ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

একমাত্র আসামি মাহবুবের মৃত্যুদন্ড

প্রকাশিত: ১০:৫৮, ২৮ জুন ২০১৯

 একমাত্র আসামি মাহবুবের মৃত্যুদন্ড

বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় দানবীর রণদা প্রসাদ (আরপি) সাহা ও তার ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহা সহ ৬০ জনকে হত্যার মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযোগে একমাত্র আসামি টাঙ্গাইলের মোঃ মাহবুবুর রহমানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেছে ট্রাইব্যুনাল। আসামির বিরুদ্ধে অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন, হত্যা-গণহত্যার তিন অভিযোগেই সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদন্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ বৃহস্পতিবার এ রাঘ ঘোষণা করেন। উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে গত ২৪ এপ্রিল রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমান (সিএভি) রাখা হয়। এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ৩৮তম রায়। রায় ঘোষণার সময় চীফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, সংশ্লিষ্ট মামলার প্রসিকিউটর রানা দাসগুপ্তসহ অন্যান্য প্রসিকিউটর উপস্থিত ছিলেন। আরও উপস্থিত ছিলেন দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার সঙ্গে নিহত ভবানী প্রসাদ সাহার স্ত্রী শ্রীমতি সাহা, ছেলে রাজিব প্রসাদ সাহা ও মহাবীর পতি সহ কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের বেশ কয়েকজন।আরপি সাহা হত্যা মামলায় রায়ে প্রসিকিউশন পক্ষ সন্তোষ প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে আসামি পক্ষ রায়ে খুশি হতে পারেনি। তারা এ রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করবে। ২৩৫ পৃষ্ঠার রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেছে, আসামির বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা তিনটি অভিযোগই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন, হত্যা-গণহত্যার তিন অভিযোগেই মাহবুবুরকে সর্বোচ্চ সাজা দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। গত নয়বছরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত ৩৮টি মামলায় মৃত্যুদ- প্রদান করেছে ৬০ জনকে। আমৃত্যু কারাদন্ড প্রদান করা হয়েছে ২৪ জনকে। আর একজনকে যাবজ্জীবন করাদন্ড প্রদান, একজনকে ৯০ বছরের দ- একজনকে ২০ বছরের কারাদন্ড প্রাদন করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের দন্ডের বিরুদ্ধে আপীল বিভাগে ৭টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। যার মধ্যে ৬ জনের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে। আর একজনকে আমৃত্যু কারাদন্ড প্রদান করা হয়েছে। আপীলে মামলা থাকা অবস্থায় দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। বর্তমানে আপীল বিভাগে ২৯টি মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এর মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আল-বদর কমান্ডার জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের করা আপীলের যুক্তিতর্ক শুরু হবে ১ জুলাই। প্রসিকিউটর রানাদাশ গুপ্ত বলেন, রায়ে বলা হয়েছে আসামি মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগই প্রসিকিউশন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। রণদা প্রসাদ সাহা সারাজীবন মানবতার পক্ষে কাজ করেছেন। তাকে হত্যা করা, অপহরণ করা, তার ছেলেকে তুলে নিয়ে যাওয়া এবং হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় গণহত্যা চালিয়েছে পাকিস্তানের সেনাদের সহযোগিতায়। এ অপরাধে সঙ্গে ছিলেন মাহবুবুরের পিতা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুল ওয়াদুদ ও বড় ভাই মান্নান। এ দু’জনই মারা গেছেন। ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, তারা যে অপরাধ করেছেন তা গুরুতর। অন্যদিকে আসামির আইনজীবী গাজী এম এইচ তামিম বলেন, এই রায়ে তারা সংক্ষুব্ধ, তারা আপীল করবে। নিয়ম অনুযায়ী, রায়ের এক মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতে আপীল করার সুযোগ পাবেন আসামি মাহবুবুর রহমান। রাজীব সাহা তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আমাদের পরিবারের ওপর এটা একটা বোঝা হয়েছিল। আজ আমরা বিচার পেলাম। রণদা প্রসাদ সাহার পুত্রবধূ বলেন, অত্যাচারের বিচার পেয়ে, স্বাধীনতার এত বছর পর হলেও উত্তর পেয়েছে আগামী প্রজন্ম। বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা লজ্জাজনক, মর্মান্তক। আর সাহার মতে মহান একজন ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা এ রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। এবং সবার কাছে আশীর্বাদ চাই। যে অভিযোগ আনা হয় আসামির বিরুদ্ধে ॥ আসামির বিরুদ্ধে মোট তিনটি অভিযোগ আনা হয়। যার মধ্যে রয়েছে, মাহবুবুর রহমান একাত্তরের ৭ মে স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর গ্রামে যায়। সেখানে গিয়ে তারা রনদা প্রসাদ সাহা (আরপি সাহা) এবং তার ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহার খোঁজ করে। তাদের না পেয়ে তারা ৩৩ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। পরবর্তীতে একই তারিখে রাত ১১টার দিকে নারায়ণগঞ্জ থেকে আরপি সাহা ও ভবানী প্রসাদ সাহাসহ ৫ জনকে অপহরণ ও হত্যা করে। অন্যদিকে আসামিসহ রাজাকাররা ২৪ জন নিরীহ মানুষকে আটক করে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তার মধ্যে ২২ জনকে হত্যা করা হয়। সব মিলিয়ে তিনটি অভিযোগে মোট ৬০ জনকে হত্যা করা হয়। মামলার বিবরণ ॥ ২০১৭ সালের ২ নবেম্বর এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনে দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা মোঃ আতাউর রহমান। তার আগে এক সংবাদ সম্মেলনে তদন্ত প্রতিবেদন সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খান ও জ্যেষ্ঠ সমম্বয়ক সানাউল হক। হান্নান খান তখন বলেছিলেন, আসামি মাহবুবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মে মধ্যরাতে নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ২০-২৫ জন সদস্যকে নিয়ে রণদা প্রসাদ সাহার বাসায় হামলা চালায়। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রসিকিউশনের দেয়া অভিযোগপত্র আমলে নেয়ার পর ২৮ মার্চ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। এক বছরের বেশি সময় শুনানির পর গত ২৪ এপ্রিল মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান (সিএভি) রাখা হয়।রাষ্ট্রপক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত। আসামিপক্ষে ছিলেন গাজী এম এইচ তামিম। কে এই আরপি সাহা ॥ মানবহিতৈষী কাজে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত থাকায় ব্রিটিশ সরকার রায় বাহাদুর খেতাব দিয়েছিল রণদা প্রসাদ সাহাকে। মানবসেবায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিসরূপ স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালে সরকার তাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক দেয়। তিনি আর পি সাহা নামেও সমধিক পরিচিত। রণদা প্রসাদ সাহার পৈত্রিক নিবাস ছিল টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে। সেখানে তিনি একাধিক শিক্ষা ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এক সময় নারায়ণগঞ্জে পাটের ব্যবসায় নামেন রণদা প্রসাদ সাহা; থাকতেন নারায়ণগঞ্জের খানপুরের সিরাজদিখানে। ওই বাড়ি থেকেই তাকে, তার ছেলে ও অন্যদের ধরে নিয়ে যায় আসামি মাহবুবুর রহমান ও তার সহযোগীরা। রণদা প্রসাদ সাহার পৈত্রিক নিবাস ছিল টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে। কিশোর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতা গিয়ে কুলি, মজুর, ফেরিওয়ালার কাজে কাটে তার প্রথম যৌবন। এক পর্যায়ে স্বদেশী আন্দোলনে জড়িয়ে কারাগারে যান। তার চাকরিজীবন শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বেঙ্গল এ্যাম্বুলেন্স কোরের সদস্য হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্রে আহত ও অসুস্থদের সেবা দেয়ার মধ্যে দিয়ে। যুদ্ধ শেষে রেলওয়ের টিকেট কালেক্টরে চাকরি পান তিনি। ১৯৩২ সালে ওই চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার সময় পাওয়া অর্থ দিয়ে শুরু করেন ব্যবসা। প্রথমে লবণ ও কয়লার ব্যবসা শুরু করলেও পরে ঠিকাদারি ব্যবসায় বড় আকারের পুঁজি সংগ্রহ করেন রণদা প্রসাদ। এক পর্যায়ে তিনি বেশ কিছু লঞ্চের মালিক হয়ে যান এবং সেসব নৌযান মেরামতের জন্য গড়ে তোলেন নারায়ণগঞ্জের প্রথম ডকইয়ার্ড। ১৯৪০ সালে তিনি নারায়ণগঞ্জে জর্জ এ্যান্ডারসনের পাটের ব্যবসা কিনে নেন। ১৯৪৩ সালে টাঙ্গাইলে কুমুদিনী কলেজ এং ১৯৪৬ সালে মানিকগঞ্জে বাবার নামে দেবেন্দ্র কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৭ সালে গঠন করেন ‘কুমুদিনী ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল। ১৯৭১ সালে ৭ মে পাকিস্তানী হানাদারদের দোসর রাজাকার- আল-বদররা নারায়ণগঞ্জ থেকে রণদা প্রসাদ ও তার পুত্র ভবানী প্রসাদকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর তাদের আর কোন খোঁজ মেলেনি। ধারণা করা হয় সেই দিনই তাকে হত্যা করা হয়। পাক হানাদার বাহিনীর দোসররা স্বামী ও সন্তানকে ধরে নেয়ার পর থেকেই শোকে শয্যাশায়ী হন দানবীর রণদা প্রসাদের স্ত্রী কিরণবালা দেবী। শেষ জীবনে তিনি নির্বাক হয়ে যান। দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী থাকার পর ১৯৮৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পরলোকগমন করেন তিনি। দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ২০১৫ সাল থেকে কুমুদিনী কল্যাণ সংস্থা ‘দানবীর রণদা স্মৃতি স্বর্ণপদক’ চালু করেছে।
×