ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এপার-ওপারে ছিল সকল প্রস্তুতি ;###;রোহিঙ্গারা জানিয়েছে, পাঁচ দফা বাস্তবায়ন ছাড়া তারা মিয়ানমারে ফিরে যাবে না

আবারও ভেস্তে গেল ॥ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া

প্রকাশিত: ১০:৪৬, ২৩ আগস্ট ২০১৯

আবারও ভেস্তে গেল ॥ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ দ্বিতীয় দফায়ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কাজ শুরু করা গেল না। বিভিন্ন মহলের উৎস্যুক দৃষ্টি ছিল। সরকারের ছিল সব প্রস্তুতি। প্রত্যাবাসন কাজে নিয়োজিত সব সংস্থার কর্মকর্তা কর্মচারীদের ছিল দীর্ঘ অপেক্ষা। চলছিল ক্ষণ গণনা। মিয়ানমার পক্ষও এসেছিল সীমান্তের ওপারে ট্রানজিট পয়েন্টে। কিন্তু সে দেশের সরকারের পক্ষে ক্লিয়ারেন্সপ্রাপ্ত রোহিঙ্গাদের মধ্যে একজনও নিজ দেশে ফিরে যেতে এগিয়ে না আসায় বৃহস্পতিবার প্রত্যাবাসন কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করা গেল না বলে জানান দিলেন শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার (আরআরআরসি) আবুল কালাম। এ সময় প্রত্যাবাসন কাজ পর্যবেক্ষণে আসা দুই চীনা ও মিয়ানমারের এক কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। তবে তিনি জানিয়েছেন, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া। যে কোন সময় যে কেউ ইচ্ছে করলে ফিরে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। ক্লিয়ারেন্সপ্রাপ্ত সব রোহিঙ্গার মতামত গ্রহণে আরও এক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। এরপর নিশ্চিত হওয়া যাবে তারা যাবে কি যাবে না। এ সময়ে রোহিঙ্গাদের পক্ষে উল্টো জানান দেয়া হয়েছে তাদের ৫ দফা দাবি বাস্তবায়ন ছাড়া তারা মিয়ানমারে ফিরে যাবে না। উল্লেখ্য, গত বছরের ১৫ নবেম্বর প্রত্যাবাসনের অনুরূপ আয়োজন করার পর রোহিঙ্গাদের ফিরে না যেতে রীতিমতো বিক্ষোভ প্রদর্শনের পর প্রথম দফার সেই আয়োজনও ব্যর্থ হয়ে যায়। এ ঘটনার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ঢাকায় তার প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা ইস্যু মিয়ানমারই সৃষ্টি করেছে। এর সমাধানও মিয়ানমারকেই করতে হবে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে রাজি না হওয়ার বিষয়টি দুঃখজনক। আমরা এটা প্রত্যাশা করি না। তিনি আরও বলেছেন, আশ্রিত রোহিঙ্গাদের এদেশে থেকে যাওয়ার জন্য কেউ প্ররোচনা দিলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। অপরদিকে, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার প্রেস ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বদেশে অর্থাৎ মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করার যে কর্মসূচী নেয়া হয়েছিল বৃহস্পতিবার তা আর হচ্ছে না। তিনি জানান, গত মঙ্গল ও বুধবার সাক্ষাতকার নেয়া ২৯৫ আশ্রিত রোহিঙ্গার মধ্যে একজনও ফিরে যেতে রাজি না হওয়ায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া মূলত স্থগিত করা হয়েছে। উখিয়া কুতুপালং ক্যাম্পের ২৬ নম্বর ইউনিটে আরআরআরসি কমিশনার এই প্রেস ব্রিফিং করেন। এদিকে ঘটনা পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, বৃহস্পতিবার পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুযায়ী সরকার পক্ষে প্রত্যাবাসন কাজ শুরু করার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ট্রানজিট পয়েন্ট ও বাংলাদেশ-মিয়ানমার মৈত্রী সেতু প্রস্তুত রাখা ছিল। জোরদার ছিল সীমান্ত এলাকাজুড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বৃহস্পতিবার ভোর থেকে ট্রানজিট পয়েন্ট এলাকায় জন চলাচল বন্ধ করে দেয় সীমান্তরক্ষী বিজিবি। টেকনাফ জাদিমুরা, শালবাগান থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল। আশ্রয় শিবির থেকে প্রত্যাবাসনে ইচ্ছুকদের নেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল ৫টি বাস ও ৩টি ট্রাক। বাসগুলো ছিল রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আর ট্রাক ছিল এদের মালামাল পরিবহনের জন্য। অপরদিকে, সীমান্তের ওপারে ঢেঁকিবুনিয়া পয়েন্টে এসেছিল মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীসহ (বিজিপি) প্রত্যাবাসন সংশ্লিষ্ট কাজে নিয়োজিত প্রতিনিধিরা। এ ধরনের পরিস্থিতি দেখে সবাই আশা করেছিল যে কোন সময় প্রত্যাবাসন কাজ শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে যায়, পরে দুপুর গড়িয়ে বিকেল ৪টা পর্যন্ত অপেক্ষার পরও সংশ্লিষ্ট রোহিঙ্গাদের কেউ প্রত্যাবাসনে মতব্যক্ত করে এগিয়ে