ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মরণ;###;নাজনীন বেগম

সুফিয়া কামাল জননী সাহসিকা

প্রকাশিত: ০৯:২৭, ২২ নভেম্বর ২০১৯

সুফিয়া কামাল জননী সাহসিকা

১৯১১ সালের ২০ জুন জন্ম নেয়া বেগম সুফিয়া কামালের দীর্ঘ জীবনের সূচনা লগ্নটাই ছিল উপনিবেশিক ভারতের উত্তাল সময়ের এক বিক্ষুব্ধ আবহে। সঙ্গত কারণেই অতি শৈশবকাল থেকে নিজেকে তৈরি করেছেন আত্মপরিচয়ের তীক্ষè অনুসন্ধানের এক বিরল আসনে। বরিশালে মাতুলালয়ে জন্ম নেয়া এই লড়াকু মানবিক ব্যক্তিত্ব জীবনকে চিনেছেন পরাধীন দেশের মুক্তির আবহ তৈরি হওয়ার এক অনন্য বোধে। স্বাধীনচেতা এই ব্যক্তিত্ব মাত্র সাত বছর বয়সে পিতার নিরুদ্দেশ হওয়ার দুঃসময় থেকে মাতৃস্নেহে নিজেকে একজন সচেতন মানুষ হিসেবে ভাবতে পেরেছেন সেটা যেমন বিস্ময়কর একইভাবে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের সংগ্রামী অভিযাত্রার সাহসী যোদ্ধার ভূমিকায়ও। উর্দুভাষী এক রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়ে স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্য আর দীপ্ত মহিমায় সব অপসংস্কারকে অতিক্রম করতে তাকে কখনও পেছনে তাকাতে হয়নি। সময়টা ছিল এক দুরন্ত, দুর্বার গতিবেগের এক দুঃসাহসিক লড়াকু অভিগমন। বাংলা সাহিত্যে চলছে তখন রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের অনবদ্য শিল্প সম্ভারের এক সুবর্ণ কাল পর্ব। সঙ্গে সুভাষ বসুর মতো স্বদেশী আন্দোলনের বিপ্লবী নায়কের দেশ প্রেমের অনবদ্য দ্যুতিময় জীবন প্রবাহ। ফলে উদীয়মান কিশোরী সুফিয়া কামাল সমকালীন ঐশ্বর্য আত্মস্থ করতে একদিকে যেমন তার শৈল্পিক সুষমাকে সাংস্কৃতিক বলয়ে ঋদ্ধ করেছেন পাশাপাশি দেশাত্ববোধের অকৃত্রিম চেতনায় নিজেকে জাগিয়ে তুলতেও খুব বেশি দেরি করেননি। ফলে সাহিত্যিক জগতের দ্বার যেমন অবারিত হয়েছে একইভাবে দেশের আন্দোলন সংগ্রামকে প্রতিদিনের যাপিত জীবনের অনুষঙ্গ করতে মোটেও ভাবতে হয়নি। সুফিয়া কামালের ‘সাঁঝের মায়া’ পড়ে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম বিস্ময়ে মুগ্ধে অভিভূত হয়েছিলেন। অল্প বয়সী কোন বাঙালী মেয়ে এমন শিল্পমানসম্মত যথার্থ কবিতা লিখতে পারে সেটাই নজরুলকে হতবাক করে দেয়। সেই যে শুরু করলেন এই বলিষ্ঠ যুগের অগ্রগামী লেখক জীবনের শেষ অবধি সেটাই বাংলা ও বাঙালীর সাহিত্য ভা-ারকে পূর্ণ করতে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখে। তৎকালীন অভিজাত শ্রেণীর ভাষা ছিল উর্দু। তেমন পারিবারিক আবহে জন্ম নিয়েও বাংলা ভাষার প্রতি ছিল অত্যন্ত দরদ। সেটা একেবারে আবল্য। সেই উত্তাল সময়ে শুধু ব্রিটিশমুক্ত ভারত তৈরির মহাপরিকল্পনাই নয় তার চেয়ে বেশি অন্ধকারে নিমজ্জিত নারী জাতির শৃঙ্খলিত জীবনের এক তমাসাচ্ছন্ন অধ্যায়ও। সব মানুষের মুক্তির কথা ভাবতে গিয়ে অর্ধাংশ এই অবহেলিত গোষ্ঠীর প্রতিও সচেতন দায়বদ্ধতায় নিজের বলিষ্ঠ ভূমিকাকে যুগ আর সময়ের স্রোতে একাত্ম করে নেন। তবে শুধু যে নারী মুক্তির দিশারি ছিলেন তা কিন্তু একেবারেই নয় মানুষ হিসেবে জনগোষ্ঠীর জীবন মান উন্নয়নে সব কিছু করতে দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন। যা তার দীর্ঘ জীবনের বহু ঘটনা পরম্পরা নজির হিসেবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে হাজির হচ্ছে। সান্নিধ্য পেয়েছেন বহুগুণী ব্যক্তিত্বের। প্রাণিত হয়েছেন মানুষ আর মানবতার কল্যাণে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে সমর্পণ করতে। কখনও কলম যোদ্ধা হিসেবে বাকিটা পথে প্রান্তরে সংগ্রাম আর আন্দোলনে নিজের অংশীদারিত্ব জানান দিয়ে। রাজনৈতিক সচেতন এই বলিষ্ঠ অগ্রনায়ক উপনিবেশিক ভারত থেকে শুরু করা