ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. এম মনির উদ্দিন

বহুমুখী কৃষি উৎপাদনে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

প্রকাশিত: ১২:৫০, ২৪ নভেম্বর ২০১৯

বহুমুখী কৃষি উৎপাদনে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

বাংলাদেশের কৃষি বিষয়ে লিখতে গিয়ে মনে পড়ে গেল চীনা পরিব্রাজক উইলিয়াম জেনিংস ব্রায়ানের সেই অমর বাণী ‘তোমরা যদি তোমাদের দেশের শহরগুলোকে ধ্বংস করে খামারগুলোকে রক্ষা কর তাহলে তোমাদের শহরগুলো আবার মন্ত্রবৎ দাঁড়িয়ে উঠবে আর যদি খামারগুলোকে ধ্বংস করে শহরগুলোকে রক্ষা কর তাহলে তোমাদের শহরগুলোর রাস্তার ওপর দিয়ে ঘাস গজাবে।’ মানব সভ্যতার ভিত্তিই হলো কৃষি। চীন আজকে বিশ্বের অর্থনীতিতে এক উদীয়মান নক্ষত্র যার পেছনে রয়েছে তাদের ১৩৫ কোটি মানুষের খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। হাইব্রিড ধানের জনক চীনের বিজ্ঞানী ড. লং পিং ১৯৬৪ সালে হাইব্রিড রাইস নিয়ে কাজ শুরু করেন এবং ১৯৭৬ সালে চীনে হাইব্রিড রাইসকে বাণিজ্যিকীকরণ করা হয় যার ফলে আজকে চীন নিজ দেশের খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত চাল বাইরে রফতানি করছে। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ এবং প্রধান খাদ্যশস্য হচ্ছে ধান। আজকে বাংলাদেশের ধান চাষীদের বর্তমান অবস্থা, কেন ধান উৎপাদন অব্যাহত রাখা দরকার, ধান উৎপাদনের সঙ্গে ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহারের বর্তমান চিত্র, ধান চাষীদের উৎপাদন খরচ কমানোর উপায়, তেল ফসল বিশেষ করে সরিষার কাক্সিক্ষত ফলন না হওয়া, শস্য বহুমুখীকরণের অন্তরায় কোথায় এই বিষয়গুলো নিয়ে কিছু তথ্যমূলক আলোচনা করতে চাই। বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তম এক ব-দ্বীপ যার চারিপাশ ঘিরে রয়েছে নদ-নদী, খাল, বিল, হাওড়, বাঁওড়, পুকুর, দীঘি আর এই পানির আধিক্যের কারণেই এক সময় জমিতে সঠিকভাবে ফসল ফলানো যায়নি। অন্যদিকে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, শিলাবৃষ্টি প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল একটি নিয়মিত ব্যাপার। আর এ জন্য অনাহার, দুর্ভিক্ষ ছিল এ দেশের মানুষের নিত্যসঙ্গী। স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে এদেশের খাদ্য উৎপাদন ছিল মাত্র এক কোটি টন। এই খাদ্যের যোগান আসত রবি ফসল, স্থানীয় জাতের আউশ ও আমন ফসল থেকে। বন্যার কারণে কৃষক অধিকাংশ সময়ে আউশ ও আমন ফসল ঘরে তুলতে পারত না আবার খরার কারণেও ঘরে উঠত না নতুন ফসল। কালের আবর্তে পুরো প্রকৃতিনির্ভর এই কৃষিতে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আসে ব্যাপক পরিবর্তন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশে শুরু হয় সবুজ বিপ্লবের। দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) এবং আবিষ্কৃত হতে থাকে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন উচ্চফলনশীল ধানের জাত। উৎপাদিত হতে থাকে মাঠভরা ফসলের আর এভাবেই দেশ এগোতে থাকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতায়। বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের দক্ষ ব্যবস্থাপনায় দেশ আজ শুধু খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণই নয় বরং খাদ্যে উদ্বৃত্ত এক নতুন বাংলাদেশ। কিন্তু যাদের শরীরের ঘাম ঝরা পরিশ্রমে