ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বড়বাজারের বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে মাথাভাঙ্গা নদীর পানি

প্রকাশিত: ১০:০২, ১৮ জুন ২০১৯

বড়বাজারের বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে মাথাভাঙ্গা নদীর পানি

রাজীব হাসান কচি ॥ চুয়াডাঙ্গা বড়বাজার গোশতপট্টির পশু ও মুরগির রক্ত-বর্জ্য পচে মাথাভাঙ্গা নদীর পানি দূষণের পাশাপাশি উৎকট দুর্গন্ধে ব্যবসায়ী, ক্রেতাসহ নদীর দু’পাড়ে বসবাসকারীদের মারাত্মক স্বাস্থ্যহানি ঘটছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, স্থানীয় পৌরসভা ও সিভিল সার্জনের কাছে লিখিত অভিযোগ করেও প্রতিকার মিলছে না। ফলে পরিবেশ বিপর্যস্ততার পাশাপাশি এলাকাবাসীর শ্বাসকষ্ট, শরীরের ভেতরে ইনফেকশন, পেটের পীড়া, চর্মরোগসহ বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা না নেয়া হলে এলাকায় ব্যাপক স্বাস্থ্যহানি ঘটার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগ। চুয়াডাঙ্গা বড়বাজারের মাথাভাঙ্গা নদীর তীরে ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় গোশত, মাছ, সবজি ও মুদি বজার। প্রবেশ মুখেই সপ্তাহের প্রতি শনিবার ও মঙ্গলবার বসে পানের হাট। প্রধান সড়কের পাশে বসে মৌসুমি ও বিদেশী ফলের বাজার। এ বাজারে বিশেষ করে গোশত পট্টিতে রয়েছে অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা। একটি মাত্র ড্রেন দিয়ে শহর ও বাজারের ময়লা পানি, রক্ত-বর্জ্য গিয়ে মাথাভাঙ্গা নদীর পানি দূষণ করছে। চুয়াডাঙ্গা শহরতলী দৌলাতদিয়াড় নদীপাড়ে বসবাসকারী গৃহিনী নূরজাহান বলেন, বড়বাজারের জবাই করা পশুর রক্ত-বর্জ্য নদীর পানি দূষণ করছে। নোংরা পানিতে গোসল করার কারণে গায়ে চুলকানি হচ্ছে। বাতাসে এত দুর্গন্ধ যে বাড়িতে বসবাস করাই দুষ্কর হয়ে পড়েছে। গরুর গোশত ব্যবসায়ী মাসুদ রানা জানান, বাজারে কসাইখানায় পর্যাপ্ত পানি ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই। বাজারে এত দুর্গন্ধ যে ক্রমেই ক্রেতা কমে যাচ্ছে। এছাড়া বাজারের আশপাশের বাড়িতে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ায় বাড়ির মহিলারা প্রতিদিনই অভিযোগ করেন। খাসির গোশত ব্যবসায়ী হাসান বলেন, বর্জ্যগুলো ফেলার নির্দিষ্ট জায়গা না থাকায় সেগুলো নদীর পাশেই ফেলতে হয়। বাজারের পাশে মেথর পট্টির একপাল শূকর সব সময় বর্জ্য স্তূপ ঘাঁটাঘাঁটির করে দুর্গন্ধের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। যে খদ্দের আসে তারা গোশত কিনতে অস্বস্তি বোধ করে। মুরগির গোশত ব্যবসায়ী বাবু শেখ জানান, মুরগি জবাইয়ের পর পালক নাড়িভুঁড়ি রাখার একটি নির্দিষ্ট জায়গা করে দিলে দুর্গন্ধের মাত্রা অনেক কমে আসবে। এটার বিষয়ে কেউ কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না। সে কারণে বাজারে দুর্গন্ধ বেড়েই চলেছে। ক্রেতা রবিউল মালিতা