স্বাধীনতা সংগ্রাম, ’৪৭-এর দেশ বিভাগের অনাকাক্সিক্ষত পরিবেশে ভাষা আন্দোলনের মতো ঐতিহ্যিক আত্মপরিচয়ের ঠিকানাই শুধু নয় ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন সব কিছুতে এই লড়াকু সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তার অভিগামিতাকে অবারিত করেছেন। রবীন্দ্র অনুরাগী এই প্রতিভাদীপ্ত কবি ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবর্ষ আয়োজনের পরিবর্তে তৎকালীন পাকিস্তানী সরকার বিশ্বকবিকে বর্জনের যে পাঁয়তারা শুরু করে সেখানে অন্য অনেকের সঙ্গে সুফিয়া কামালের দীপ্ত অঙ্গীকার সেই দুঃসময়ের এক অনবদ্য অভিগমন। সত্যিই অবাক লাগে এক মুসলিম বাঙালী নারী কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পেয়েও নিজেকে যেভাবে জ্ঞানে, মননে এবং সৃজনে অবিস্মরণীয় করে তুলেছেন তেমন নজির তো কোন কিছুর সঙ্গে তুলনা চলে না। রবীন্দ্র শতবর্ষ উদযাপন আন্দোলনের অবধারিত পরিণতিতে ছায়ানটের মতো অসাম্প্রদায়িক, সাংস্কৃতিক বলয় তৈরি হওয়া সেও যেন এক অভাবনীয় ঐশ্বর্য। আর এমন ঐতিহ্যিক পথ পরিক্রমায় বেগম সুফিয়া কামালের অগ্রণী ভূমিকা আজও শ্রদ্ধার উদ্রেক করে। নতুন সময়ের যৌক্তিক চাহিদায় সমাজ-সংস্কারের যে অভাবনীয় পথযাত্রা সেখানে এই মহান শিল্পী বারবার নিজেকে কা-ারী ভূমিকায় প্রমাণ করেছেন। পুরস্কারও পেয়েছেন অনেক তার নিবেদিত সাহিত্য সাধনার দুর্লভ সৃজন সম্ভাবের জন্য। তবে সবচাইতে বড় সম্মাননা পেয়েছেন মানুষের হৃদয়নিঃসৃহ ভালবাসার স্রোতে। যার দাম কোন কিছুর বিনিময়ে হয় না। শিশু-কিশোরদের অনুপ্রাণিত করার এই মহান শিল্পী ‘কচি কাঁচার মেলা’ তৈরিতেও বিশেষ প্রতিষ্ঠাতার ভূমিকা পালন করে যান। শুধু তাই নয় মানব মুক্তির বিশেষ দর্শন হিসেবে নারী স্বাধীনতা ও অধিকার অর্জনকে গুরুত্ব দিয়ে অর্ধাংশ এই গোষ্ঠীর প্রতি তার মানবিক দায়বদ্ধতাকে সবার সামনে নিয়ে আসতে মহিলা পরিষদের ভিত্তি তৈরিও তার অভাবনীয় কর্মযোগ। সেই লক্ষ্যে জীবনভর নির্বিত্ত, নির্যাতিত, পশ্চাদপদ, অসহায় এই নারী জাতিকে সার্বক্ষণিক অনুপ্রেরণায় তাদের যৌক্তিক দাবিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে যা যা করণীয় সবটাই করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তার সময়োপযোগী দায়িত্ববোধ অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামীকে সাহায্য-সহযোগিতা করতে পাক বাহিনীর রক্তচক্ষুকেও আমলে নেননি। এমন দুঃসাহসিক জননেত্রী গণমানুষের অতন্দ্রপ্রহরীর ভূমিকায় নিজেকে সম্পূর্ণভাবে উজাড় করে দিতে সর্বদা প্রস্তুত থাকতেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক এই বলিষ্ঠ মুক্তিকামী সৃজন ব্যক্তিত্ব উগ্রবাদ, মৌলবাদ এবং অপসংস্কারকে একেবারে মূল শিকড় থেকে উৎপাটনের পক্ষপাতী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে লাঞ্ছিত নারীরাও তার সযতœ পরশে, গভীর মমতায় সিক্ত হতেন। ’৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পক্ষে আন্দোলনের যে ধারা তৎকালীন সময়ে চলমান ছিল সেখানেও সুফিয়া কামালের সচেতন অভিভ্যক্তি সাধারণ নির্যাতিত মানুষের পক্ষেই দাঁড়িয়েছিল। ‘মানুষ মানুষের’ এমন বার্তার যথার্থ উদাহরণ বেগম সুফিয়া কামাল। যিনি আমাদের প্রতিদিনের চেতনা, সার্বক্ষণিক প্রেরণা আর দেশ ও মানবতার যথার্থ সূচক। এমন এক ব্যক্তিত্বের জন্মদিন স্মরণের চাইতে তাকে যদি দেশ মাতৃকার মঙ্গলের প্রতিটি সূচকে নিয়তই চর্চা করা হয় তাহলে সেটাই সব থেকে বেশি তার জন্য শুভেচ্ছা এবং উপহার হিসেবে গণ্য হবে। যার সৃজনে আর মননে অনুক্ষণ মানুষ আর মানবতা তিনি সব সময় বেঁচে থাকবেন সবার মাঝখানে। ২০ নবেম্বর এ মহিয়সী নারী মৃত্যুবরণ করেন।
×