প্রকাশিত: ১০:০৭, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯

  শ্রদ্ধা-ভালবাসায় স্যার ফজলে হাসান আবেদের চিরবিদায়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অন্যতম রূপকার স্যার ফজলে হাসান আবেদ। তীব্রশীত উপেক্ষা করে অগণিত মানুষ জড়ো হয়েছিলেন তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। বিদায়যাত্রায় কফিনে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণের মাধ্যমে সেসব মানুষ জানান তাদের শ্রদ্ধা, ভালবাসা। ফুলের শ্রদ্ধা নিবেদনকালে। কারও চোখের কোল গড়িয়ে ঝরেছে অশ্রু। সেই শ্রদ্ধাঞ্জলি অনুষ্ঠানে দেশের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ কীর্তিমান মানুষটির কর্মের মূল্যায়ন করেছেন বিশিষ্টজনরা। ফজলে হাসান আবেদকে হারিয়ে দেশের অগ্রযাত্রায় অপূরণীয় ক্ষতির কথা বলেন তারা। রবিবার বনানীর আর্মি স্টেডিয়ামে অন্তিম শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় ফজলে হাসান আবেদকে। সকাল সাড়ে দশটা থেকে বেলা সাড়ে বারোটা পর্যন্ত জানানো হয় শ্রদ্ধাঞ্জলি। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পাশাপাশি শ্রদ্ধা জানান নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে অনুষ্ঠিত হয় নামাজে জানাজা। জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে প্রথম স্ত্রী আয়েশা আবেদের কবরে তার লাশ সমাহিত করা হয়। তার জানাজা পড়ান গুলশান কেন্দ্রীয় আজাদ মসজিদের ইমাম মাওলানা আহসানউল্লাহ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ছেলে শামেরান আবেদ, মেয়ে তামারা আবেদসহ পরিবারের ঘনিষ্ঠজনরা। এর আগে সকালে মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে নেয়া হয় তার মরদেহ। সেখানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের এই প্রতিষ্ঠাতাকে শ্রদ্ধা জানান প্রতিষ্ঠানের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী। জানাজায় মানুষের ঢল নামে। জানাজা শুরু হওয়ার আগেই ছেলে শামেরান আবেদ বলেন, সবাই অকৃত্রিম ভালবাসা ও শ্রদ্ধা নিয়ে আমাদের ব্র্যাক পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। কষ্ট করে যারা এসেছেন পরিবারের পক্ষ থেকে তাদের ধন্যবাদ জানাই। আমার বাবা সারাটি জীবন মানুষের জন্য কাজ করেছেন। তিনি কাউকে দুঃখ দিয়ে থাকলে ক্ষমা করে দেবেন। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের মরদেহে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ফুলেল শ্রদ্ধা জানানো হয়। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের পক্ষে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান মেজর আশিকুর রহমান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তার উপ-সামরিক সচিব কর্নেল মোঃ সাইফুল্লাহ। এরপর শ্রদ্ধা জানান স্পীকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ও ডেপুটি স্পীকার ফজলে রাব্বী মিয়া। আওয়ামী লীগের পক্ষে শ্রদ্ধা জানান দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ, বাহাউদ্দিন নাছিম, বিপ্লব বড়ুয়া প্রমুখ। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানান গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস, জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারী শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম, ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. ম. তামিম, সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের বিচারপতি ইমান আলী সুজন, সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রমুখ। এছাড়াও বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র জাতিসংঘ ঢাকা কার্যালয়, এফবিসিসিআই, এমসিসিআই, প্রশিকা, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পক্ষে সারা যাকের, জিয়াউদ্দিন তারিক আলী, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, নারী প্রগতি সংঘ, মেট্রোপলিটন চেম্বার, এফএনবি, ওয়েভ ফাউন্ডেশন, বাংলা একাডেমি, ব্র্যাক ব্যাংক, গুলশান সোসাইটি, সিভিএফ, ব্যুরো বাংলাদেশ, হোটেল ঢাকা রিজেন্সি, রিসার্চ এ্যান্ড হেলথ সেন্টার, গ্রামীণ ফোন, প্রিপ বাংলাদেশ, গণসাক্ষরতা অভিযান, নারীপক্ষ, নিজেরা করি, বাংলাদেশ ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশন, ভাসানী প্রজন্ম পরিষদ, জনস্বাস্থ্য আন্দোলন, নাগরিক উদ্যোগ, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ, স্মার্ট, লাইট হাউস, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচী, দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট, সিআরপি, মায়া, কনসার্ন, আশা, দৈনিক সংবাদ, আড়ং, সিসিডিবি, এইড কুমিল্লা, টিএমএসএস, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি, বানিয়াচং আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন, জালালাবাদ এ্যাসোসিয়েশন, ইমপ্যাক্ট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ প্রভৃতি সংগঠন। