ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চিটাগাং পোর্ট ড্যামেজড বাই দ্য টেররিস্ট!

প্রকাশিত: ০৮:৫৬, ১৬ আগস্ট ২০১৯

চিটাগাং পোর্ট ড্যামেজড বাই দ্য টেররিস্ট!

১৯৭১ সালের ১৬ আগস্ট দিনটি ছিল সোমবার। মুক্তিবাহিনী বরিশাল জেলার ভাণ্ডারিয়া ও কাঁঠালিয়া থানায় অভিযান চালিয়ে ১১৮টি রাইফেল জব্দ করে। আওয়ামী লীগ নেতা ডাঃ আব্দুল মজিদ, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মারুফ হোসেন ভাসানী ন্যাপের থানা সহ-সভাপতি সাহেব আলীকে পাকসেনারা ধরে নিয়ে হত্যা করে। এছাড়া গ্রামের নিরীহ আরও বহুলোককে হত্যা করেছে ও ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। ঐ ক্যাম্পে জিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের কনফারেন্স ডাকেন এবং বরিশাল জেলার কয়েকটি থানা আক্রমণ করার জন্য কয়েকটি দল গঠন করেন। সুবেদার আজিজ এবং লতিফের নেতৃত্বে ২০ জনের একটি দল ভা-ারিয়া থানার জন্য, কমান্ডার হাবিবের নেতৃত্বে পাঠানো হয়। এছাড়া ক্যাপ্টেন জিয়ার নেতেৃত্ব ৫০ জনের একটি দল মঠবাড়িয়া থানা দখলের জন্য শরণখোলা রেঞ্জ অফিসের দিকে রওনা হয়। ভোরবেলায় পৌঁছাতেই গানবোটের শব্দ পাওয়া যায় শরণখোলা রেঞ্জ অফিসে সুবেদার ফুলুর নেতৃত্বে ১০০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা ছিল। ভোরে ভোলা নদীর দু’পারে মাত্র ১০ জন করে ২০ জন রেখে জিয়া সবাইকে সুন্দরবনের ভিতরে যাবার নির্দেশ দেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ৭টি গানবোট ফরেস্ট অফিসের উত্তর দিকে এসে পড়ে। মোরলগঞ্জে পাকসেনা এবং রাজাকাররা চরমভাবে মার খেলে তার প্রতিশোধ নেবার জন্য গানবোটগুলো পাঠানো হয়েছিল। ৪টি গানবোট শরণখোলা রেঞ্জ অফিস অতিক্রম করে উত্তর দিকে যাবার পর পরবর্তী সময়ে ৩ খানা গানবোটের ওপর ভোলা নদীর দুই পারে থেকে মুক্তিযোদ্ধারা গুলিবর্ষণ করে। সুবেদার গাফফার রকেট লাঞ্চার থেকে গোলা নিক্ষেপ করলে একটি গানবোট বিধ্বস্ত হয়। গানবোটটি গুলি খেয়ে দক্ষিণ দিকে ৩ মাইল পর্যন্ত গিয়ে ডুবে যায়। পরবর্তীকালে পাঞ্জাবীদের ৪টি মরা লাশ নদীতে ভাসতে দেখা যায়। বাদবাকি ৬টি গানবোট থেকে খানসেনারা মর্টার, হেভি মেশিনগান, লাইট মেশিনগান থেকে মুক্তিসেনাদের ওপর প্রবলভাবে গোলাবর্ষণ করে এবং মুক্তিযোদ্ধারা ত্যারাব্যাকা হাট নামক স্থানে একত্রিত হয়। নরসিংদীর মনোহরদীতে হাবিলদার আজমল আলীর নেতৃত্বে পাকবাহিনীর সঙ্গে প্রচ- যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এটি কটিয়াটি এ্যামবুশ নামে পরিচিত। সেখানে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডোরা বেশ কয়েকটি মোটর লঞ্চ ডুবিয়ে দেয়। প্রায় দেড় শতাধিক পাকসেনা নিহত হয়। আর্টিলারিসহ এক ব্যাটালিয়ন পাক হানাদার ও তিন শতাধিক রাজাকার চিলমারীতে ইস্ট বেঙ্গলের মুখোমুখি হয়। ইস্ট বেঙ্গল ছিল কম্বাইন্ড ফোর্স। এখানে ছিলেন সিও জামিল (থার্ড বেঙ্গল), সিও মেজর জিয়াউদ্দীন (ফার্স্ট বেঙ্গল) ও সিও মেজর আমিনুল হক (৮ম বেঙ্গল), আর ছিল মুক্তিবাহিনীর দুটি কলাম। মূল কমান্ডে ছিলেন ‘জেড’ ফোর্সের অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান। ১৫ ও ১৬ আগস্ট হানাদার পাকবাহিনী নেক-টু-নেক ফাইট করেছে তাদের মোস্ট লেটেস্ট ও মোস্ট সফিস্টিকেটেড আর্মস নিয়ে। কখনও বা মনে হয়েছে পাক হানাদার ইস্ট বেঙ্গলে ডিফেন্সে ফাটল ধরাতে সমর্থ হবে। কিন্তু না, বাংলার বীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট দাঁতে দাঁত কামড়ে পজিশন