আজকে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতি কেমন আছেন আমাদের সেই সহজ-সরল খেটেখাওয়া প্রান্তিক ধান চাষীরা? উত্তরটি আমরা অনেকেই জানি। যারা এক মণ ধান উৎপাদন করতে খরচ করছেন ৭২০ থেকে ৭৫০ টাকা আর ধান কাটার শ্রমিক মজুরি পরিশোধ করার জন্য এক মণ ধান বিক্রয় করছেন ৫০০ টাকায়। বছরের পর বছর এভাবে যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, অক্লান্ত পরিশ্রম করেও লোকসান গুনছেন কেমন থাকতে পারেন সেই অভাগা কৃষককুল? ডব্লিউ জে ব্রায়ানের সেই অমর বাণী যদি আমরা একটু পর্যালোচনা করি তাহলে সহজেই বোঝা যাবে আমরা কোনদিকে এগিয়ে যাচ্ছি? আমরা মেট্রো-রেল, পাতাল রেল, উড়াল রাস্তা, পাতাল রাস্তা, ভবন, প্রাসাদ, রাস্তাঘাট যতই সুসজ্জিত করি না কেন সব ব্যর্থ হবে যদি এদেশের সেই ভগ্ন স্বাস্থ্যের পরিশ্রমী কৃষককুলকে বাঁচাতে না পারি। ধানের চাষ কেন অব্যাহত রাখা দরকার? আমাদের অনেকেই একটি সহজ পন্থা বাতলিয়ে থাকেন যে, দেশে ধান চাষ কমিয়ে দিয়ে অন্য ফসল চাষ করলেই ধানের দাম বেড়ে যাবে এবং কৃষক ভাল থাকবে। যারা এ রকম একটি সহজ হিসাব করেন তাদের অনুরোধ করব ২০০৮ সালের দিকে তাকাতে যখন বিশ্বে মাত্র ১২ সপ্তাহের খাদ্য মজুদ ছিল যদিও আমরা তেমন সমস্যায় ছিলাম না। তারপরও ২০০৭ সালের সিডরের কবলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। সে সময় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জী বাংলাদেশকে ৫ লাখ টন চাল খাদ্য সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা সময়মতো দিতে পারেননি বরং ভারত সে সময় নিজেদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অতিরিক্ত ৩০ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। অন্যদিকে এশিয়ার চাল রফতানিকারক দেশগুলো সে সময় হঠাৎ করে চাল রফতানি স্থগিত করে অর্থাৎ প্রেক্ষাপট এমন অবস্থায় দাঁড়ায় যে, ব্যাংক ভর্তি টাকা থাকলেও চাল পাওয়া সম্ভব ছিল না। ভৌগোলিক অবস্থাগত কারণে আমরা এমনিতেই বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়ে থাকি, সেইসঙ্গে যুক্ত হয়েছে বৈশ্বিক জলবায়ুগত পরিবর্তনের প্রভাব যেখানে আমরা ৬ নম্বর ভুক্তভোগী। ১৯৭৩ সালে দেশে লবণাক্ত জমির পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর সেখানে আজ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০ লাখ হেক্টরে। আইপিসিসির ২০০৭ রিপোর্ট অনুযায়ী ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে ১ মিটার এবং এর কারণে ২৫ মিলিয়ন মানুষ হারাবে বাসস্থান। ব্রিটিশ সাংবাদিক জোহান হ্যারি আইপিসিসি রিপোর্ট দেখে বাংলাদেশ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন এভাবে ‘বাংলাদেশ ১৯৭১ থেকে ২০৭১- রক্তে জন্ম আর পানিতে মরণ।’ এই যখন আমাদের অবস্থা, তখন বোরো বা আমন যে কোন একটি ফসল যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে আংশিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে বস্তাভর্তি টাকা নিয়ে ঘুরেও কোটি কোটি মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য পাওয়া যাবে না। কারণ আমরা জানি আগামী দিনে প্রতিটি দেশেই জলবায়ুগত পরিবর্তনের হাওয়া লাগবে এবং তাদেরও ফলন কমে যাবে ফলে প্রতিটি দেশই তাদের নিজস্ব খাদ্য নিরাপত্তার বেষ্টনী নিরাপদ রাখার ক্ষেত্রে সচেষ্ট হবে। কাজেই আগামী দিনের জন্য স্থায়ী খাদ্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা আমাদেরই