ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ সাখাওয়াত হোসেন

জঙ্গীবাদ দমনে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ এবং করণীয়

প্রকাশিত: ০৯:১৯, ৬ অক্টোবর ২০১৯

 জঙ্গীবাদ দমনে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ এবং করণীয়

জঙ্গীবাদ একটি মানবসৃষ্ট সামাজিক সমস্যা কিন্তু বর্তমানে জঙ্গীবাদ বিষয়টি একটি বৈশ্বিক প্রপঞ্চ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈশ্বিক রাজনীতি এবং গ্লোবালাইজেশনের যুগে আধুনিকতার বিষবাষ্পে বাংলাদেশও উগ্রবাদী জঙ্গীবাদের শিকার। এছাড়া বাংলাদেশ গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল এবং গোল্ডেন ক্রিসেন্টের সীমারেখায় অবস্থান করায় জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদ, মানব/মাদক/অস্ত্র পাচার ও অন্যান্য সহিংস অপরাধের ঝুঁকির মধ্যে অবস্থান করে। তাই বাংলাদেশকে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার নিমিত্তে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গীবাদের রাজনীতি এবং তৎসাপেক্ষে হুমকি থেকে উত্তরণের জন্য সার্বিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইমের মতানুযায়ী সন্ত্রাসবাদ একটি সামাজিক ফ্যাক্ট এবং এটি সমাজের প্রচলিত ভাবমূর্তির সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত। অপরাধবিজ্ঞানী বেকারের মতে, অপরাধ হিসেবে সন্ত্রাসবাদ ইতোমধ্যে লেবেলিং হয়ে গেছে। অন্যদিকে, জঙ্গীবাদ হচ্ছে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও পার্টির দ্বারা সংঘটিত যে কোন ধরনের সহিংস আচরণ এবং যার মদদদাতা/যোগানদাতা হিসেবে ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক মতাদর্শ গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে কাজ করে থাকে। তাত্ত্বিক হলের মতে, জঙ্গীবাদী নামক সামাজিক আন্দোলনের তিনটি সাধারণ উপাদান থাকে-উদ্দেশ্য, সমমনা/মতাদর্শ মানুষদের টিম এবং তাদের সমন্বিত উদ্যোগ। তিনটি উপাদানের সমন্বিত প্রয়াসেই জঙ্গীবাদের মতো ভয়াবহ ও নাশকতামূলক কর্মকা- ঘটে থাকে বাংলাদেশে। কাজেই, জঙ্গীবাদ দমনের জন্য বাংলাদেশকে নানামুখী প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে এবং স্থায়ী ভিত্তিতে চ্যালেঞ্জ উত্তরণের জন্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে স্থায়িত্বশীল পদক্ষেপ নিতে হবে। সাধারণ যে কোন অপরাধের চেয়ে জঙ্গীবাদ মারাত্মক আকার ধারণ করে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ অপরাধটি সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে ঘটে থাকে। জঙ্গীবাদের কারণে যে মানুষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা এ অপরাধ সংঘটনের টার্গেট হিসেবে থাকে না, মূল টার্গেট থাকে ভিন্ন। ধরা যাক, আদালত প্রাঙ্গণে বোমা হামলা করার ফলে সাধারণ মানুষ হতাহতের শিকার হলো, কিন্তু জঙ্গীদের মূল টার্গেট ছিল সরকারকে তাদের নিজস্ব শক্তি সম্বন্ধে জানান দেয়া এবং যে কোন মূল্যে তারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে চায় এ রকম একটি বার্তা প্রদান করা। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয় ক্ষমতার বাইরে থাকা নিরীহ মানুষগুলো। শুধু বাংলাদেশে নয়, বহির্বিশ্বে সংঘটিত জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মূল্যায়ন করলে এমন চিত্রই ফুটে ওঠে। সন্ত্রাসবাদ এবং জঙ্গীবাদ প্রত্যয়টি একে অপরের পরিপূরক হলেও জঙ্গীবাদের তেমন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞায়ন নেই। ধর্মীয়, রাজনৈতিক, মতাদর্শগত, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কারণে যে কোন ব্যক্তি, গ্রুপ বা দল কর্তৃক সংঘটিত সহিংস কার্যাদিকে জঙ্গীবাদ বলে। পঞ্চদশ দশকের শুরুতে জঙ্গীবাদ প্রত্যয়টি আলোচনায় আসে এবং এর অর্থ হিসেবে প্রতিপাদ্য হয় সৈন্যের মতো দায়িত্ব পালন করা। স্বাভাবিকভাবে প্রচলিত এবং প্রতিষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী/সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় মতাদর্শের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম অথবা দেশবিরোধী কাজে অংশগ্রহণ করার নামই জঙ্গীবাদ। তাত্ত্বিক ফ্রেলিক এবং অন্যদের মতে, জঙ্গীবাদী আন্দোলনের পাঁচটি কৌশল রয়েছে যার ওপর ভিত্তি করে ধ্বংসাত্মক কাজগুলো পরিচালিত হয়ে থাকে। সেগুলো হলো: মতাদর্শ, অনুপ্রেরণা, তত্ত্বাবধান, সংস্থা এবং যৌক্তিকতা। এখানে যৌক্তিকতা বলতে ভুল পদ্ধতি ব্যবহার করে অস্থিমজ্জায় বেপরোয়া চিন্তাকে প্রস্ফুটিত করাকে বুঝানো হয়েছে। এসব বিষয়ের সমন্বয়ের মাধ্যমেই জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটে থাকে বিশ্বব্যাপী। একজন জঙ্গী সব সময়েই উগ্রবাদী চিন্তাকে লালন করে থাকে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে দেখা যায়, কতিপয় ধর্মীয় রাজনৈতিক সংস্থা বা দলগুলো উগ্রবাদী মানসিকতা ধারণ করে, তারা প্রচলিত রাজনীতির বিরুদ্ধাচরণ করে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে চলমান রাজনীতির গতিধারাকে নিজেদের উদ্ভূত পদ্ধতি প্রয়োগ করে নিমিষেই ব্যাপক পরিবর্তন আনতে চায়। যখন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নিজেদের চাহিদামতো কিংবা অর্থদাতার রাজনৈতিক মুনাফা আনতে ব্যর্থ হয় তখনই তারা ধ্বংসাত্মক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। জঙ্গীবাদ সহিংস অপরাধের অন্যতম একটি ধরন, যেদিন থেকে জনসাধারণের বিরুদ্ধে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে তখন থেকেই অপরাধটির ভয়াবহতা মানুষকে ভীত করে তুলছে প্রতিনিয়ত। ধর্মীয় জঙ্গীদের দ্বারা সন্ত্রাসী আক্রমণ বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ এবং এর ভয়াবহতা এবং ক্ষয়ক্ষতি বহির্বিশ্বের পাশাপাশি বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়ছে। ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ বিষয়টি নতুন নয়। সন্ত্রাসবাদের শুরু বিশেষ করে ১৯৯০ সালের মাঝামাঝি সময়ে, সন্ত্রাসবাদ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ক ইস্যুতে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়ে থাকে অপরাধের ক্ষতিগ্রস্ততা নির্ণয় পরিমাপক গভীরতায়। বর্তমান সময়ে জঙ্গী এবং সন্ত্রাসবাদ একই অর্থে অনেক সময় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কারণ, সাধারণভাবে জঙ্গীরাই সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মদদদাতা এবং সক্রিয় কর্মী হিসেবে কাজ করে থাকে। জঙ্গী এবং সন্ত্রাসবাদ ইস্যুটি বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে পাকিস্তান, ভারত, ভুটান, নেপাল, মিয়ানমার এবং শ্রীলঙ্কাতে নতুন নয়। বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয়, বর্ণ, গোত্র, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক বিদ্রোহী গ্রুপ, জঙ্গী গ্রুপ, কমিউনিস্ট গ্রুপ, বিদ্রোহী গ্রুপ এ দেশগুলোতে তাদের কর্মকা- নিজেদের মতো করে চালিয়েছে এবং গ্রুপের সাথে গ্রুপের সমন্বয়ের মাধ্যমে অঞ্চলভিত্তিক সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়েছে এবং এখনও যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, জঙ্গী অধ্যুষিত বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এ সকল দেশের সব জায়গায় ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে সন্ত্রাসীরা এবং ধ্বংসের লীলাখেলা শুরু করে পর্যায়ক্রমে। ১৯৯৯ সাল থেকে বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদের বিশেষ করে জঙ্গীবাদের ব্যাপৃতি ঘটে থাকে বিশেষ করে দেশীয় পরিম-লে এবং আন্তর্জাতিকভাবে আল-কায়েদার সহযোগিতায় বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের জঙ্গীরা তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে। পরিসংখ্যানিক চিত্র সাক্ষ্য দেয়, ১৯৯৯ সাল থেকে শুরু হয়ে ২০০৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী এবং জঙ্গী কার্যক্রমের ভয়াবহতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। ইসলামী মৌলবাদ, চরমপন্থী মনোভাব, রাজনৈতিক প্ররোচনা এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গীবাদী