ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কর্মসংস্থানমুখী, প্রবৃদ্ধি সহায়ক ও সঙ্কুলানমুখী

সতর্ক মুদ্রানীতি ঘোষণা

প্রকাশিত: ১০:৫৫, ১ আগস্ট ২০১৯

সতর্ক মুদ্রানীতি ঘোষণা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য কমিয়ে চলতি অর্থবছরের পুরো মেয়াদের জন্য সতর্ক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গবর্নর ফজলে কবির বলেছেন, ভাল মানের ঋণের অভাবেই বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবাহ কমে গেছে। যদি ভাল ঋণ বাড়ে তাহলে আমরা এ খাতের ঋণ প্রবাহের লক্ষ্য বাড়িয়ে দেব। নতুন এ মুদ্রানীতিকে কর্মসংস্থানমুখী, প্রবৃদ্ধি সহায়ক ও সঙ্কুলানমুখী মুদ্রানীতি বলেছেন গবর্নর। রাজধানীর মতিঝিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্মেলন কক্ষে বুধবার ২০১৯-২০ অর্থবছরের এই মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন গবর্নর। এতদিন বছরে দুটি মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক এখন থেকে পুরো অর্থবছরের জন্য একবারই মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে বলে জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে। নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবাহে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। গত অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতিতে এই লক্ষ্য ছিল ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। গবর্নর ফজলে কবির বলেন, ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হলেও অর্জিত হয়েছে ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। তা থেকে বাড়িয়ে এবার ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আশা করা হচ্ছে। গবর্নর বলেন, বাজেটে ঘোষিত মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশে পরিমিত রেখে ৮ দশমিক ২০ শতাংশ প্রকৃত জিডিপি অর্জনের জন্য পর্যাপ্ত ঋণ প্রসার সঙ্কুলানের লক্ষ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছরে মুদ্রানীতির নীতিভঙ্গি আগেকার মতোই সতর্কভাবে সঙ্কুলানমুখী রয়েছে। নতুন মুদ্রানীতিতে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবাহ ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এর মধ্যে ডিসেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত লক্ষ্য ঠিক করেছে ১৩ দশমিক ২ শতাংশ। যা গেল অর্থবছরের জুন পর্যন্ত লক্ষ্য ছিল ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের (জুলাই-জুন) পর্যন্ত সরকারী খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। আর অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয় ১৫ দশমিক ৯০ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বেসরকারী খাতের ঋণ প্রবাহের প্রক্ষেপণ ছিল সাড়ে ১৬ শতাংশ। কিন্তু গত জুন শেষে এ খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১১ দশমিক ৩০ শতাংশ। এটি গত অর্থবছরের ঘোষিত মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৫ শতাংশ কম। ফেডারেল রিজার্ভ সুদহার কমানো হচ্ছে এবং ইইউএস- চায়না ও ব্রেক্সিট ইস্যুতে মুদ্রানীতিতে কোন ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে গবর্নর বলেন, ফেডারেল রিজার্ভ সুদ হার কমাতে যাচ্ছে এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গুঞ্জন শুরু হয়েছে আমাদের মুদ্রানীতিতে তার প্রভাব দেখতে আরও কিছু সময় লাগবে। তবে নীতিবাচক প্রভাবের চাইতে ইতিবাচক প্রভাবই বেশি পড়তে পারে। বর্তমান তারল্য সঙ্কটে রেপো রেট, সিআরআর ও এসএলআর রেটটা কমাবেন কি না এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এসএলআর সিআর আর এ মুহূর্তে পরিবর্তনের দরকার নেই কেননা এ রেটটা স্থীতিশীল রাখার জন্যই তো মুদ্রানীতি করা হয়। পলিসি রেট যদি মার্কেটের মতো পরিবর্তন হতেই থাকে তাহলে এটা কি করে পলিসি রেট হলো। তারল্য সঙ্কটের কারণে ঋণ প্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়েছে কী না এমন প্রশ্নের জবাবে গবর্নর ফজলে কবির বলেন, ব্যাংকিং খাতে তারল্য সঙ্কট নেই বরং ৮৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা অতিরিক্ত তারল্য আছে। তারল্যের মিসম্যাচ রয়েছে। অর্থাৎ কোন ব্যাংকে বেশি রয়েছে