ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ডেঙ্গুতে সোমবার আরও চারজনের মৃত্যু

ঢাকার বাইরে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে

প্রকাশিত: ১০:৫৪, ৬ আগস্ট ২০১৯

ঢাকার বাইরে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে সোমবারই চারজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। যদিও সরকারীভাবে কয়েকদিন ধরেই বলা হচ্ছে এই পর্যন্ত ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে এখন পর্যন্ত মৃত্যুর সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। তবে প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও আক্রান্ত ব্যক্তিদের মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। সোমবার রাজধানী ঢাকায় আবহাওয়া কর্মকর্তার স্ত্রী শারমিন আক্তার শাপলা, খুলনায় গৃহবধূ খাদিজা বেগম, ফরিদপুরের ১১ বছরের কিশোরী অথৈ সাহা এবং মাদারীপুরের রিপন হাওলাদার নামের এক যুবক ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। এদিকে প্রতিদিনই ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যায় আগের দিনের রেকর্ড ভাঙ্গছে। মাঝে দুদিন রোগী ভর্তির সংখ্যা কিছু কমলেও গত রবিবার থেকে আবার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী সোমবার পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা দেখানো হয়েছে ২ হাজার ৬৫ জনে। যা আগের দিনের চেয়ে ১৯৫ জন বেশি। রবিবার আক্রান্ত নতুন রোগী ভর্তি হয়েছিল ১ হাজার ৮৫ জন। সোমবার আগের দিনের রেকর্ড ভেঙ্গে আক্রান্ত সংখ্যা ২ হাজার পার হয়েছে প্রথমবারের মতো। এদিকে ঢাকার বাইরের ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় হাজারের কাছে পৌঁছে গেছে। প্রতিষ্ঠানটির দেয়া তথ্য মতে ঢাকার বাইরে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে ৯০৬ জন। এই নিয়ে এই মৌসুমে মোট ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ২৭ হাজার ৪৩৭ জনে পৌঁছে গেছে। যদিও স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাব বলছে, আক্রান্তদের মধ্যে ১৯ হাজার ৭৬১ জন সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়েছেন। এদিকে সারাদেশে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্তদের মধ্যে সোমবার চারজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এই তালিকায় রয়েছে শারমিন আক্তার শাপলা (৩২)। আবহাওয়া অধিদফতরের কর্মকর্তা একেএম নাজমুল হকের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী। ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় আনা হয়েছিল। সোমবার ভোর সাড়ে ৪টার দিকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়েছে। শাপলা জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার ননুজ গ্রামের মৃত আব্দুস সালামের মেয়ে। তার স্বামী বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের সহকারী পরিচালক নাজমুল হকের বাড়ি নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলায়। শাপলার বড় ভাই জহুরুল ইসলাম উজ্জ্বল জানান, শাপলার স্বামী নাজমুল ১৭ মাসের ট্রেনিংয়ের জন্য কোরিয়ায় যাওয়ার কারণে ঢাকা থেকে বাসার সব মালামাল ও সাত বছরের একমাত্র ছেলেকে জয়পুরহাট পৌর শহরের শান্তিনগর এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে ৩০ জুলাই তাদের রেখে যায়। গত শুক্রবার দুপুর থেকেই শাপলার জ্বর শুরু হলে তাকে জয়পুরহাট জেলা আধুনিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ও ডায়াবেটিস থাকার কারণে উন্নত চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকরা শনিবার রাতে তাকে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পাঠায়। সোমবার ভোরে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ডেঙ্গজ্বরে আক্রান্ত হয়ে সোমবার মারা গেল ফরিদপুরের বোয়ালমারীর স্কুল ছাত্রী অথৈ সাহা (১১) সোমবার দুপুর ১টার দিকে ঢাকার ধানম-ি এলাকার একটি বেসরকারী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় সে। অথৈ বোয়ালমারী পৌরসভার কামারগ্রাম মহল্লার কানাই সাহার মেয়ে। সে স্থানীয় ব্রাইট কিন্টারগার্টেনের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী। কানাই সাহা ঢাকায় জুয়েলারি বক্সের ব্যবসা করেন। তিন বোনের মধ্যে অথৈ মেঝ। বড় বোন তৃণা সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। ছোট বোন অদিতীর বয়স তিন বছর। তার মা লিপিকা রানী সাহা একজন গৃহিনী। অথৈর কাকা প্রশান্ত সাহা বলেন, তিন/চারদিন জ্বরে আক্রান্ত হয় অথৈ। প্রথমে তাকে স্থানীয় চিকিৎসক দিয়ে চিকিৎসা করানো হয়। অবস্থার কোন উন্নতি নাহওয়ায় রবিবার বিকেলে তাকে বোয়ালমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থনান্তর করেন। রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় দিকে অথৈকে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আনা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে ঢাকায় স্থানান্তর করেন। রাতেই