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, স্যার ফজলে হাসান আবেদ একজন জনদরদী অসাধারণ মানুষ ছিলেন। তার শূন্যতা কোনদিন পূরণ হবে না। তার তুলনা তিনি নিজে। এদেশে অনেক এনজিও কার্যক্রম আছে। ফজলে হাসান আবেদ ছিলেন একেবারে প্রচারবিমুখ। নীরবে, নিঃশর্তভাবে তিনি বাংলার তৃণমূল পর্যন্ত তার কার্যক্রম ছড়িয়ে দিয়েছেন। দেশব্যাপী ব্র্যাকের কর্মকা- বিস্তৃত করেছেন। শুধু দেশেই নয় দেশের বাইরেও ব্র্যাকের কার্যক্রম বিস্তৃতি লাভ করেছে। তৃণমূলের মানুষের জন্য তার অসামান্য অবদান রয়েছে। ব্র্যাক ব্যাংকের ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে অবদান আছে তার। তিনি চলে গেলেও তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ কোন না কোনভাবে ফজলে হাসান আবেদের স্পর্শ পেয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে বিষয়টি এক অনন্য নজির। তিনি কোন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলেন না অথচ তার প্রতিষ্ঠিত প্রতিটি প্রতিষ্ঠান সুশৃঙ্খল। মানুষের জীবন পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রেখে চলেছে। এটাও অসাধারণ একটা দৃষ্টান্ত। একজন ব্যক্তি এত ভিন্ন মাত্রায় মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে বিশাল ভূমিকা রেখে চলেছেন। যা বাংলাদেশ ও পৃথিবীর মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন এনে দিচ্ছে - এটাও এক অনন্য দৃষ্টান্ত। সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ বলেন, স্যার ফজলে হাসান আবেদ ছিলেন মহান ব্যক্তি। বিশ্বেও সমধিক খ্যাতিমান। তিনি হৃদয়বান ও বিনয়ী ছিলেন। দরিদ্র মানুষের ভাগ্য ফেরাতে অবদান রেখেছেন? যা পৃথিবীর ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে। ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করে দারিদ্র্য বিমোচনে তার যে অবদান তা অনন্য দৃষ্টান্ত। জাতি তার মৃত্যুতে শোকাহত। জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ’৫২ সাল থেকে আমার সঙ্গে ফজলে হাসান আবেদের বন্ধুত্ব। ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন দেশের মানুষের জন্য ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে একপর্যায়ে প্রতিষ্ঠা করেন ব্র্যাক। এভাবেই নিজের একক প্রচেষ্টায় সবাইকে সম্মিলিত করে গড়ে তোলেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাটি। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, স্যার ফজলে হাসান আবেদ ছিলেন একজন ক্ষণজন্মা পুরুষ। যারা পৃথিবীকে বদলে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, গ্রামীণ বাংলাদেশের মহিলাদের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে, তাদের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে তার অবদান অপরিসীম। তিনি বিশ্বে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। তার কথা বাংলাদেশসহ বিশ্বের মানুষ চিরকাল মনে রাখবে। তার শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ৩০ বছর ধরে তার সঙ্গে কাজ করেছি। গণসাক্ষরতা অভিযানের তিনি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তাকে দেখেছি মানুষের জন্য কি অসাধারণ কাজ করার সামর্থ্য। মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে তিনি গ্রামে গিয়ে কাজ শুরু করেছেন। সেখান থেকে তিলে তিলে ব্র্যাক গড়ে তোলেন। তার মতো বিনয়ী, প্রচারবিমুখ মানুষ খুব কম দেখেছি। কথা কম বলে মানুষের জন্য নীরবে কাজ করে যাওয়া এই মানুষটি ছিলেন জাতির এক ব্যতিক্রমী বাতিঘর। ব্র্যাকের কার্যনির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য স্থপতি লুভা নাহিদ চৌধুরী বলেন, তিনি ছোট করে ভাবতেন না। তার সব ভাবনাই ছিল মানুষকে কেন্দ্র করে। সেই মানুষ শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয়, বিশ্বের মানুষের কথা ভাবতেন। মানুষকে ভালবাসাই ছিল তার সকল কাজের অনুপ্রেরণা। তার সঙ্গে কাজ এটাই আমার প্রথম উপলব্ধি। ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক এবং ফজলে হাসান আবেদের জামাতা আসিফ সালেহ বলেন, ‘পরিবারের প্রত্যেকের সঙ্গে ফজলে হাসান আবেদের ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল। কারও জীবন পরিবর্তনের জন্য তিনি কাউকে নীতিবাক্য শোনাতেন না, বাস্তববাদী পরামর্শ দিতেন। তার স্ত্রী মারা গেছেন ’৮১ সালে। এত বড় একটি প্রতিষ্ঠান চালানোর পাশাপাশি তিনি পরিবারকেও সময় দিতেন। তার কাজের কথা সারাদেশের মানুষ জানতেন। মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন অনন্য। শুধু ব্র্যাক নয়, দেশের বেশিরভাগ বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে যুক্ত ছিলেন তিনি। এটা অনেকেই জানেন না। তিনি এসব প্রতিষ্ঠানেরও অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছেন।’ গত শুক্রবার রাত সাড়ে আটটার দিকে রাজধানীর এ্যাপোলো হাসপাতালে ৮৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। মস্তিষ্কের টিউমারে আক্রান্ত হয়ে ২৮ নবেম্বর থেকে তিনি ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
×