আবার কোন ব্যাংকে কম রয়েছে। তিনি বলেন, বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবাহের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা বাজেটের ঘোষিত ৮ দশমিক ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে যথেষ্ট। চলতি অর্থবছরের জুনে বেসরকারী খাতে ঋণ বেড়েছে ১১ দশমিক ৩০ শতাংশ কিন্তু প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। অর্থাৎ নি¤œতর জোগানের পরও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে উচ্চতর জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। এই অর্জন দেশের ঋণবাজারের সঙ্গে মধ্যম আয় দেশের ঋণবাজারের তুলনীয় পরিপক্কতা আসার শুভ সূচনার ইঙ্গিত দেয়। তিনি বলেন, অতি উৎসাহী কিছু কিছু ব্যাংকের প্রশ্নযোগ্য মানের ঋণ সৃষ্টির প্রবণতা থেকে ঋণবাজারে আসা আকস্মিক তেজী প্রবণতা সংযত হওয়ায় বাংলাদেশের বেসরকারী খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি এখন দক্ষিণ ও পূর্ব এশীয় অঞ্চলের দ্রুত প্রবৃদ্ধিশীল উদীয়মান বাজার অর্থনীতিগুলোর সঙ্গে তুলনীয় ধারায় এসেছে। তার মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক গুণগত মানসম্পন্ন ঋণ বিতরণে গুরুত্ব দেয়ায় ব্যাপক হারে ঋণ বৃদ্ধি কমেছে কিন্তু প্রয়োজনীয় ঋণ বিতরণ হয়েছে। গবর্নর আরও বলেন, উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে নতুন বিনিয়োগ কর্মকা- জোরদার করার প্রয়োজন হবে। সে লক্ষে ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশী টাকার প্রয়োজনীয় প্রতিযোগিতামূলক হার বজায় রাখার পদক্ষেপ অব্যাহত থাকবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতির প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমলেও গত অর্থবছরের চেয়ে স্বস্তিকর অবস্থায় থাকবে। ঋণের গড় সুদ হার কমে আসারও দাবি করেন গবর্নর। তিনি বলেন, এটা আরও কমিয়ে আনতে খেলাপী ঋণ কমানো এবং নতুন খেলাপী ঋণ সৃষ্টি এড়ানোর ওপর মুদ্রানীতিতে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এজন্য গুণগতমানের ঋণ বিতরণের ওপর জোর দেয়া হয়েছে মুদ্রানীতিতে। দেশে প্রবৃদ্ধি যে হারে হচ্ছে সে হারে বাংলাদেশে কর্মসংস্থান হচ্ছে না কেন জবাবে তিনি বলেন, আমাদের প্রবৃদ্ধি সাপোর্ট করা মানেই কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। সব সেক্টরগুলোতেই লক্ষ্য করেন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যেমন শিল্প মাধ্যমে আমাদের ৩৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে সুতরাং প্রবৃদ্ধির সঙ্গে কর্মসংস্থান সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছেনা কথাটা সত্য নয়। ইতোমধ্যে মার্কেটে তারল্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে এমন সময় নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারী খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমিয়ে ধরা হয়েছে । এ মুহূর্তে এ খাতের প্রবৃদ্ধি অর্জনে পলিসিটা কি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে আমাদের বেসরকারী খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৩। এ দিয়ে আমরা দেখেছি যে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ১৭ শতাংশ অর্জন করা যথেষ্ট হয়েছে। বছরে এক হাজার ডলার পাঠালে মিলবে রেমিটেন্সে প্রণোদনা ॥ বছরে এক হাজার ডলার রেমিটেন্স দেশে পাঠালেই প্রবাসী বাংলাদেশীরা ২ শতাংশ প্রণোদনার সুবিধাভোগী হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিষয়টির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ডেপুটি গবর্নর আহমেদ জামাল বলেন, প্রবাসী বাংলাদেশীদের বৈধপথে রেমিটেন্স পাঠাতে সরকার যে প্রণোদনা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে, তার আলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে একটি নীতিমালা করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠানো হয়েছে। বছরে একবারই মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে ॥ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য আলাদাভাবে মুদ্রানীতি ঘোষণার ‘বিশেষ তাৎপর্য নেই’ মন্তব্য করে এখন থেকে বছরে একবারই মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ফজলে কবির জানিয়েছেন।
×