তাকে ঢাকা নিয়ে যাওয়া হয়। ভর্তি করা হয় ধানম-ি এলাকার একটি বেসরকারী হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার দুপুর ১টার দিকে মারা যায়। এদিকে খুলনায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে খাদিজা বেগম (৪০) নামের এক গৃহবধূর মৃত্যু হয়েছে। সোমবার সকাল ৭টার দিকে খুলনার একটি বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। খুলনার সিভিল সার্জন ডাঃ এ এস এম আব্দুর রাজ্জাক ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। খাদিজা বেগম বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলার উত্তর তাফালবাড়ি গ্রামের দুলু মোল্লার স্ত্রী বলে জানা গেছে। এ নিয়ে খুলনায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ৩ জন মারা গেছেন। এর আগে গত রবিবার মঞ্জুর শেখ নামের দশম শ্রেণীর ছাত্র ও মর্জিনা বেগম (৬৫) নামের এক বৃদ্ধা মারা যান। এদিকে খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের দফতর সূত্রে জানা যায়, জুলাই মাসের ১ তারিখ হতে আগস্ট মাসের ৪ তারিখ পর্যন্ত বিভাগের ১০ জেলায় মোট আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৬৯৭ জন। এর মধ্যে বিভিন্ন জেলার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি রয়েছেন ৩৭১ জন। চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৩২৩ জন। আর মারা গেছেন ৩ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১১৭ জন। এরমধ্যে খুলনা জেলায় ১৫ জন, বাগেরহাট ৫ জন, সাতক্ষীরায় ৬, যশোর ৩৭ জন, ঝিনাইদহে ১০, মাগুরায় ৪, নড়াইলে ৯, কুষ্টিয়ায় ১৪, চুয়াডাঙ্গায় ৯ ও মেহেরপুর জেলায় ৮জন। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মাদারীপুরেও একজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে গত ৬ দিনে জেলায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ৫ জনে। রবিবার গভীর রাতে রিপন হাওলাদার (৩০) শিবচর উপজেলা হাসপাতালে মারা গেছেন। রিপন শিবচর উপজেলার সন্নাসীরচর ইউনিয়নের রাজারচর গ্রামের হাবিবুর রহমান হাওলাদারের ছেলে। সে ঢাকার একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করত বলে জানা গেছে। এ নিয়ে গত ৬ দিনে মাদারীপুর জেলার ৫ জন দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে আরও ২০ জন। সোমবার বেলা ১২টা পর্যন্ত জেলায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে ৮০ জন। এদিকে রাজধানীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঢাকার বাইরেও বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। সোমবার সারাদেশে নতুন করে ৯০৬ জন ডেঙ্গুরোগী শনাক্ত করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সারাদেশে যে হারে ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা বাড়ছে তাতে পরিস্থিতি উদ্বেগজনক অবস্থায় চলে গেছে। সরকারের উচিত হবে এখনই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া। তবে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোন কার্যকর উদ্যোগ নেই। শুধু সচেতনতামূলক কার্যক্রম ছাড়া। ফলে সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। মাঝে দুদিন নতুন রোগী ভর্তির সংখ্যা কিছুটা কমলেও রোববার থেকে এই ধারা আবার বাড়তির দিকে যায়। এদিকে ডেঙ্গু আতঙ্কে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে পরীক্ষার হিড়িক পড়ায় পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় কিটের সঙ্কট দেখা দিয়েছে বাজারে, দামও বেড়েছে কয়েক গুণ। কোন কোন বেসরকারী হাসপাতাল ডেঙ্গু পরীক্ষা বন্ধ করে দিয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই অবস্থায় স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে অনুরোধ করা হয়েছে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ডেঙ্গু পরীক্ষা না করাতে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হওয়া ২০৬৫ জন নতুন রোগীর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ১ হাজার ১৫৯ জন এবং রাজধানীর বাইরে সারা দেশে ৯০৬ জন বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এর আগের ২৪ ঘণ্টায় এক হাজার ৮৭০ জন রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হন, তাদের মধ্যে, রাজধানীতে এক হাজার ৫৩ জন এবং রাজধানীর বাইরে সারা দেশে ৮২১ জন। অর্থাৎ, ঢাকার পাশাপাশি ঢাকার বাইরেও নতুন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মোট ১৮ জনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর, যদিও গণমাধ্যমের খবরে মৃত্য্যুর সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। রাজধানীর বাইরে ঢাকা বিভাগের জেলাগুলোতেই সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগে ১৮০ জন, খুলনা বিভাগে ১৫০ জন, রাজশাহী বিভাগে ১১২ জন, বরিশাল বিভাগে ৯৯ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৬১ জন, রংপুর বিভাগে ৪৭ জন এবং সিলেট বিভাগে ৩৬ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালে।
×