আগলে রেখে দুদিন ধরে তাদের আক্রমণ রেসিস্ট করে গেছে। দুদিন ধরে মুক্তিযোদ্ধারা জঙ্গল ও বনের ফাঁক দিয়ে সংগ্রহ করে হানাদার বাহিনীর ডিফেন্সের ফাঁক-ফোকর। ১৫ আগস্ট কমান্ডোরা ট্রানজিস্টরে চূড়ান্ত সংকেত পায় এবং অপারেশনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। ... অপারেশন চলাকালে ২০০ জন সিএ্যান্ডসি বিশেষ কমান্ডো দল, হেভি মেশিনগান, এনরগা সহকারে তিনজনের ছোট ছোট দল করে, ৬৬টি উপদলে বিভক্ত হয়ে নৌ কমান্ডোদের কভার দিতে মংলা বাঁধের পেছনে অবস্থান নেন। অপারেশন চলাকালে সিএ্যান্ডসি কমান্ডো দলের উপকমান্ডার রাজা ও খিজির জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌ কমান্ডোদের সহযোগিতায় মেশিনগান নিয়ে পশুর নদীর হাঁটু পানিতে নেমে আসেন। সময়ের অভাবে শুধু ২৪ জন নৌ কমান্ডো এই অভিযানে অংশ নেন। ১৬ আগস্ট, ১৯৭১ তারা একযোগে আক্রমণ পরিচালনা করে এবং বাংলাদেশের মানুষ রেডিও-বাংলাদেশ, বিবিসি, লন্ডনের মাধ্যমে এই সাফল্যের খবরটি জানতে পারে। বাংলাদেশের নৌ কমান্ডোরা চট্টগ্রামে ৬টি জাহাজ ও বার্জ, মংলায় ৫টি জাহাজ ও বার্জ, নারায়ণগঞ্জে তিনিটি কোস্টার ও বার্য ও চাঁদপুরে একটি জাহাজ ও পন্টুন ধ্বংস করে। দাউদকান্দি সেতুও সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা হয়। এর ফলে পাকিস্তানী গানবোটগুলোর চলাচলের পথ ও চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসার একমাত্র নৌপথটিও বাংলাদেশের নৌকমান্ডোদের আক্রমণে বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এরকম অভিযান এর আগে হয়নি। গাজীপুরে শত্রুদের ২০ জন আহত হয় যাদের ১৪ জন মারা যায়। অতর্কিত হামলায় শত্রুদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়। গোমতী নদীর কাছাকাছি কুমিল্লা শহরের চারপাশে ৫৫ এর বেশি রাজাকার আক্রান্ত হয় এবং চল্লিশ জন নিহত হয়। আখাউড়ার কাছাকাছি আক্রমণে ১৩ জন নিহত ও ৫ জন আহত হয়। নিজামউদ্দিন লস্কর ময়নার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদল সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কে জয়কলস সেতুর কাছে পাকহানাদারদের আক্রমণ করে। এতে পাকসেনারা পাল্টা আক্রমণ চালায়। ১২ ঘণ্টাব্যাপী এ যুদ্ধে ৯ জন পাকসেনা নিহত ও ১০জন আহত হয়। রাউজান থানার শওকত হাফিজ খান রুশ্নি বিএলএফ এর দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণ নিয়ে আর্মি হেডকোয়ার্টার চিফ হয়ে মিরসরাই প্রবেশ করেন। বিরাজমান পরিস্থিতিতে মিরসরাইয়ের মস্তাননগরে পাকিস্তানী রাজাকার ও মিলিশিয়া বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। যুদ্ধটি পরিচালনা করেন রুশ্নি ও প্রকৌশলী এরফানুল হক। যুদ্ধ দুই ঘণ্টা স্থায়ী হয়। যুদ্ধে দু’জন রাজাকার ও দশজন মিলিশিয়া নিহত হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নয়াদিল্লীতে বলেন, বাংলাদেশের সঙ্কটজনিত পরিস্থিতি স্বাধীনতার পর ভারতের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিপুল শরণার্থীর চাপে ভারতের অর্থনীতি সঙ্কটের মুখে। সামরিক শাসক ১৪ জন জাতীয় পরিষদ সদস্যকে ২২আগস্ট সকাল ১০ টার মধ্যে নাটোরে ২নং সেক্টরের উপ-সামরিক আইন প্রশাসকের আদালতে হাজির হবার নির্দেশ দেয়। তাঁরা হচ্ছেন: রিয়াজউদ্দিন আহমেদ, মোশাররফ হোসেন চৌধুরী, মতিউর রহমান, মফিজ আলী মোহাম্মদ চৌধুরী, মোঃ আজিজুর রহমান, শাহ মাহতাব আহমেদ, মুজিবুর রহমান, মোতাহার হোসেন তালুকদার, আবদুল আউয়াল, আবদুল মোমিন তালকদার, আবু সাঈদ, এবিএম মোকসেদ আলী ও অধ্যাপক মোঃ ইউসুফ আলী। ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত কথিকামালা বিশ্বজনমত অনুষ্ঠানে বলা হয়েছে, পৃথিবীর দেশে দেশে শান্তিকামী মানুষ দেশবরেণ্য জননেতা, বুদ্ধিজীবী সমাজ, বেতার, টেলিভিশন ও সংবাদপত্র পাকিস্তানী নরঘাতী তস্করদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। ওয়াশিংটন স্টার’ পত্রিকার এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়: শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসন শুরু করে পাকিস্তানের মূর্খ সামরিক চক্র এক প্রচ- ভুল করে বসেছে। ইয়াহিয়া আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের একথা বোঝা উচিত যে নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মর্যাদা প্রশ্নাতীত। ‘ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর’ পত্রিকার এক সম্পাদকীয়তে বলা হয় : শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা। জাতিসংঘ মিশনের সহকারী স্থায়ী প্রতিনিধি সৈয়দ এফ করিম বলেন, নীরব দর্শক হয়ে থেকে পাকিস্তানের এই বর্বর নিপীড়ন প্রত্যক্ষ করে চলা সম্ভব নয়। তারা বাংলাদেশকে এক ভয়ার্ত মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছে। এবার আমাদের সিদ্ধান্ত নেবার পালা! এই চৌদ্দ জন বাঙালীর জন্য সম্ভবত অপেক্ষা করছে আমেরিকার রাজনৈতিক আশ্রয়। বিদ্রোহী কূটনীতিবিদের মনের ভেতর তখন আশার প্রদীপ দীপ্তমান পৃথিবীর সকল প্রান্তের পাকিস্তানী মিশনের দায়িত্ব পালন করা বাঙালীরা এই উদাহরণে অনুপ্রাণিত হয়ে পদত্যাগ করবেন। একাত্তরের এই দিন ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল প্রেস ক্লাবের সম্মুখে প্রদত্ত ভাষণে সিনেটর এ্যাডওয়ার্ড কেনেডি বলেন, এপ্রিলের শুরু হতে অল্প কিছু মাসের মধ্যেই পূর্ব বাংলার গৃহযুদ্ধ প্রায় আশি লাখ পুরুষ, নারী এবং শিশুকে তাঁদের জন্মভূমির পরিস্থিতি হতে বাঁচতে তাঁদের নিজেদের ভারতে নিয়ে আসে। অন্য আরও অগণিত হাজারও জনকে তাঁদের দেশের মধ্যেই খ-যুদ্ধে খুন করে ফেলা হয়েছে অথবা ভিটে ছাড়া করা হয়েছে। পূর্ব বাংলার লাখো নারী অব্যাহত ভীতি, রোগ এবং অনাহারের সম্মুখীন, যদি না তারা অনতিবিলম্বে ত্রাণ পায়। এই অবর্ণনীয় বিয়োগান্তক ঘটনা এখনও বিশ্ব বুঝে উঠতে পারেনি। আমি আপনাকে বলতে পারি, সরেজমিনে প্রত্যক্ষ না করা পর্যন্ত এর বিশালতা বুঝতে উঠতে পারবেন না। উদ্বাস্তুদের আর্তনাদ, তাঁদের মুখ তাঁদের গল্প ইত্যাদি শুনেছি যা এমনই চূড়ান্ত লজ্জার যা কি না বিশ্বের মানুষের নৈতিক সংবেদশীলতাকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে। শরণার্থী শিবিরের অবস্থা বর্ণনাতীত। আপনি অস্থিচর্মসার বাচ্চাদের দেখতে পাবেন যাদের নিজেদের মাথা ধরে রাখার শক্তি পর্যন্ত নেই। আপনি দেখবেন শিশুদের পা ও পায়ের পাতা অপুষ্টিজনিত কারণে ফোলা। আপনি তাঁদের বাবা মায়ের চোখের দিকে তাকালে সন্তান থাকতেও তাঁদের হতাশা দেখবেন। এবং এই সবকিছুর মধ্যে সবচাইতে কঠিন হচ্ছে সুরাতে মারা যাওয়া শিশুর লাশ। ভারত সরকার উদ্বাস্তুদের থাকা খাওয়ার জন্য যে প্রচেষ্টা করছে তা অসাধারণ কৃতিত্বের যা ইতিহাস ধারণ করবে এবং মনে রাখবে। পূর্ব পাকিস্তানের এই ট্র্যাজেডি শুধু পাকিস্তানের ট্র্যাজেডি নয়। এটা শুধু ভারতের ট্র্যাজেডিও নয়। এটা মূলত পুরো বিশ্ব সম্প্রদায়ের ট্র্যাজেডি এবং এই সঙ্কট লাঘবে একযোগে কাজ করাটা সেই সম্প্রদায়েরই দায়িত্ব। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×