ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চারদিকে কুয়াশার ধোঁয়াশা ॥ উত্তরে সূর্যের দেখা মেলেনি

প্রকাশিত: ১১:১০, ২৬ নভেম্বর ২০১৯

চারদিকে কুয়াশার ধোঁয়াশা ॥ উত্তরে সূর্যের দেখা মেলেনি

তাহমিন হক ববী, নীলফামারী ॥ ধরণী হয়ে পড়ছে জড়সড়। শীত আসা মানেই শীতের সকালে কুয়াশার চাদরে ঢাকা জনপথ। শীতের তীব্রতা বাড়তি। দেখা যাচ্ছে কুয়াশা। শুধু সকালটা নয়। দুপুর গড়িয়ে বিকেল ও সন্ধ্যার আকাশটাও কুয়াশায় ঢেকে থাকছে। চারদিকে কুয়াশার ধোঁয়াশা। নীলফামারীসহ উত্তরের জনপদে সোমবার সূর্যের দেখা পাওয়া যায়নি এশটি বারের জন্যও। ঘড়ির কাঁটাই বলে দিয়েছিল দিনের এখন সকাল- দুপুর- বিকেল সন্ধ্যা। গাছের পাতা থেকে শিশির ঝরে পড়ার টুপটাপ শব্দ আর গ্রামীণ জীবনযাত্রায় কৃষক ছিল কুয়াশার মাঝে ফসলি জমিতে কাজের ব্যস্ততায়। চারদিকে কুয়াশার ধোঁয়াশায় কৃষক, কিষান , কিষানিদের ধান কাটা আর নতুন আলু জমি থেকে তুলতে দেখা যায়। তারই মাঝে গ্রামীণ জীবনে শীতের স্মৃতিময় অপরূপ হয়ে উঠে প্রকৃতিতে। আবহাওয়াই বলে দেয় আকাশেও কুয়াশা উড়ছে। তাই কুয়াশা ভেদ করে সকালের প্রথম সূর্যটা যেমন উঁকি দিতে পারেনি, তেমনিভাবে দিনভর যেন সূর্যমামাও বের হতে পারেনি মেঘ কুয়াশা ভেদ করে। যানবাহন চলেছে হেডলাইট জ্বালিয়ে। এখন বাংলা অগ্রহায়ণ মাস। নবান্ন ধারা বইছে গস্খামীণ জনপদে। উত্তর দিগন্তে হিমালয়ের বরফ চূড়া থেকে ছড়িয়ে পড়ছে শীতবুড়ির হিমশীতল নিশ্বাস। গ্রামের কৃষকরা সেই সকাল বেলা শীত উপেক্ষা করে ছোটে ফসলের মাঠের দিকে। বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে গেলেই তারা হারিয়ে যায় কুয়াশার মধ্যে, গাছিরা খেজুর গাছ থেকে পেড়ে আনে রসের হাঁড়ি। তারপর রস কাঁধে করে ছোটে বিকিকিনিতে। উত্তর জনপদে কুয়াশা ঝরছে। কুয়াশা হওয়ার বেশ কতগুলো কারণ আছে বলে মনে করেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। তাদের মতে, কোন কারণে বাতাসে জলীয় বা®েপর পরিমাণ বেড়ে গেলে, জলীয় বা®েপর সঙ্গে ধূলিকণা মিশলে, ধোঁয়া মিশলে, বা বায়ুম-লের তাপমাত্রার তারতম্য ঘটলে কুয়াশা ঘন হয়। এখন ধুম লেগেছে ধান কাটা, মাড়াই, উড়ানো ও শুকানো। গ্রামের প্রতিটি কৃষক পরিবার মহাব্যস্ত জমি হতে আমন ধান ও নতুন আলু তুলতে। কিষান-কিষানিরা নিজস্ব ভঙ্গিমায় বেশ ঘটা করেই যে যার মতো বরণ করছেন গ্রামীণ সংস্কৃতির অন্যতম রেওয়াজ নবান্ন উৎসবকে। নীলফামারীর রামনগর গ্রামের কৃষকবধূ জাহানারা বেগম বললেন বছরের এই শীত কুয়াশা আমাদের মনে অন্যরকম অনুভূতি নিয়ে আসে। নতুন ধান উঠে ঘরে। ধান সিদ্ধ করে শুকানো। এরপর যে যার মতো করে ধান থেকে চাল করি। তিনি বলেন, আমি ধান সিদ্ধ করে সামগাইনে চাল করি। এই চালের ভাত আমরা সকলেই খাই। আরেক কৃষকবধূ জানালেন আমনের ধান সিদ্ধ করে চাল করার আনন্দটাই আলাদা। কবিগুরুর লেখা কবিতায় এসেছে শরত, হিমের পরশ লেগেছে হাওয়ার পরে। সকাল