ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দুই বন্দুকধারীর গুলিতে রক্তাক্ত যুক্তরাষ্ট্র

প্রকাশিত: ১০:২৮, ৫ আগস্ট ২০১৯

দুই বন্দুকধারীর গুলিতে রক্তাক্ত যুক্তরাষ্ট্র

তানিয়া হক ভূঁইয়া ॥ যুক্তরাষ্ট্র আবারও রক্তাক্ত হয়েছে দুই বন্দুকধারীর গুলিতে। দেশটির দুটি অঙ্গরাজ্যে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে বন্দুকধারীর নির্বিচারে গুলিতে এখনও পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৩০ জন। প্রথম হামলাটি হয় টেক্সাসে স্থানীয় সময় শনিবার বেলা ১১টার দিকে। দ্বিতীয় হামলাটি হয়েছে ওহায়ও অঙ্গরাজ্যে রবিবার রাত একটায়। দুই ঘটনায় আহতের সংখ্যা ৫৩ জন। ক্যালিফোর্নিয়ার একটি খাদ্য উৎসবে একই ধরনের ঘটনায় তিনজনের প্রাণহানির ছয়দিনের মধ্যে টেক্সাস ও ওহায়ওতে এ হামলার ঘটনা ঘটল। খবর নিউইয়র্ক টাইমস, সিএনএন, ফক্স নিউজ ও ওয়াশিংটন পোস্টের। যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তের কয়েক মাইল দূরে টেক্সাসের এল পাসোর সিয়েরা ভিস্তা শপিংমলের (বিপণি বিতানে) ওয়ালমার্টে শ্বেতাঙ্গ বন্দুকধারী প্যাট্রিক ক্রুসিয়াস (২১) নির্বিচারে গুলি করতে শুরু করে। পুলিশ হামলাকারীকে ধরতে সক্ষম হলেও পুলিশের গুলিতে সে মারা যায়। রয়টার্সের মতে, হামলাকারী যুবক এল পাসোর ৬৫০ মাইল পূর্বের এ্যালেনের বাসিন্দা। এল পাসোর টেলিভিশন কেটিএসএম জানিয়েছে, হামলার আগের একটি ভিডিওতে ওই যুবককে একটি এ্যাসল্ট রাইফেল হাতে ওয়ালমার্টের ওই শপিং মলে ঢুকতে দেখা গেছে। পুলিশ জানিয়েছেন, শপিংমলে প্রবেশের সময় সময় ওই যুবকের চোখে ছিল চশমা, কানে হেডফোন, পরনে ছিল খাকি রঙের প্যান্ট, গাঢ় রঙের টি-শার্ট। ব্যস্ত সময়ে ওয়ালমার্টের ওই বিপণি বিতানে শ্বেতাঙ্গ যুবকের গুলিতে ২০ জনের প্রাণহানি ও আহত হয়েছেন ২৬। এদিকে মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেজ ম্যানুয়েল ওব্রাদর জানান, যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে নিহতদের মধ্যে তিনজন ও আহত ছয়জন মেক্সিকোর নাগরিক। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প টেক্সাসের ঘটনাকে ‘বেদনাদায়ক’ আর এল পাসোর মেয়র ডি মারগো ‘ভয়ানক’ বলে বর্ণনা করেছেন। টেক্সাসের বিপণি বিতানে হামলার ১৩ ঘণ্টা পর স্থানীয় সময় রবিবার প্রথম প্রহরে ওহায়ও অঙ্গরাজ্যের অরেগনের ডেটনে একটি পানশালার বাইরে একই ধরনের ঘটনা ঘটে। সেখানে এক বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হয় নয়জন, আহত ২৭। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত কয়েকটি ভিডিওতে ডেটনের ই-ফিফথ স্ট্রিটে নেড পেপারস নামের একটি পানশালার বাইরে রাস্তায় বেশ কয়েকটি গুলির শব্দের পর আতঙ্কিত লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটতে দেখা গেছে। হতাহত কয়েকজনকে হাসপাতালে নিতেও দেখা যায়। ঘটনার পরপরই ডেটনের পুলিশ এক টুইটার বার্তায় লোকজনকে ওই এলাকা এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেয়। গুলি শুরুর অল্প সময়ের মধ্যেই ডেটন পুলিশ ই-ফিফথ স্ট্রিট ও ওয়েইন