আসেনি। আর এতে করে বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দফায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া থমকে গেল। এর আগে গত বছরের ১৫ নবেম্বর একই ধরনের প্রত্যাবাসন উদ্যোগ নিয়ে রোহিঙ্গাদের অনাগ্রহের কারণে তা থমকে যায়। আরআরআরসি মোঃ আবুল কালাম জানিয়েছেন, মিয়ানমারের ক্লিয়ারেন্স পাওয়া ২৩৫ পরিবারের ৩ হাজার ৫৪ রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় স্বদেশে ফিরে যেতে এগিয়ে না আসায় বৃহস্পতিবার প্রত্যাবাসন কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। আরআরআরসির সঙ্গে অভিন্ন সুরে চীন ও মিয়ানমারের প্রতিনিধিরাও অনুরূপ বক্তব্য দেন। চীন ও মিয়ানমার প্রতিনিধিরা উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করে পুরো প্রক্রিয়াটি পর্যবেক্ষণে নিয়োজিত ছিলেন। বৃহস্পতিবার ভোরে টেকনাফের শালবন ২৬ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রত্যাবাসনের জন্য কেউ আসেনি। এর আগে ইউএনএইচসিআর এবং আরআরআরসি কার্যালয়ের প্রতিনিধিরা তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের ঘরে ঘরে গিয়ে উৎসাহিত করেন। উৎসাহের প্রক্রিয়ায় উল্টো রোহিঙ্গারা জানিয়ে দেয়, মিয়ানমারে তাদের নাগরিকত্ব, বসতবাড়ি ফেরতসহ সবক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরই তারা নিজ দেশে ফিরে যাবে, অন্যথায় নয়। এর আগে গত মঙ্গল ও বুধবার ইউএনএইচসিআর-এর সদস্যরা ২৯৫ রোহিঙ্গার কাছে তাদের মতামত জানতে চান। কিন্তু এদের কারও কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। এরপরও অপেক্ষার প্রহর গোনা হয়। ধারণা করা হয়, কেউ না কেউ এগিয়ে আসবে। কিন্তু বৃহস্পতিবার চারটা পর্যন্ত দেখা গেল কেউ আসেনি। ফলে বাধ্য হয়ে বৃহস্পতিবার থেকে প্রত্যাবাসন শুরুর কাজটি আরআরআরসি কমিশনার স্থগিত ঘোষণা করেন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে চীন ও মিয়ানমারের প্রতিনিধিরা পূর্ব থেকে কক্সবাজারে অবস্থান করছিলেন। বৃহস্পতিবার তারা যান শালবন এলাকায়। সেখান থেকে তাদের উখিয়া পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণের কথা ছিল। কিন্তু রোহিঙ্গাদের অনাগ্রহের কারণেই সবই ভেস্তে যায়। উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে সশস্ত্র হামলার ঘটনার পর ২৫ আগস্ট রাতে সেনা অভিযান শুরু করা হলে লাখে লাখে রোহিঙ্গারা পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী এ সংখ্যা ১১ লাখের বেশি হলেও বেসরকারী পরিসংখ্যানে তা ১২ লাখ। এ ঘটনার পর ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বাংলাদেশ-মিয়ানমার প্রত্যাবাসন চুক্তিসম্পন্ন হয়। ওই বছরের ৬ জুন নেপিদোতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর মধ্যেও সমঝোতা চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী গত বছরের ১৫ নবেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর দিনক্ষণ নির্ধারিত হয়। কিন্তু নির্ধারিত দিনে রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যেতে অনাগ্রহ প্রকাশ করলে সে উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। গত জুলাই মাসে এ রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আবারও উদ্যোগ নেয়া হয়। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে উখিয়া টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেন মিয়ানমার পররাষ্ট্র সচিব মিন্ট থোয়ের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধি দল। ১৫ সদস্যের ওইদল টানা দু’দিন ধরে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনা ও বৈঠক করে। ওই বৈঠকের ফলাফল অনুযায়ী বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করার বিষয় নিয়ে পুনঃদিনক্ষণ নির্ধারিত হয়। কিন্তু বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত অপেক্ষার প্রহর শেষে দেখা গেল রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে আগ্রহী নয়। এ প্রসঙ্গে আরআরআরসি কমিশনার আবুল কালাম জানিয়েছেন, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে। এ তথ্যটি আমরা রোহিঙ্গাদের জানিয়েছি। এছাড়া মিয়ানমারের দেয়া ছাড়পত্র অনুযায়ী ৩ হাজার ৫৪০ আশ্রিতকে ফেরত নেয়ার প্রথম তালিকাটি দেয়া হয়। এদের মধ্যে গত মঙ্গল ও বুধবার ২৩৫ রোহিঙ্গা পরিবারের সঙ্গে ইউএনএইচসিআর ও আরআরআরসির সদস্যদের কথা হয়েছে। তাদের অনেকে এ সময় ফিরে যাওয়ার পক্ষে সম্মতি প্রদান করে। কিন্তু নির্ধারিত দিন, অর্থাৎ বৃহস্পতিবার দেখা গেল প্রত্যাবাসনে কেউ এগিয়ে আসেনি।
×