ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

মতি লাল দেব রায়

আত্মরক্ষার কৌশল মহিলাদের শিখতে হবে

প্রকাশিত: ০৯:২৬, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯

আত্মরক্ষার কৌশল মহিলাদের শিখতে হবে

আমাদের দেশে মহিলাদের ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়া নিয়া অনেক কথাবার্তা বিভিন্ন পর্যায়ে হয়েছে বা এখনও হচ্ছে সরকারী-বেসরকারী সেবামূলক সংস্থা, জাতিসংঘের বিভিন্ন শাখা ও মানবধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা সবাই মহিলাদের ক্ষমতায়নের পক্ষে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করছেন। ব্র্যাকসহ ছোট-বড় অনেক দেশীয় সংস্থা মহিলাদের ক্ষমতায়নের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে চলেছে। বর্তমান সরকার কর্তৃক মহিলাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে ক্ষমতায়ন করার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে, জাতীয় সংসদে ৫০ জন মহিলা সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত করা হয়েছে, মহিলাদের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী পদে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, এমনকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদে ও বসানো হয়েছে, মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণলায় সৃষ্টি করা হয়েছে একমাত্র উদ্দেশ্য মহিলাদের সমাজে ক্ষমতায়ন করা যা খুবই প্রশংসনীয়। মহিলারা এগিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু সামগ্রিক বিচারে চিন্তা করলে দেখা যায় যে প্রক্রিয়ায় মহিলাদের ক্ষমতায়ন করা হচ্ছে সেই প্রক্রিয়ায় দেশের মহিলাদের সুরক্ষা দেয়া যাচ্ছে না, ঘরে বাইরে রাস্তাঘাটে, ট্রেনে, বাসে, লঞ্চে, গ্রামে শহরে কোন জায়গায় মহিলারা নিরাপদ নয় এমন কি পুলিশের কাছেও মহিলারা নিরাপদ নয়। সমাজ এদের সুরক্ষা দিতে পারছে না। এই অভিজ্ঞতায় বলা যায় কেউ তাদের ক্ষমতায়ন করতে পারবে না যদি না তারা তাদের ক্ষমতায়ন করার প্রচেষ্টা না চালান। সত্যি যদি মহিলাদের ক্ষমতায়ন করার ইচ্ছা থাকে তবে প্রথমে নিজের ঘরে মহিলাদের ক্ষমতায়ন করতে হবে, একজন মহিলা সাড়া দিন তিন বেলা ভাত রান্না করবে, ছেলেমেয়েদের স্কুলে নিয়ে যাবে, বাজার করবে, ঘর ঘুচাবে, গৃহস্থালি সকল কাজ করে কি করে ঘরের বাইরের কথা চিন্তা করবে, পুরুষরা ঘরের কোন কাজ করতে একেবারেই অনিচ্ছা প্রকাশ করেন, তাদের ইচ্ছার অনিচ্ছার গুরুত্ব দিয়ে গৃহের কাজের অর্ধেক কাজ ভাগাভাগি করে পুরুষদের করার অভ্যাস করতে হবে, তখনই মহিলারা নিজেদের নিয়ে চিন্তা করতে পারবে ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিজেকে জড়াতে পারবেন। মহিলারা যদি নিম্নে উল্লিখিত বিষয়গুলোর প্রতি নজর দিতে সচেষ্ট হন তা হলে পর্যায়ক্রমে তাঁরা সমাজে তাঁরা যথাযথ স্থানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। মনে রাখবেন ক্ষমতায়নের সিঁড়িকে নিজেই অতিক্রম করতে হবে। স্বশক্তিকরণ : আক্রান্ত হলে মহিলাকে নিজেই এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে তিনি যদি মোকাবেলা করতে পারেন তবেই বোজা যাবে তাহাদের ক্ষমতা হয়েছে। সেক্ষেত্রে নিজের স্বশক্তি সৃষ্টি করে নিজেকে গড়তে হবে। প্রত্যেক যুবতী মেয়েকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন। দেশে যত নারী নির্যাতন হয়েছে বা এখন হচ্ছে তাঁতে কোন পুরুষ সাহায্যের জন্য এগিয়ে যেতে দেখেছেন, সংখ্যায় খুব কম। তাই নিজের প্রতিরক্ষা নিজেদেরই করতে হবে। প্রজনন স্বাস্থ্য জ্ঞান: প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে ধারণা থাকলেই কেবল নিজে নিজে স্বাস্থ্যগত সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। শিশু জন্মদান সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়া মেয়েদের অধিকার, আপনি সন্তান নেবেন আর সিদ্ধান্ত দেবে অন্য কেউ তা হয় না। এটা কারও দয়া নয় এটা আপনার অধিকার। অধিক সন্তান নেয়া বন্ধ করা প্রয়োজন। সুস্থ স্বাস্থ্য, সুস্থ জীবন: শারীরিক স্বাস্থ্য মজবুত রাখার জন্য স্কাউটিং, কেরাট প্রশিক্ষণ, শরীর চর্চা নিয়মিত করতে হবে। রাস্তাঘাটে আক্রমণ থেকে নিজেকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য বিভিন্ন রকম কৌশল শিখতে হবে। নিজের কন্যা সন্তানকে নিজের চোখে চোখে রাখা খুব প্রয়োজন, কোন নিকটাত্মীয়ের কাছে আপনার কন্যা সন্তান