ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘট প্রত্যাহার

প্রকাশিত: ১০:৩৩, ১ ডিসেম্বর ২০১৯

নৌযান শ্রমিকদের  ধর্মঘট  প্রত্যাহার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সারাদেশে নৌযান শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘট প্রত্যাহার হয়েছে। শনিবার দিবাগত রাত সোয়া বারোটার দিকে ধর্মঘট প্রত্যাহার হয়। আগামী বছরের মার্চের মধ্যে ১১ দফা দাবি বাস্তবায়নের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেন আন্দোলনকারীরা। ধর্মঘট প্রত্যাহারের আগে শ্রম অধিদফতর, নৌযান মালিকসহ বিভিন্ন দফতরের উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে টানা ছয় ঘণ্টার বৈঠক হয় নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দের। সেই বৈঠকেই সমঝোতা হয়। আর তাতেই নৌযান ধর্মঘট প্রত্যাহার হওয়ায় সারাদেশে স্বস্তি ফিরে আসে। সারাদেশে নৌযান চলাচল আগের মতোই স্বাভাবিক হচ্ছে। নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী আশিকুল আলম রাতেই ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। পাশাপাশি তিনি যথারীতি দেশের সকল রুটে নৌযান দ্রুত চলাচল করার নির্দেশনা দেন। এমন ঘোষণার পর পরই সারাদেশে নৌযান চলাচল শুরুর প্রস্তুতি শুরু হয়। এরআগে শ্রম অধিদফতরের মহাপরিচালক একেএম মিজানুর রহমান বিকেল তিনটা থেকে ঢাকার শ্রম ভবনে লঞ্চ মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠকে বসেন। বৈঠক চলে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত। কিন্তু কোন সুফল আসেনি। এরপর আবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সকল পক্ষের সমন্বয়ে বৈঠক শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত রাত বারোটায় সমঝোতা হয়। রাত সোয়া বারোটায় ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা আসে। শ্রম মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা আখতার হোসেন জানান, বৈঠকে নীতিগতভাবে শ্রমিকদের সব দাবি মেনে নেয়ায় ফেডারেশনের নেতারা ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। সরকার শ্রমিকদের ১১ দফা দাবি মেনে নিয়ে তা আগামী বছরের মার্চের মধ্যে বাস্তবায়নের আশ্বাস দেয়। প্রসঙ্গত, শুক্রবার দিবাগত রাত বারোটা থেকে শ্রমিকদের নিয়োগপত্র ও খাবার ভাতা দেয়াসহ ১১ দফা দাবিতে নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের ডাকে শুরু হয়েছিল ধর্মঘট। এতে দক্ষিণ জনপদের জেলাগুলো থেকে লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে যাত্রীদের ব্যাপক ভোগান্তি হয়। মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য ওঠা-নামা ব্যাহত হয়। নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাহ আলম বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে ১১ দফা দাবি আদায়ে আন্দোলন করে আসছি। লঞ্চ মালিকপক্ষ শুধু আমাদের আশ্বাস দিয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়ন করেনি। গত বুধবারও সরকারের প্রতিনিধির সঙ্গে বসেছিলাম, কিন্তু আবারও আশ্বাস। সঙ্গত কারণে আমরা অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ধর্মঘটে গেছি। সর্বশেষ এর একটি সুরাহা হওয়ায় আমরা খুশি। সদরঘাট ॥ ধর্মঘটের মধ্যেই ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে কয়েকটি লঞ্চ ছেড়ে গেছে। বিআইডব্লিউটিএ সূত্র বলছে সারা দিন ৮০টা লঞ্চ ছাড়ার কথা। কিন্তু সন্ধ্যা পর্যন্ত ২২টি লঞ্চ ছেড়ে গেছে। তবে সন্ধ্যার পর লঞ্চ চলাচল স্বাভাবিক হয়নি। রাত সোয়া বারোটায় ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণার পর নৌযান চলাচল স্বাভাবিক হতে থাকে। ঢাকা নদী বন্দরের পরিচালক একেএম আরিফ উদ্দিন বলেন, ধর্মঘট প্রত্যাহারের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। আগের মতোই নৌযান চলাচল শুরু হবে। ধর্মঘট প্রত্যাহারের পর রাত থেকেই নৌযান চলাচল স্বাভাবিক হওয়ার