বেলায় ঘাসের আগায় শিশিরের রেখা ধরে। শরতের শুরু থেকে হেমন্ত পর্যন্ত কুয়াশা আর শিশিরের সময় হলেও শীতকালেই কুয়াশা দেখা যায় সবচেয়ে বেশি। শীতের সকালে এক এক সময়ে তো কুয়াশার চাদর সরে সূর্যের দেখা মিলতে বেশ বেলা হয়ে যায়। কুয়াশা আসলে মেঘের মতোই। বাতাসে ভেসে থাকা সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম জলীয় বা®েপর কণা যখন রাতে ঠা-া হয়ে আসা মাটির কাছাকাছি এসে ঘনীভূত হয়ে ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি ভেসে বেড়ায়, তাকেই কুয়াশা বলি আমরা। এরপরেও কর্মব্যস্ত মানুষ ছোটে কাজে। বৃদ্ধ-শিশুরা সকালের রোদে গা পেতে দেয় পরম আনন্দে। শীতের তীব্রতায় বা শৈত্যপ্রবাহে আগুন জ্বেলে চারদিকে বসতে দেখা যায় কখনও কখনও। শীতের সকাল উপভোগ্য হয় পিঠা-পায়েসে। বিভিন্ন রকমের পিঠা তৈরি হয় শীতকে ঘিরে। রাতে পিঠাগুলো তৈরি করে খেজুর রসে ভিজিয়ে পরদিন সকালে পরিবেশন করার রেওয়াজ আছে গ্রামাঞ্চলে। হালকা রোদ গায়ে মেখে শীতের পিঠাপুলি আস্বাদন বহু বছরের পুরনো রীতি বা ঐতিহ্য। শহুরে জীবনে শীতের সকাল আমাদের প্রলুব্ধ না করলেও গ্রামীণ শীতের সকাল আমাদের কাছে স্মৃতিময় হয়ে ওঠে। সারাবছরের স্বাভাবিক পোশাকের চেয়ে ভারি পোশাক আমাদের জন্য অপরিহার্য হয় তখন। কিছু বাড়তি অনুষঙ্গ যুক্ত হয় শরীরের সঙ্গে। কেননা শহরের চেয়ে গ্রামের শীত যেন আগে আসে। ছয়টি ঋতুর মধ্যে তাই শীতকালটি উপভোগ্য হয়ে ওঠে। শাক-সবজিতে ভরে উঠে গ্রামের মাঠ কিংবা আঙ্গিনা। শুকনো এ ঋতুতে এ সময়টা শুকিয়ে আসে খাল বিলের পানি। কোথাও হাঁটু জল, কোথাও বা খটখটে চর জাগে। আর তাই গ্রামের দুরন্ত কিশোর-কিশোরীরা মেতে ওঠে অল্প পানিতে মাছ ধরার উৎসবে। সেইসঙ্গে খাবারের খোঁজে খাল-বিল আর মাঠে-ঘাটে ঝাঁকে ঝাঁকে নামে সাদা বকের ঝাঁক। ঝাঁকে ঝাঁকে সাদাফুলের মতো বসে থাকা বকের শুভ্রতা সেও এক অপরূপ দৃশ্য। গ্রাম ও শহরের হাঁট-বাজারগুলোতে সবজিপসারীর ডালায় ডালায় থরে থরে সাজানো শীতের সবজি ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলা, শালগম, ওলকপি, গাজর, টমেটো চোখ জুড়ায়, মন ভরায়। টুপামারী গ্রামের কৃষক সাদ্দাম হোসেন বলেন শীত কুয়াশায় কৃষিকাজেও আমেজ রয়েছে। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে শীতের সকালে বাড়ির আঙ্গিনাতেই ছোট-বড় সবাই খড়কুটা জ্বালিয়ে শরীর থেকে শীত তাড়াই। তবু শীতের সকালটা দুর্লভ এক মজার মতোই মনে হয় সবার কাছে। শীতের সকাল দাগ কেটে যায় প্রতিটি মানুষের বুকের মধ্যে। আবার অপেক্ষায় বছর গড়ায়, নানা সাজে সাজা শীতের এমন মধুর সকালের জন্য। স্মৃতিরা কখনও আনন্দের কখনও বেদনার। বেদনাময় স্মৃতিও মানুষের সহমর্মিতা বা সহযোগিতায় আনন্দময় হতে পারে। হতে পারে সবার জন্য মঙ্গলময়। তাই তো তীব্র শীতে মানবতার ডাকে দরিদ্রের পাশে দাঁড়ান বিত্তশালীরা। একই আঙ্গিনায় শীতের চাদরে জড়াজড়ি করে উপভোগ করেন সুখময় স্মৃতি।
×