করতে হবে এবং অবশ্যই অব্যাহত রাখতে হবে প্রধান খাদ্যশস্য ধানের উৎপাদনের বর্তমান ধারাকে। ধান উৎপাদনের সঙ্গে ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহারের বর্তমান চিত্র কি? বাংলাদেশের কৃষির এই ব্যাপক উন্নয়নের পেছনে যে শক্তি বা সম্পদের অবদান রয়েছে তা হলো এই ভূ-গর্ভস্থ পানি। কিন্তু বিগত চার দশকে মাটির নিচ থেকে কৃষি ও পারিবারিক প্রয়োজনে যে পরিমাণ পানি উত্তোলন করা হয়েছে তাতে পানির এই সম্পদ ইতোমধ্যে তার স্বল্পতার জানান দিয়েছে। কাজেই আমাদের একদিকে যেমন সেচের পানির অপচয় হচ্ছে অন্যদিকে মাত্রাতিরিক্ত ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে পানির স্তর দ্রুত নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অগভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। দেশের উত্তরাঞ্চলে বিশেষ করে যে সমস্ত অগভীর নলকূপে পানি পাওয়া যাচ্ছে না সেখানে সেচের জন্য গভীর নলকূপ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিচ্ছে। বর্তমান বাজারে ২০ হাজার টাকার মধ্যে একটি অগভীর নলকূপ স্থাপন করা যায় অথচ একটি গভীর নলকূপ স্থাপনের জন্য দরকার ৬-৭ লাখ টাকা যা কৃষকের জন্য অসম্ভব। গবেষণায় দেখা যায় যে, শুধু বোরো মৌসুমে অপরিকল্পিত সেচের কারণে দেশে প্রতি বছর ৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। সচেতনতার অভাবে কৃষকেরা প্রয়োজনর তুলনায় অতিরিক্ত সেচ দিচ্ছে। এতে জমিতে প্রয়োগ করা ফসলের জন্য সারও পানিতে ধুয়ে নিচের দিকে চলে যাচ্ছে যা গাছ গ্রহন করতে পারছে না। বিএডিসির গবেষণা থেকে জানা যায় যে, বোরো মৌসুমে এক একর জমিতে অতিরিক্ত সেচ দেয়া বাবদ খরচ হয় দেড় হাজার টাকা। সারের অপচয় হয় ৮০০ টাকা আর ফসল উৎপাদনে ক্ষতি হয় ১০ হাজার ৮০০ টাকার। এই হিসাবে শুধু অতিরিক্ত সেচ দেয়ার কারণে এক মৌসুমে এক একর জমিতে ধান চাষ করতে গিয়ে কৃষকের মোট ক্ষতি হচ্ছে ১৩ হাজার ১০০ টাকা। উপরের হিসাব থেকে পরিষ্কারভাবে বলা যায় যে, পরিমিত সেচ দেয়ার মাধ্যমে আমরা আমাদের জমি থেকে কম নয় বরং অধিক ফসল উৎপাদন করতে পারি। উপরের আলোচনা থেকে বলা যায়, দেশের কৃষির টেকসই উন্নয়নে পানির অবদান অপরিসীম। দেশে জনসংখ্যা বৃদ্বির হার ১ দশমিক ২ এবং এভাবে বাড়তে থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ জনসংখ্যা হবে প্রায় ১৯ কোটি যার জন্য খাদ্যের (চাল) প্রয়োজন হবে ৪ দশমিক ৫ কোটি টনের। বর্তমান সরকার দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ রাখতে বদ্ধপরিকর। সরকারের এই চ্যালেঞ্জকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে উৎপাদন বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই। আর উৎপাদন বাড়াতে হলে প্রয়োজন হবে সেচের পানির তথা ভূ-গর্ভস্থ পানি সম্পদের যথাযথ ব্যবহার। আমরা আশা করবো বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার দেশের সেচ ব্যবস্থার আধুনিকায়নের মাধ্যমে দেশের খাদ্য উৎপাদনকারী কৃষককুলকে সরাসরি ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহারের সুযোগ করে দেবে যার মাধ্যমে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমে আসবে, বোরো ও আমন ধানের ফলন বাড়বে, ভূ-গর্ভস্থ পানির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত হবে, তেল ফসলের উৎপাদন বাড়বে, শস্য-বহুমুখীকরণের সুযোগ বাড়বে এবং সর্বোপরি কৃষকের আর্থিক সচ্ছলতা বাড়বে।
×