ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

১১ কোম্পানি ৪শ’ কোটি টাকা নিয়ে উধাও ॥ শেয়ার মার্কেটে আস্থার সঙ্কট

প্রকাশিত: ১১:১৯, ১৩ অক্টোবর ২০১৯

১১ কোম্পানি ৪শ’ কোটি টাকা নিয়ে উধাও ॥ শেয়ার মার্কেটে আস্থার সঙ্কট

অপূর্ব কুমার ॥ শেয়ারবাজারের ১১ কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের প্রায় চার শ’ কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে। শেয়ারবাজার থেকে তালিকাচ্যুত হয়ে ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) মার্কেটে থাকা এসব কোম্পানির অস্তিত্বই এখন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এসব কোম্পানির বিনিয়োগকারীরা এখন নিঃস্ব হয়ে গেছেন। তাদের টাকা উদ্ধারের কোন তৎপরতা নেই। বাধ্য হয়ে অনেকেই হাল ছেড়ে দিয়েছেন। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওটিসি মার্কেটে ৬৫ কোম্পানি তালিকাভুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে ৩২ কোম্পানি পুঁজিবাজারের বিদ্যমান আইন কিছুটা অনুসরণ করলেও বাকিরা আইনের তোয়াক্কা করছে না। এর মধ্যে ২২ কোম্পানি নামমাত্র অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। কয়েকটি কোম্পানি প্রতিবছর লভ্যাংশ ঘোষণা করছে। কিন্তু অন্য ১১ কোম্পানির বর্তমানে কোন অস্তিত্ব নেই। বিনিয়োগকারীদের টাকা নিয়ে উধাও হওয়া ওটিসি মার্কেটের অস্তিত্বহীন এই ১১ কোম্পানি হলো- বাংলাদেশ ইলেক্ট্র্রিসিটি মিটার কোম্পানি (বেমকো), চিক টেক্সটাইল, রাসপিট ডাটা, রাসপিট ইনকর্পোরেশন, এম হোসেন গার্মেন্টস, ফার্মাকো, আমান সি ফুড, জার্মান বাংলা ফুড, মেটালিক্স, রাঙামাটি ফুড ও সালেহ কার্পেট। এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগকারীদের প্রায় চার কোটি ৮৭ লাখ শেয়ার রয়েছে, যার বাজারমূল্য ৪শ’ কোটি টাকার বেশি। নির্দিষ্ট ঠিকানায় গিয়ে এসব কোম্পানির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। ওসব ঠিকানায় কোথাও আবাসিক বাসা, কোথাও মুদি দোকান, আবার কোথাও বেসরকারী ক্লিনিক বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠান পাওয়া গেছে। সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (ওভার দ্য কাউন্টার) বিধিমালা ২০০১ অনুযায়ী ২০০৯ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বিএসইসির আদেশ নং এসইসি/ সিএমআরআরসিডি/ ২০১১-১৬ অনুসারে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেডকে কোম্পানির শেয়ার লেনদেনের জন্য ওভার দ্য কাউন্টার সুযোগ দেয়। ২০০৯ সালের ১ অক্টোবরে প্রাথমিক পর্যায়ে ৫১ কোম্পানি নিয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে ওটিসি মার্কেট যাত্রা শুরু করে। ৫১ কোম্পানির মধ্যে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড ’১০ সালের ১৩ জুন ‘জেড’ ক্যাটাগরির অধীনে মূল বাজারে ফিরে আসে। এরপর আরও ২৯ কোম্পানিকে বিদ্যমান ওটিসি মার্কেটে পাঠানো হয়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই শর্ত পূরণ করায় দশটি কোম্পানিকে আবার মূল মার্কেটে ফেরার অনুমোদন দেয় বিএসইসি। জিএমজি ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল কর্পোরেশন লিমিটেড নামে একটি কোম্পানির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওটিসি মার্কেট থেকে ’১১ সালের ২০ জুন তালিকাচ্যুত করা হয়। এরপর ’১৪ সালের ৩০ এপ্রিল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালনা পর্ষদ পদ্মা সিমেন্ট লিমিটেডকে তালিকাচ্যুত করে। একই বছরের ১৪ মে ওয়াটার কেমিক্যালস লিমিটেডের শেয়ার ওটিসি মার্কেট থেকে মূল মার্কেটে যাওয়ার আবেদন অনুমোদন করে ডিএসই। সর্বশেষ ’১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকে ওটিসি মার্কেট থেকে মূল মার্কেটে যাওয়ার আবেদন অনুমোদন করে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালনা পর্ষদ। ওটিসিতে থাকাকালীন এটি সজিব নিটওয়্যার নামে পরিচিত ছিল। এ অবস্থায় বর্তমানে ওটিসি মার্কেটে সর্বমোট ৬৫ কোম্পানি রয়েছে। জানা গেছে, মূলত উৎপাদন বন্ধ থাকা, অব্যাহত লোকসানে থাকা, লভ্যাংশ দিতে ব্যর্থ হওয়া, বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) না