ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের প্রথম নারী শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা স্মরণে শ্রদ্ধাঞ্জলি

প্রকাশিত: ০৯:৩৪, ২০ আগস্ট ২০১৯

 বাংলাদেশের প্রথম নারী শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা স্মরণে শ্রদ্ধাঞ্জলি

সংস্কৃতি ডেস্ক ॥ বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মহিলা কবি মেহেরুন্নেসার জন্মদিন আজ। কবি মেহেরুন্নেসা ১৯৪২ সালের ২০ আগস্ট কলকাতার খিদিরপুরে জন্মগ্রহণ করেন। মেহেরুন্নেসার কবি প্রতিভার প্রকাশ ঘটে খুব ছোট বেলায়। ১৯৫২ সালে মাত্র দশ বছর বয়স থেকেই অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দেন তার খুরধার লেখনীর মাধ্যমে এবং জায়গা করে নেন সংগ্রাম, ইত্তেফাক, দৈনিক পাকিস্তান, অনন্যা, কাফেলা, বেগম, যুগের দাবিসহ তৎকালীন প্রায় সকল পত্রিকায়। মাত্র দশ বছর বয়সে ১৯৫২ সালে তার ‘চাষী’ কবিতা সংবাদ-এর ‘খেলাঘর’ পাতায় প্রকাশিত হয়। তিনি বড়দের জন্য লেখা শুরু করেন ১৯৫৪ সালে ‘কাফেলা’ পত্রিকার মাধ্যমে। কবি মেহেরুন্নেসার রুচি, ব্যক্তিত্ব, সৌন্দর্য ও কবিতা সমান্তরাল। তার কর্ম, বিশ্বাস এবং বিবক্ষাই তার কবিতা। প্রথমে তার কবিতায় ফররুখ আহমদ-এর প্রভাব, ইসলামী ভাবধারা, আরবী-ফার্সী শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। জাগে মখলুখ জাগে ফুল পাখী জেগেছে স্বর্ণ সুরুজ ইত্যাদি। তার বেশিরভাগ কবিতা প্রকাশিত হয় ‘বেগম’ পত্রিকায়। বেগম পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগমের পরামর্শে তিনি স্বদেশ, প্রেম ও প্রকৃতি বিষয়ে আরবী-ফার্সী শব্দের ব্যবহার বর্জন করে কবিতা লিখতে শুরু করেন। তিনি রানু আপা নামে ‘পাকিস্তানী খবর’-এর মহিলা মহল পাতার সম্পাদনা করতেন। কবি হিসেবে তিনি ছিলেন সত্যিকার কবিতাকর্মী। খুব আত্মবিশ্বাস ও সাহসিকতা, তার কবি প্রতিভা আদায় করে নিয়েছিল কবি সুফিয়া কামালের স্নেহ আনুকূল্য। ১৯৬১ সালে যোগ দেন ফিলিপস রেডিও কোম্পানিতে। এছাড়া তিনি ইউএসআইএস লাইব্রেরিতেও অনুলিখনের কাজ নিয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে, সে সময় ফিলিপস ইংরেজী ও উর্দুতে মুখপত্র ছাপাত, কবি মেহেরুন্নেসার চেষ্টায় বাংলা ভাষায় রচিত পত্রিকাও প্রকাশে বাধ্য হয় ফিলিপস কর্তৃপক্ষ। কবিতার প্রতি ভালবাসা, বাংলা সাহিত্যের প্রতি অকৃত্রিম আকর্ষণ তাকে সাহিত্য চর্চা থেকে দূরে থাকতে দেয়নি। রানু আপা ছদ্মনামে রাজনৈতিক প্রবন্ধ লিখেছেন ৬৯-এর আইয়ুববিরোধী উত্তাল গণআন্দোলনে। নিজের চেষ্টায় তিনি মিরপুরের ৬ নং সেকশনে, ডি বল্কের ৮ নং বাড়িটি বাবার নামে বরাদ্দ পান। ১৯৬৩ সালে কবি মেহেরুন্নেসা সপরিবারে বসবাসের জন্য ওই বাড়িতে ওঠেন। ১৯৬৫ সাল থেকে তারা থাকতে শুরু করেন মিরপুরে। সে সময় মিরপুর বিহারী অধ্যুষিত এলাকা। বাঙালী পরিবার বিহারীদের তুলনায় নগণ্য। এর কিছু দিনের মধ্যে তার বাবা অসুখে পড়েন। তখন তাকে আরও বেশি পরিশ্রম করতে হয় পরিবারের জন্য। একাত্তরে বিহারী অধ্যুষিত মিরপুরে কবি কাজী রোজীর (সাবেক সংসদ সদস্য) নেতৃত্বে এ্যাকশন কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সক্রিয় সদস্য ছিলেন কবি মেহেরুন্নেসা। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে লেখক সংগ্রাম শিবির আয়োজিত বিপ্লবী কবিতা পাঠের আসরে হাসান হাফিজুর রহমান, আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হুমায়ুন কবিরসহ অন্য কবিদের সঙ্গে স্বরচিত কবিতা পাঠে অংশ নেন মেহেরুন্নেসা। এ আসরে সভাপতিত্ব করেছিলেন ড. আহমদ শরীফ। সেই অনুষ্ঠানে তিনি জনতা জেগেছে কবিতাটি আবৃত্তি করেন। বিহারী অধ্যুষিত মিরপুরে তিনি ও তার পরিবার অনেক আগে থেকেই চিহ্নিত হয়ে ছিলেন মুক্তিকামী বাঙালী হিসেবে। ২৭ মার্চ এলো, দুদিন আগেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় তখন একতরফা গণহত্যা শুরু হয়ে গিয়েছিল। কবি মেহেরুন্নেসা বিহারীদের হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে, তার দুই ভাই মিরপুর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য রফিক ও টুটুলকে নিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকা কর্মসূচীর অংশ হিসেবে ২৩ মার্চ সকাল ১০টায় মিরপুরের ৬ নম্বর সেকশনের ডি-ব্লক, ১২ নম্বর রোডে নিজ বাড়িতে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করেন। এবং ওইদিন বেগম পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তার লেখা শেষ কবিতা (তাকে মারার মাত্র তিন দিন পূর্বে)। এই অপরাধে ২৭ মার্চ তার মা, দুই ভাই ও তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হত্যার সময় তার বয়স হয়েছিল ঊনত্রিশ বছর। মেহেরুন্নেসার ছোট দুই ভাইয়ের কাটা মাথা দিয়ে ফুটবল খেলা হয়। প্রত্যক্ষদর্শী মিরপুরের আলী আহাম্মদের ভাষ্য মতে কবি মেহেরুন্নেসাকে চুলের মুঠি ধরে উঠানে এনে রামদায়ের এক কোঁপে গলা কেটে ফেলে। মেহেরুন্নেসার কাটা মাথার বেণী করা চুল ফ্যানের সঙ্গে ঝুঁলিয়ে ফ্যান ছেড়ে দেয়া হয় কাটা মস্তকের রক্ত ছিটিয়ে উল্লাস করা হয়। এভাবেই কবি মেহেরুন্নেসা হন স¦াধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মহিলা কবি। একাত্তরের ২৭ মার্চ কাদের মোল্লা তার সহযোগীদের নিয়ে কবি মেহেরুন্নেসা, তার মা এবং দুই ভাইকে মিরপুরের বাসায় গিয়ে হত্যা করেন হত্যাকারী। ঢাকা মিরপুরের স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে তার নাম চিরকাল উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। কিন্তু এই মহান কবির বাংলাদেশে এক বোন ছাড়া কোন আত্মীয় নেই এবং তার বোন মোমেনা রক্ষণশীল পরিবারের গৃহবধূ থাকায় মেহেরুন্নেসাকে নিয়ে আমাদের দেশে উল্লেখযোগ্য কিছুই করা হয়নি।
×