এভিনিউয়ের আশপাশের এলাকা ঘিরে ফেলে। এফবিআইর সদস্যরাও দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছান। ডেটন পুলিশের এ্যাসিসট্যান্ট চীফ লেফটেন্যান্ট কর্নেল ম্যাট কারপার জানান, ঘটনার পরপরই টহল পুলিশের সদস্যরা দ্রুততার সঙ্গে বন্দুকধারীকে হত্যা করতে সক্ষম হয়। হামলাকারীর নাম কনর বেটস বলে জানান তিনি। এই হামলায় বেটসের বোন মেগান বেটসও নিহত হয়েছে। ডেটনের মেয়র ন্যানে হোয়ায়েলে রবিবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পানশালার বাইরে গুলিতে নয়জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছে আরও ২৭ জন। হাসপাতাল থেকে ১৫ জন বাড়ি ফিরে গেছেন। বন্দুকধারী পরে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়। তার কাছ থেকে পয়েন্ট ২২৩ উচ্চক্ষমতার বন্দুক ও অতিরিক্ত ম্যাগাজিন বন্দুকধারীর কাছ থেকে পাওয়া গেছে। শিশুদের রক্ষার চেষ্টা অফ-ডিউটি সৈনিকের ॥ টেক্সাস ও ওহায়ওর হামলার আগে গত ২৮ জুলাই ক্যালিফোর্নিয়ার খাদ্য উৎসবে গুলি চালিয়ে তিনজনকে হত্যা করে এক শ্বেতাঙ্গ। টেক্সাসের বিপণি বিতানে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ চলাকালে অফ-ডিউটিতে থাকা সৈনিক গ্লেনডন ওকলি ও আরেক ব্যক্তি নিজেদের জীবন বিপন্ন করে শিশুদের নিরাপদ জায়গায় নেয়ার চেষ্টা করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। ওয়ালমার্ট স্টোরে এক শ্বেতাঙ্গ তরুণের গুলিতে ২০ জন নিহত ও ২৬ জন আহত হন। স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেল কেটিএসএমকে ওই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে কিছু শিশুকে রক্ষায় তার প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরেছেন মার্কিন সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞ সৈনিক গ্লেনডন ওকলি। কেটিএসএমকে ওকলি জানান, এল পাসোর সিয়েরা ভিস্তা মলে তিনি একটি স্পোর্টস জার্সি কেনার সময় একটি শিশু ওই দোকানে দৌড়ে আসে আর বলে, পাশের ওয়ালমার্টের দোকানে এক ব্যক্তি গুলিবর্ষণ করছে। এরপর হেঁটে বের হয়ে দোকানটির ফুট লকারের কাছে যাওয়ার পর ‘ব্যাং’, ‘ব্যাং’ শব্দ শোনেন তিনি। সম্প্রতিই তিনি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছেন এবং অস্ত্রটি তার সঙ্গেই ছিল। তিনি বলেন, আমরা প্রশিক্ষিত, যখন গুলির শব্দ শুনবেন, তখন নিজের বন্দুক বের করে প্রথমে ভেবে নিবেন। এটি এমন একটি অনুভূতি যা ব্যাখ্যা করা যায় না। ওকলি জানান, তিনি পার্কিং লটের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করার সময় দেখতে পান ‘একদল’ শিশু তাদের অভিভাবক ছাড়াই দৌড়ে পালাচ্ছে। তাদের মধ্যে অনেকে কান্না করছে। এটি দেখে আমি যতজনকে পেরেছি তাদের বহন করে আমার সঙ্গে নিয়ে এসেছি। আমার দেখাদেখি আরেক ব্যক্তিও তাই করেছেন। কথা বলার সময় কেটিএসএমের প্রতিবেদকের কাছে ক্ষমা চেয়ে তিনি বলেন, আমি দুঃখিত। আমি কাঁপছি। ওকলি যখন ওয়ালমাটের পার্কিং লটে যান তখন সেখানে আরেকটি ঘটনা ঘটে। তিনি বলেন, যখন আমি বের হয়ে আসি আমার মনে হয় এক পুলিশ আমাকেই গুলিবর্ষণকারী