কার্যক্রমের প্রভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সন্ত্রাসী হামলার ভয়াবহতা রাজনীতির গতিপথকে অনেক সময় নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। রাজনীতিতে সন্ত্রাসীদের অনুপ্রবেশ, অপরাজনীতিকরণ, গণতন্ত্রের চিরাচরিত নিয়মের ব্যত্যয় ইত্যাদি উপকরণগুলো বাংলাদেশের জঙ্গীবাদের বিচরণের মুখ্য প্রভাবক হিসেবে কাজ করে থাকে। সন্ত্রাসবাদ এবং মৌলবাদের বিস্তৃতির কারণে দিন দিন রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়ছে দেশের মেধাবী ছেলেমেয়েরা। বর্তমানে অনেক প্রথিতযশা রাজনীতিবিদের আক্ষেপ করে বলতে শোনা যায়; অপরাজনীতির প্রকটতা জাজ্বল্যমান হওয়ায় ব্যবসায়ী এবং কালো টাকার মালিকদের রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ ঘটছে যা ভবিষ্যত প্রজন্মের তথা রাজনীতির সুষ্ঠু বিকাশের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। ২০০০ সালের পর থেকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রের সহযোগিতায় ধর্মীয় উগ্রগোষ্ঠীর পদচারণা শুরু হয় বাংলাদেশে। জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ এবং জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ ২০০৫ সালে দেশবিরোধী জঘন্য কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসে। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা ১১ টার মধ্যে দেশব্যাপী একযোগে ৬৩ জেলায় বোমা হামলা চালায় নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবি। মূলত. এ হামলার মধ্য দিয়েই জেএমবি তাদের শক্তির জানান দিতে সমর্থ হয়। হামলার প্রেক্ষিত বিশ্লেষণে জানা যায়, বহুমুখী কারণ যেমন অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কগুলো এহেন জঙ্গীবাদের বিস্তার এবং প্রসারে কাজ করে যাচ্ছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক সংস্কৃতি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, অর্থনৈতিক সহযোগিতা, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক উপাদানগুলো জঙ্গীবাদকে প্রলুব্ধ করে থাকে ক্ষেত্রবিশেষে। ১৯৯৯ সালের শুরু থেকে অদ্যাবধি ধর্মের নামে বাংলাদেশ সন্ত্রাসী কার্যক্রমে সংক্রমিত হয়েছে দেশী-বিদেশী আন্তর্জাতিক চক্রের সমন্বয়ে। ২০০৯ সালে দেশ পরিচালনায় এসে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে বর্তমান সরকার এবং এর ফলে সহিংস অপরাধের সংখ্যাও কমে এসেছে। বর্তমান সরকার জঙ্গীবাদ এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে বিশেষ করে সুসজ্জিত সিটিটিসি-কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (পুলিশের বিশেষ ইউনিট) গঠন করে জনমনে স্বস্তি ও শান্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। জঙ্গীবাদের বিস্তার রোধে বর্তমান সরকারের গ্রহণীয় পদক্ষেপ ইতিবাচক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে গৃহীত পদক্ষেপের বাস্তবায়ন সাপেক্ষে। ২০১৮ এর ২০ মে সিরাজগঞ্জে বিশেষ আদালত জেএমবির জঙ্গী আতাউল্লাহ ইলিয়াস বাহাদুর আলীকে চার বছরের সশ্রম কারাদ- দিয়েছে। ২০১৮ এর ১৮ মে ময়মনসিংহের কাচিঝুঁলি থেকে ফিরোজা রহমান নামে একজন জেএমবি সদস্যকে জিহাদী বই পুস্তক ও লিফলেটসহ গ্রেফতার করা হয়। ঐ বছরের ১৬ মে রাজধানীর আরামবাগ থেকে জেএমবির মহিলা শাখার দু’জন সদস্য লাবিবা এবং কণাকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে হত্যা মামলায় ২০১৮ এর ৭ মে জেএমবির দুই সদস্যকে মৃত্যুদ- এবং তিন জনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়েছে আদালত। এছাড়া ২০১৮ এর ৫ এপ্রিল কুষ্টিয়ায় র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির আব্দুল কদ্দুস নিহত হয় এবং র‌্যাবের দু’জন সদস্য আহত হয়। র‌্যাব ঘটনাস্থল থেকে ৩টি আধুনিক অস্ত্র, ১৩টি বুলেট ও ধারালো অন্ত্র উদ্ধার করে। সুতরাং বলা যায়, সরকার জঙ্গীবাদের রাজনীতি থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য তৎপর হয়ে কাজ করে যাচ্ছে এবং আন্তরিকতায় কোনরূপ ঘাটতি নেই। (বাকি অংশ আগামীকাল)
×