ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জেএমআই নামে ভারতে জঙ্গী সংগঠন গড়ে তুলেছে?

পুরস্কার ঘোষিত ফাঁসির আসামি জঙ্গী নেতা সালেহীন কোথায়

প্রকাশিত: ১০:০৫, ৯ জুলাই ২০১৯

পুরস্কার ঘোষিত ফাঁসির আসামি জঙ্গী নেতা সালেহীন কোথায়

শংকর কুমার দে ॥ বাংলাদেশ ও ভারত-দুই দেশের মোস্ট ওয়ান্টেড ও পুরস্কারঘোষিত জঙ্গী নেতা সালাউদ্দিন ওরফে সালেহীন আবারও আলোচনায়। বাংলাদেশের এই জঙ্গী নেতা ভারতে গিয়ে জামায়াতুল মুজাহিদীন ইন্ডিয়া- জেএমআই নামে জঙ্গী কার্যক্রম শুরুর পর থেকেই তাকে গ্রেফতারের জন্য হন্যে হয়ে খুঁজছে দুই দেশের গোয়েন্দারা। বাংলাদেশে এই জঙ্গী নেতার বিরুদ্ধে ৪০ মামলা দায়ের হয়েছে, যার কয়েকটি মামলার বিচারে মৃত্যুদন্ড, যাবজ্জীবন ও বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার পর ভারতে পালিয়ে গিয়ে সে দেশের জঙ্গী সংগঠন গড়ে তুলেছে সালেহীন। জঙ্গী নেতা সালেহীন প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে নাকি ভারতে পালিয়ে বেড়াচ্ছে কিংবা কোথায় আত্মগোপন করে আছে। সেই হদিস জানতে চিঠি চালাচালি করেছে বাংলাদেশ ও ভারতের গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, পাঁচ বছর আগে ’১৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজনভ্যানে গ্রেনেড ও বোমা হামলা চালিয়ে গুলি করে এক পুলিশকে হত্যা করে জেএমবির ৩ শীর্ষ নেতাকে ছিনিয়ে নেয়া জঙ্গীদের অন্যতম সালাউদ্দিন ওরফে সালেহীন। ভারতীয় পুলিশের বরাত দিয়ে সম্প্রতি হিন্দুস্থান টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সালেহীন ও মিজান ভারতে জামায়াতুল মুজাহিদীন ইন্ডিয়া-জেএমআই নামে জঙ্গী কার্যক্রমের বিস্তৃতি ঘটিয়েছে। সংগঠনের কথিত মিডিয়া উইং ‘শাম আল হিন্দে’ প্রকাশিত এক সাক্ষাতকারে জেএমআইর আমির হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছেন সালেহীন। ওই সাক্ষাতকার থেকে সালেহীনকে উদ্ধৃত করে হিন্দুস্থান টাইমসের রিপোর্টে বলা হয়, ভারত যাতে হিজরত আর জিহাদের একটি কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হয়, সেজন্য আমরা কাজ করছি। ভারতের মানুষ নতুন খিলাফতের ভিত্তি গড়তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সালেহীনের সাক্ষাতকারভিত্তিক প্রতিবেদন প্রকাশের পর ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার হদিস জানতে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে চিঠি দিয়েছে। এরপরই নড়েচড়ে বসেছেন বাংলাদেশ ও ভারত-দুই দেশেরই গোয়েন্দারা। জেএমবি ১৪ বছর আগে ২০০৫ সালে যাদের নেতৃত্বে সারাদেশে একযোগে বোমা হামলা চালানো হয়েছিল, তাদের কয়েকজনের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে, অনেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত হয়েছে, কেউ কেউ ধরা পড়ে কারাগারে। কিন্তু ফাঁসির আসামি সালাউদ্দিন সালেহীন ওরফে সানি এখনও রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। জেএমবির প্রতিষ্ঠাকালীন শূরা সদস্য সালেহীনকে ধরিয়ে দিতে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে বাংলাদেশের পুলিশ। ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএ তাকে রেখেছে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ অপরাধীদের তালিকায়। ওখানে হাফিজুর রহমান শেখ ওরফে মাহিন নামেও সে নিজেকে পরিচিত করেছে বিভিন্ন সময়ে। এই সালেহীনই ত্রিশালে পুলিশ ভ্যান থেকে পালানো আরেক জঙ্গী জাহিদুল ইসলাম মিজান ওরফে বোমা মিজানকে সঙ্গে নিয়ে ভারতে জেএমবির নতুন শাখা খুলেছে, যার নাম দেয়া হয়েছে জামায়াতুল মুজাহিদীন ইন্ডিয়া-জেএমআই। বিহারের বুদ্ধগয়া ও পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে বোমা বিস্ফোরণ মামলার আসামি বোমা মিজান গত ৬ আগস্ট ব্যাঙ্গালুরুতে এনআইএর এক অভিযানে ধরা পড়ে। কিন্তু ভারতীয় গোয়েন্দারাও সালেহীন সম্পর্কে আরও জানতে চাইছেন। জেএমবির শুরুর দিকের শূরা সদস্য এই সালাউদ্দিন সালেহীন ওরফে সানি না’গঞ্জের রফিকুল ইসলামের ছেলে। দেশের বিভিন্ন থানায় সালেহীনের বিরুদ্ধে চল্লিশের বেশি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ১৩ মামলায় তার সাজা হয়েছে। তিনটিতে হয়েছে মৃত্যুদন্ড। ১৯৯৭ সালে বন্দর বিএম ইউনিয়ন স্কুল পাসের পর সালেহীন ঢাকার তেজগাঁও পলিটেকনিকে ভর্তি হয়। তখন সে ছিল ইসলামী ছাত্রশিবির কর্মী। সে সময় থেকেই সে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকে, এক পর্যায়ে জড়িয়ে পড়ে জঙ্গীবাদে। ২০০৬ সালের ২৫ এপ্রিল চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর নিম্ন আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে সালেহীন নিজের কর্মকান্ডের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়। সেই থেকে জেএমবির সূচনা ও এর বিস্তার সম্পর্কে মোটামুটি স্পষ্ট একটি ধারণা পায় পুলিশ। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে সালেহীন জানায়, ১৯৯৯ সালে বেনামে বাসাবোর কদমতলায় একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করি। শায়খ আব্দুর রহমান, আমি, হাফেজ মাসুদ, শাহেদ ও রানা প্রথম মজলিসে শূরার সদস্য হই। পরে শাহেদ ও রানা দল ত্যাগ করলে সেখানে অন্য দুজনকে নিয়োগ দেয়া হয়। ২০০১ সালে সংগঠনের নাম রাখা হয় জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ- জেএমবি। সালেহীন আদালতে বলে, ২০০১ সালের পর কাজের সুবিধার্থে সারাদেশকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেই। ঢাকার উত্তর অঞ্চল তথা ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জের দায়িত্ব পড়ে তার ওপর। পরে ২০০২ সালে সিলেটের দায়িত্বও দেয়া হয় তাকে। ’১৩ সালে জামালপুরের একটি হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায়ে সালেহীনের মৃত্যুদন্ড হয়। গনি গোমেজ নামে ধর্মান্তরিত আরেক খ্রিস্টানকে হত্যার দায়ে হাইকোর্ট সালেহীনসহ দুই জঙ্গীকে মৃত্যুদন্ড দেয় একই বছর। আদালতের রায়ে মৃত্যুদন্ড হলেও তার বিরুদ্ধে আপীল করেনি সালেহীন। বরং দেশের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। ’১৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে ছিনিয়ে নেয়া হয় সালাউদ্দিন সালেহীনসহ তিন জঙ্গীকে। ২০০৬ সালে মুক্তাগাছা থানার একটি বিস্ফোরণ মামলায় শুনানির জন্য গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে সালেহীনসহ তিন জঙ্গীকে নিয়ে ময়মনসিংহ আদালতে যাওয়ার পথে ’১৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ত্রিশালে জঙ্গীদের হামলার মুখে পড়ে পুলিশের প্রিজন ভ্যান। ওই ঘটনায় এক পুলিশকে হত্যা করে তিন শীর্ষ নেতাকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় জেএমবি জঙ্গীরা। বাকি দুজন হলো ফাঁসির আসামি রাকিবুল হাসান ওরফে হাফেজ মাহমুদ ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমা মিজান। পালানোর পথে সেদিনই মির্জাপুরে গ্রেফতার হয় রাকিবুল হাসান। পরে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়। বাকি দুজনের কোন খোঁজ না পেয়ে বাংলাদেশের পুলিশ তাদের ধরিয়ে দেয়ার জন্য পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে।
×