প্রস্তুতি চলতে থাকে। অভ্যন্তরীণ যাত্রী পরিবহন সংস্থার সচিব সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারি জানান, প্রথম দিকে শ্রমিকদের এমন দাবি অযৌক্তিক বলা হলেও শেষ পর্যন্ত সমঝোতা হয়েছে। নৌযান শ্রমিকদের মূল দাবিগুলো মেনে নিয়ে লঞ্চ মালিকপক্ষ ২০১৬ সালে নৌযান শ্রমিকদের সঙ্গে পাঁচ বছরের একটি চুক্তি করেছিল। সে চুক্তির মেয়াদ ২০২১ সালে শেষ হবে। এর আগে আর কোন দাবি না মানার বিষয়েই সিদ্ধান্ত ছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত সেই সমস্যার সমাধান হয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, আমাদের চট্টগ্রাম অফিস জানায়, আমদানির পণ্য নিয়ে বহির্নোঙ্গরে অপেক্ষা করছে ৭৮ মাদারভেসেল। কর্ণফুলী নদী মোহনা ও সংলগ্ন এলাকায় বর্তমানে রয়েছে একহাজারের বেশি লাইটার জাহাজ ধর্মঘটে অলস বসে রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক জানিয়েছেন, জেটিতে কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে। ইয়ার্ড থেকে কন্টেনার খালাস হচ্ছে। জাহাজে কন্টেনার উঠানামাও স্বাভাবিক আছে। তবে বহির্নোঙ্গরে পণ্য খালাসে সব ধরনের অচলাবস্থা বিরাজ করছে। লাইটার জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কো অর্ডিনেশন সেলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, কদিন আগে যে ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল সে সময় বহির্নোঙ্গরে আংশিক পণ্য খালাসের কাজ হয়েছিল। কিন্তু এবার একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। সেলের অধীনে ২০০ লাইটার জাহাজ অলস বসে আছে বলে তিনি জানান। চট্টগ্রাম ভেসেল ওনার্স এ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানানো হয়, জাহাজ মালিকরা পণ্য খালাসে প্রস্তুত। কিন্তু শ্রমিকরা ধর্মঘটে যাওয়ায় ভেসেলগুলোকে ডেমারেজ গুণতে হয়েছে। বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা বার বার তাদের দাবি কথা বলে আসছে। কিন্তু দাবির পূরণে কোন দৃষ্টি দেয়া হয়নি। ফলে তারা ধর্মঘটে যেতে বাধ্য হয়েছেন। স্টাফ রিপোর্টার বরিশাল থেকে জানান, প্রতিদিন বরিশাল লঞ্চ টার্মিনাল থেকে অভ্যন্তরীণ ১১টি রুটে প্রায় ৫০টি লঞ্চ যাতায়াত করলেও শনিবার সকাল থেকে নদী-বন্দর থেকে অভ্যন্তরীণ রুটের কোন লঞ্চ ছেড়ে যায়নি। অপরদিকে প্রতিদিন ঢাকা টার্মিনাল থেকে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার উদ্দেশে প্রায় ২৫টি লঞ্চ ছেড়ে আসে। একইভাবে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকার উদ্দেশে লঞ্চ ছেড়ে যায়। কর্মবিরতির কারণে লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় দুর্ভোগে পড়েছে নদী বেষ্টিত বরিশাল অঞ্চলের সাধারণ যাত্রীরা। বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন বরিশাল শাখা ও লঞ্চ লেবার এ্যাসোসিয়েশনের আওতাভুক্ত শ্রমিকরা পূর্বঘোষিত কর্মসূচীর অংশ হিসেবে বরিশাল নৌ-বন্দর থেকে সকল ধরনের নৌ-যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। একারণে বরিশাল বন্দর পল্টুন থেকে যাত্রীবাহী লঞ্চগুলো মাঝ নদীতে সরিয়ে নেয়া হয়। চাঁদপুর থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, ধর্মঘটে চাঁদপুর নৌবন্দর থেকে শনিবার সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত কোন লঞ্চ ছেড়ে যায়নি। দুপুর ১২টার পরে ৩টি লঞ্চ ঢাকা ও মুলাদির উদ্দেশে ছেড়ে যায়। আরো একটি লঞ্চ ছেড়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। দুপুরে চাঁদপুর লঞ্চঘাটে গিয়ে দেখা গেছে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে এমভি সোনারতরী-২ ও এমভি বোগদাদিয়া-৭। তবে যাত্রীর সংখ্যা অন্য দিনে তুলনায় অনেকটা কম। লঞ্চঘাটে পুলিশের ব্যাপক নিরাপত্তা রয়েছে। কোন শ্রমিককে ঘাটে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। চাঁদপুর বন্দরের দায়িত্বরত পরিদর্শক শাহ আলম জানান, সিডিউলের টাইম ছাড়াই সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ রুটের ৬টি চাঁদপুর ঘাটে এসেছে। নারায়ণগঞ্জ থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় লঞ্চ টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন ৭টি রুটে ৭০টি যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল করে থাকলেও শনিবার নৌ-যান শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে সকাল থেকেই গুটি কয়েক লঞ্চ চলাচল করতে দেখা যায়। এতে ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ যাত্রীরা। দীর্ঘ সময় ধরে লঞ্চের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে দূরপাল্লার অনেক যাত্রীকেই। পাশাপাশি হাতেগোনা দু’একটি বালুবাহী বাল্কহেড চলতে দেখা গেলেও অধিকাংশ বাল্কহেড ও তেলের ট্যাঙ্কারসহ সহস্রাধিক পণ্যবাহী নৌ-যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। ভৈরব থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, ধর্মঘটের কারণে বন্দর নগরী ভৈরব নদীবন্দরে অচল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ভৈরব ফেরিঘাট এলাকায় জাহাজ ধর্মঘটের কারণে জাহাজের মাল লোডিং আনলোডিংয়ের ওপর নির্ভর কয়েক হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে অলস সময় পার করছেন। বন্ধ রয়েছে কয়লা, সিমেন্ট ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে আসা জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের কাজ। নৌযান শ্রমিকরা জানিয়েছেন, তাদের ১১ দফা দাবি না মানা পর্যন্ত ধর্মঘট চলবে। ভৈরবের তিনটি জ্বালানি তেল ডিপো থেকে হাওড় অঞ্চলসহ ১৩টি জেলায় তেল সরবরাহ হয়। তেলবাহী জাহাজগুলো তেল খালাস না করে নদীর মাঝখানে নোঙ্গর করে আছে। ডিপোতে তেল সরবরাহ বন্ধ রেখেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, নৌযান চলাচল বন্ধের পাশাপাশি আশুগঞ্জ বন্দর থেকে হাওড় অঞ্চলের ৬টি নৌ রুটে যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। ধর্মঘটের কারণে আশুগঞ্জ নদী বন্দরে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে আটকা পড়েছে শতাধিক মালবাহী কার্গো জাহাজ। বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় বেকার হয়ে পড়েছে কয়েক শ’ শ্রমিক। যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় নৌপথে হাওড় অঞ্চলের কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জে যাতায়াতে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে। খুলনা থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, শনিবার শিল্প ও বন্দর নগরী খুলনার কোল ঘেঁষা ভৈরব নদের তীরে বিআইডব্লিউটিএর ৪, ৫, ৬ ঘাট এবং রুজভেল্ট জেটিতে অবস্থানরত কোন কার্গো জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করা হয়নি। এছাড়া খুলনা লঞ্চঘাট থেকে যে কয়টি রুটে লঞ্চ চলাচল করে তাও ছেড়ে যায়নি। একইভাবে বিপরীত দিক থেকে কোন লঞ্চ আসেনি। এমনকি মোংলা বন্দর থেকে যশোরের নওয়াপাড়া পর্যন্ত কোথাও কোন নৌযান চলেনি। ফলে এসব ঘাটে ছোট-বড় বহু নৌযান অবস্থান করছে পণ্য ওঠানামার জন্য। বরগুনা আমতলী থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, শনিবার আমতলী লঞ্চঘাট থেকে কোন লঞ্চ ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায়নি। এতে দুর্ভোগে পড়েছে আমতলী-তালতলী-কলাপাড়া উপজেলা ও পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটার সহস্রাধিক ঢাকামুখী যাত্রী। নিরুপায় হয়ে যাত্রীরা সড়কপথে পরিবহনে ঢাকা যাচ্ছেন। তাতেও পড়েছে তারা চরম দুর্ভোগে। অনেক যাত্রী ঢাকা না গিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। শনিবার বিকেলে চারটায় আমতলী লঞ্চঘাট ঘুরে দেখা গেছে, টার্মিনালে প্রিন্স অব হাসান-হোসেন-১ লঞ্চ নোঙ্গর করে আছে। যাত্রীরা ঘাটে এসে লঞ্চ না ছাড়ার খবর পেয়ে হতাশ হয়ে বিকল্প পথে ঢাকায় যাচ্ছেন। আবার অনেকে বাড়ি ফিরে গেছেন।
×