করায় বিভিন্ন সময় এসব কোম্পানিকে ওটিসি মার্কেটে পাঠানো হয়েছিল। এদের মধ্যে কয়েকটি কোম্পানি তাদের ব্যর্থতা কাটিয়ে মূল মার্কেটে ফিরে গেলেও, অন্যদের এ নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই। এদের মধ্যে ওটিসি মার্কেটে স্থানান্তরিত হওয়ার পর ২৫ কোম্পানির কোন লেনদেনই হয়নি। আর বর্তমানে ১১ কোম্পানি তো উধাও হয়ে গেছে। সম্প্রতি সরেজমিনে ওটিসি মার্কেটের কয়েকটি কোম্পানির ঠিকানায় গিয়ে তাদের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। ডিএসইর ওয়েবসাইটে কোম্পানি প্রোফাইলে ‘ফার্মাকো’র ঠিকানা দেয়া আছে ৫০/১ পুরানা পল্টন লেন, ঢাকা। সেখানে গিয়ে ফার্মাকোর অফিসের কোন অস্তিত্ব মেলেনি। সেখানকার নিরাপত্তাকর্মী জানান, এই ভবনে কোন অফিস নেই। একইভাবে ওটিসি মার্কেটের রাসপিট ডাটা ও রাসপিট ইনকর্পোরেশনের ঠিকানা অনুযায়ী রাজধানীর গ্রীন রোডে এ কে কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে এখন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চেম্বার। ১০ বছর ধরে এখানে এই নামে কোন কোম্পানি দেখেননি বলে জানান ভবনের তত্ত্বাবধায়ক। ওটিসি বাজারের আরেক কোম্পানি এম হোসেন গার্মেন্টসের ঠিকানা দেয়া আছে বনানীর কে-ব্লকের ২৭ নম্বর রোডের ২ নম্বর বাসার তিনতলা। ওই ঠিকানায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে অন্য একটি কোম্পানির অফিস। তাদের এক কর্মকর্তা জানান, তারা ২০০৭ সাল থেকে এখানে অফিস নিয়েছেন। এর আগে এম হোসেন গার্মেন্টস নামে কোন কোম্পানি ছিল কি না, তা জানেন না। বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন, কোন কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অর্থ তোলার সুযোগ দেয় বিএসইসি। তারা কোম্পানির সবকিছু দেখে বিবেচনা করেই এই অনুমোদন দেয়। তাই কোন কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের অর্থ আত্মসাত করতে চাইলে সেটা বিএসইসিকেই ঠেকাতে হবে। এর দায়ভার বিএসইসি কোনভাবেই এড়াতে পারে না। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরেই দেশের পুঁজিবাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। আস্থার সঙ্কটে বাজার একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এ অবস্থায় কোন কোম্পানি যদি বিনিয়োগকারীদের টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়, তাহলে বাজারে আরও বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তারা বলছেন, এমনিতেই ওটিসি মার্কেটের শেয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। এখানে তাদের কোটি কোটি টাকা আটকে রয়েছে। অথচ বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরতের জন্য কোন উদ্যোগ নিতে কর্তৃপক্ষকে দেখা যাচ্ছে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএসইর এক পরিচালক এ বিষয়ে বলেন, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ওটিসি মার্কেটের ধারণাটাই সঠিক হয়নি। কোন কোম্পানি খারাপ করলেই তাকে শাস্তি হিসেবে ওটিসি মার্কেটে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এতে তারা আরও বেশি হাল ছেড়ে দেয়। ফলে কোম্পানির উদ্যোক্তা/ পরিচালকরা আর্থিকভাবে সেই অর্থে ক্ষতির মুখে তেমন পড়ে না। আর্থিক ক্ষতির পুরো দায় এসে পড়ে বিনিয়োগকারীদের ওপর। এ অবস্থার পরিবর্তনে বিএসইসিকে নতুন করে ভাবতে হবে। বিএসইসির এক নির্বাহী পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিনিয়োগকারীদের দেখে-শুনে-বুঝে বিনিয়োগ করতে হবে। যদি কোন কোম্পানি মুনাফা করতে না পারে তবে কোম্পানি আইন অনুযায়ী শেয়ারহোল্ডাররাই কোম্পানি অবলুপ্ত করতে পারে। এখানে বিএসইসির কিছু করার নেই। এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ওটিসি মার্কেটে স্থানান্তরিত কোম্পানি থেকে বিনিয়োগকারীদের অর্থ আদায়ের জন্য সংশ্লিষ্টদের উচিত কার্যকর উদ্যোগ নেয়া। অর্থ আদায়ের ব্যবস্থা করতে না পারলে কমপক্ষে আইনী ব্যবস্থা নেয়া। এটা যদি করা না হয় তাহলে কেবল বিনিয়োগকারীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, সার্বিকভাবে শেয়ারবাজারের জন্যও শুভ হবে না।
×