বা সে ধরনের কিছু ভেবে নিয়েছে, তাই আমার অস্ত্রের একটিও গুলি খরচ হয়নি এটি তাকে দেখাতে বাধ্য হই। তিনি জানান, ওই মুহূর্তে তিনি নিজের চেয়েও ওই শিশুদের নিয়ে বেশি উদ্বিগ্নবোধ করছিলেন। তিনি বলেন, আমি ভাবছিলাম যদি আমার সন্তান, যদি আমার একটি এ ধরনের বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে থাকত, তবে আরেকজনের কাছে আমি কি আশা করতাম। ওয়ালমার্টের স্টোরে বন্দুকধারীর গুলিতে ২০ জনের প্রাণহানির কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ওহায়ওতে একই ধরনের হামলা হয়েছে। অঙ্গরাজ্যের অরেগন ডিস্ট্রিক্টের ডেটনে একটি পানশালার বাইরে এক বন্দুকধারীর এলোপাতাড়ি গুলিতে নয়জন এবং পরে পুলিশের পাল্টা গুলিতে হামলাকারী নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত অন্তত ১৬ জনকে বিভিন্ন হাসপাতালে নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডেটন পুলিশের এ্যাসিসট্যান্ট চিফ লেফটেন্যান্ট কর্নেল ম্যাট কারপার। জরুরী সেবার গাড়িগুলোও সেখানে অবস্থান নিয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তা ম্যাট জানান, ঘটনার পরপরই টহল পুলিশের সদস্যরা অল্প সময়েই বন্দুকধারীকে হত্যা করে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম এল পাসো টাইমস বলছে, গুলিবিদ্ধ অন্তত ১১ জনকে চিকিৎসার জন্য শহরের ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল সেন্টারে নেয়া হয়েছে। এল পাসোর মেয়র ডি মারগো বলেন, এটা একটা ভয়ানক ঘটনা, যা এল পাসোয় ঘটবে বলে আমরা কখনও ভাবিনি। ঘটনাস্থলে ভয়ঙ্কর দৃশ্যের অবতারণা হয়। আহত অনেকের জীবনের ঝুঁকি রয়েছে। আমার কান্না পাচ্ছে। টেক্সাসের এ্যাটর্নি জেনারেল কেন প্যাক্সটন জানান, ওই যুবক কেন এই হামলা চালিয়েছে। তা তদন্ত করা হচ্ছে। টেক্সাসের গবর্নর গ্রেগ এ্যাবোট এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, প্রাণহানির দিক থেকে টেক্সাসে ২০১৭সালের পর এটাই সবচেয়ে ভয়াবহ গুলিবর্ষণের ঘটনা। টেক্সাসের বন্দুকধারী ক্রাইস্টচার্চ হামলার সমর্থক ॥ টেক্সাস হামলাকারী একজন বর্ণবাদী। মার্কিন গণমাধ্যম জানিয়েছে, তার নাম প্যাট্রিক ক্রুসিয়াস। সে মূলত লাতিন আমেরিকান বিদ্বেষী। হামলার আগে অনলাইনে পোস্ট করা এক ‘ইশতেহারে’ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে হামলাকে সমর্থন জানায় সে। এছাড়া, হামলাকারী বিভিন্ন টুইটেও লাতিন আমেরিকান অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াত। ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ প্রচার করে এমন অনলাইন গ্রুপে সে এ্যাকটিভ ছিল। ওই যুবক একাই এই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছেন। টেক্সাসের কংগ্রেসম্যান জেফ লি এক টুইটে জানান, সন্দেহভাজন হামলাকারী ২০১৭ সালে প্ল্যানো সিনয়র হাইস্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েট। ওহায়ওর হামলাকারী ছিল বর্ম পরিহিত ॥ ওহায়ও অঙ্গরাজ্যের দাটোন শহরের হামলাকারী ছিল বর্ম পরিহিত। রবিবার প্রথম প্রহরে চালানো ওই বন্দুক হামলায় অন্তত নয়জন নিরপরাধ ব্যক্তি নিহত ও ২৭ জন আহত হয়। মন্টগোমেরি কাউন্টি ইমার্জেন্সি সার্ভিসের মুখপাত্র ডেব ডেকার বলেন, ওহায়ওর হামলাকারী ছিল বর্ম পরিহিত। দাটোনের উপ-পরিচালক ও সহকারী পুলিশ প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল ম্যাট জানান, হামলাকারীকে নিবৃত্ত করতে গিয়ে কোন কর্মকর্তা আহত হননি। স্থানীয় নেড পিপারস বার সংলগ্ন এলাকায় এ হামলা চালানো হয়। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে পোস্ট করা ভিডিওতে দেখা গেছে, রাস্তায় বন্দুকের শব্দের মধ্যেই মানুষ দৌড়ে পালাচ্ছে। বার কর্তৃপক্ষের এক বিবৃতিতে জানান হয়েছে, তাদের সব স্টাফ নিরাপদ রয়েছে। রবিবার ভোরে দাটোন পুলিশ বিভাগের এক টুইট বার্তায় লেখা হয়, হামলা শুরুর সময়ে কাছাকাছি স্থানে আমাদের কর্মকর্তারা ছিলেন। তারা শীঘ্রই এর অবসান ঘটান। সহকারী পুলিশ প্রধান ম্যাট কারপার সাংবাদিকদের বলেন, টহলে থাকা পুলিশ কর্মকর্তারা সন্দেহভাজন হামলাকারীকে হত্যা করতে সমর্থ হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতির জন্য আমাদের কর্মকর্তারা খুব ভালভাবে প্রশিক্ষিত। হামলার সময়ে কাছাকাছি পুলিশ কর্মকর্তাদের উপস্থিত থাকার ঘটনা খুবই সৌভাগ্যজনক। সন্দেহভাজন ওই হামলাকারীর পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। পুলিশ কর্মকর্তা ম্যাট বলেন, হামলার উদ্দেশ্য উদঘাটনে তারা তৎপর রয়েছেন। টেক্সাস হামলা অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস- এফবিআই ॥ ওয়ালমার্টে বন্দুকধারীর গুলিতে ২০ জন নিহত হওয়ার ঘটনাকে ‘অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস’ বলছে মার্কিন সংস্থা এফবিআই। এই সূত্র ধরে তদন্ত এগোবে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা। যুক্তরাষ্ট্রে যত বন্দুক হামলা ॥ ২০১৭ সালে লাস ভেগাসে সঙ্গীত উৎসব চলার সময় বন্দুকধারীর গুলিতে ৫০ জনেরও বেশি নিহত হন। আহত হন ২০০ জনেরও বেশি মানুষ। ২০১৬ সালে অরলান্ডো রাজ্যের অরল্যান্ডো শহরে সমকামীদের নৈশক্লাবে ঢুকে গুলি চালিয়ে ৪৯ জনকে হত্যা করে এক বন্দুকধারী। পুলিশের গুলিতে পরে নিহত হয় সে। ২০১৫ সালে স্যান বার্নাডিনোয় নববিবাহিত এক মুসলিম দম্পতি একটি অফিসের ক্রিসমাস পার্টিতে গিয়ে গুলি করে ১৪ জনকে হত্যা করে। এতে গুলিবিদ্ধ হয় আরও ২২ জন। পরে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় ওই দম্পতি। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটন নৌবাহিনীর সদর দফতরে ঢুকে সাবেক এক কর্মী এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। এতে নিহত হয় ১২ জন। সেখানকার কর্মকর্তাদের গুলিতে তিনি নিহত হন। এছাড়া ২০১২ সালের ডিসেম্বরে কানেকটিকাটের নিউটাউনে ২০ বছর বয়সী এক তরুণ নিজের মাকে গুলি করে হত্যা করে। মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন তরুণটি তার মাকে হত্যা করার আগে স্যান্ডি হুক এলিমেন্টারি স্কুলে গুলি চালিয়ে ছয়-সাত বছরের ২০ জন শিক্ষার্থী এবং ৬ জন শিক্ষককে হত্যা করে। পরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় সে।
×