নিরাপদ নয়। আমাদের সমাজে খুব কম মহিলাই পাবেন যারা শৈশবকালে কোন না কোন নিকটাত্মীয়ের দ্বারা বিভিন্নভাবে যৌন হয়রানির স্বীকার হন নাই। তাই নিজের কন্যা সন্তান মায়ের কাছে ছাড়া কারও কাছে নিরাপদ নয়। আপনার কন্যা সন্তানকে তার ব্যক্তিত্ব ঘটনে শৈশবকাল থেকে তাঁকে উপযুক্ত শিক্ষা প্রদান করুন। কন্যা সন্তানকে বেড়ে ওঠার সময় সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়া আপনার দায়িত্ব। নিজস্ব তহবিল : সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে অর্থ একটি বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায় তাই নিজের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা বাড়বে যদি আপনার নিজস্ব তহবিলের অর্থের পরিমাণ যত বাড়বে। তাই নিজের অর্থ উপার্জনের উপায় বের করতে হবে এবং নিয়মিত আয় করা যায় এমন অর্থনৈতিক কর্মকা-ে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে হবে। নির্ভরশীলতা পরিহার : নির্ভরশীলতা একজন মানুষকে পঙ্গু করে দিতে পারে তাই সব ক্ষেত্রে পুরুষের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসুন, পরিবারের সব দায়িত্ব পুরুষের ওপর তুলে দিলে তার ওপর নির্ভরশীলতা বাড়বে দায়িত্ব নিন, সবকিছুতে অংশীদার হওয়ার চেষ্টা করুন। মনে রাখবেন নির্ভরশীলতা নিজের স্বাবলম্বী হওয়ার অন্যতম বাধা। নিজেকে আলাদা সত্তা হিসেবে মনে মনে ভাবুন। একটি ট্রেডে দক্ষতা : গ্রামবাংলার অধিকাংশ মহিলাই মাধ্যমিক পরীক্ষা বা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা সমাপ্ত করে পরিবারে সবার বোঝা হয়ে দিন কাটান তাঁদের অধিকাংশের বিশেষ কোন বিষয়ের ওপর দক্ষতা থাকে না তাই তাঁরা নিজেদের উদ্যোগে কিছু করার ইচ্ছা থাকলেও তা করতে পারেন না। প্রত্যেক মহিলার যে কোন একটি ট্রেডে যেমন কম্পিউটার, নার্সিং প্রশিক্ষণ, কালচারেল আর্ট, গল্প লেখা, ভিডিও ফিল্ম তৈরি, নাচ, গান ইত্যাদি যে কোন নিজের পছন্দ মোতাবেক ট্রেডের ওপর দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেকে দক্ষ করে তুলুন। দেখবেন কাজে লেগে যাবে। দেশের উন্নয়নে সম্পৃক্ততা : দেশের জাতীয় উন্নয়নে নিজেকে সম্পৃক্ত করে সকলকে জানান দেন আপনাদের উপস্থিতি। যেমন- পুলিশ ডিপার্টমেন্টে, সেনাবাহিনী, বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা, ট্রাফিক পুলিশে চাকরি নেয়াসহ অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী গ্রুপে যোগদান করা যেমন স্কাউটিংসহ অন্যান্য কাজে যোগদান করলে সরকারি চাকরির কারণে আপনাকে রাস্তাঘাটে কিছু বলার বা ইভটিজিং করার সাহস পাবে না। সুযোগ পেলে গাড়ি ড্রাইভিং শিখে ড্রাইভিং পেশায় যোগ দেন এবং নিজের দক্ষতা অনুযায়ী গাড়ি পছন্দ করেন এবং চালান। লিঙ্গ বৈষম্য : লিঙ্গ বৈসম্য দূর করার জন্য পুরুষদের গৃহস্থালি কাজে অংশগ্রহণ করানোর যাবতীয় চেষ্টা করে যান, পুরুষ যে কাজ পরিবারে জন্য করেন তা করার চেষ্টা করুন, নিজের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে একই রকম আচরণ করুন এমন কিছু করবেন না যে ছেলে মনে করে সেই পরিবারে খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, কখনও এটা আচার আচরণে প্রকাশ করা যাবে না। পরিবারের কোন স্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করলে তার অংশীদারিত্ব দাবি করুন। বিয়েবন্ধনের পূর্বে পাত্রকে জেনে-শুনে বিয়ের অনুমতি দেন, যে স্বামী বন্ধুর মর্যাদা দেবে মনে করেন, যে স্বামী আপনার প্রভু হিসেবে মনে করবে মনে করেন তার ধারে কাছেও যাবেন না। মহিলাদের ক্ষমতায়ন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, এটা একদিনে সম্ভব নয়, ধাপে ধাপে উপরোক্ত বিষয়গুলো নিজেদের জীবনে প্রয়োগ করে নিজের অবস্থানকে টেকসই নিজেকেই করতে হবে। নেতৃত্বের বিকাশ : নিজেরা স্থানীয়, উপজেলা, জেলা এবং জাতীয় পর্যায়ে যত নির্বাচন হবে প্রত্যেকটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নিজেদের অবস্থান সমাজের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠা করে এবং স্বাধীনতার পক্ষের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখুন। মনে রাখতে হবে মহিলারা কোন অংশেই পুরুষদের চেয়ে কম বুদ্ধিসম্পন্ন নয়, পুরুষরা যে কাজ করতে পারে মেয়েরাও সেই একই কাজ করতে পারে। মহিলারা আর এখন অবলা নারী নয়। সমাজের সকল স্তরের মহিলাদের একটি মেসেজ দিতে চাই তা হলো ক্ষমতা কাউকে দেয়া যায় না বা কেউ দেয় না, তা কেড়ে নিতে হয়।
×