বলেন, উৎকট গন্ধের কারণে বাজারে বেশ কিছুক্ষণ অবস্থান করে বাজার করা সম্ভব হয়না। বাজারের বাতাসে এতটাই উৎকট গন্ধ যে, এখানে স্বস্তির সঙ্গে কেনাকাটা করতে পারছি না। গোশত শ্রমিক লুৎফর রহমান জানান, বাজারে একটি মাত্র টিনশেড পিলখানা (জবেহ খানা) হিসেবে ব্যবহার করতে হচ্ছে। এখানে নেই পর্যাপ্ত পানি ও বর্জ্য ফেলার ব্যবস্থা। তাছাড়া বেশ কিছু দিন হলো বাজারের পায়খানার স্লাব ভেঙ্গে যাওয়ায় সেখান দিয়ে মলমূত্র বের হয়ে পরিবেশ আরও দূষণ করছে। পান ব্যবসায়ী মুক্তার আলী বলেন, বাজারে এত দুর্গন্ধ যে, আমরা ব্যবসা করতে পারছিনা। খুব কষ্ট করে এখানে পান বেচাকেনা করতে হচ্ছে। নদীপাড়ের বাসিন্দা শুকুর আলী জানান, নদীর পানি এক সময় স্বচ্ছ ছিল, এখন বাজারে জবাই করা পশু ও মুরগির রক্ত-বর্জ্য পানিতে পড়ে পানি নোংরা হয়ে গেছে। নদীর পানিতে এখন গোসল করা যাচ্ছেনা। একই এলাকার বসিন্দা ফারুক হোসেন বলেন, বাজারের উৎকট গন্ধের কারণে এলাকা বসবাসের অনুপযোগীর বিষয়টি চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার মেয়র ও সিভিল সার্জনকে জানানো হয়েছে। কিন্তু তার কোন প্রতিকার পাওয়া যায়নি। নদীপাড়ের অপর বাসিন্দা মজিবুল জানান, দুর্গন্ধের কারণে এখানকার মসজিদে মুসল্লি ও তবলিগ জামাতের লোকজন আসতে চায় না। চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার সেনিট্যারি ইন্সপেক্টর নার্গিস জাহান বলেন, বাজারে নির্দিষ্ট নিয়মেই পশু জবাই করা হয়। বাজারে সর্বক্ষণিক কসাইখানা পরিদর্শক তার দায়িত্ব পালন করে। পশু জবাইয়ের পর গোশতে সিল মারার জন্যও একজন রয়েছে। এখানে পানির ব্যবস্থা অপ্রতুল রয়েছে। একটা টিউবওয়েল নষ্ট হলে তা সারাতে বেশ কিছু দিন লেগে যায়। বাজারে পৌরসভার শ্রমিক দিয়ে নিয়মিত বর্জ্য অপসারণ করা হয়। কিন্তু হরিজন সম্প্রদায়ের পোষা শূকর ময়লার স্তূপগুলো নাড়াচাড়া করে পরিবেশ নষ্ট করে দেয়। এ বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বাজারে আরও কিভাবে সেনিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায় আমরা তার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সেনিট্যারি ইন্সপেক্টর নার্গিস জাহানের কথায় দ্বিমত প্রকাশ করে গোশত ব্যবসায়ীরা জানান, সকাল থেকে পৌরসভার কোন কর্মচারী বাজারে উপস্থিত থাকে না। পৌরসভার কসাইখানা পরিদর্শক রহিদুল ইসলাম কোন দিনই তার দায়িত্ব পালন করেননা। কসাইরাই পশু জবাই করা গোশতে পৌরসভার সিল মেরে তা বিক্রি করে। বর্জ্য অপসারণকারীকে মাঝে মধ্যে দেখা গেলেও তিনি সর্বক্ষণিক তার দায়িত্ব পালন না করেই চলে যান। সেনিট্যারি ইন্সপেক্টর ও কসাইখানা পরিদর্শকের বিরুদ্ধে কসাইদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নেয়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ খায়রুল আলম বলেন, বাজারে গরু, ছাগল ও মুরগি জবাই করা রক্ত-পানি সব মাথাভাঙ্গা নদীর পানিতে মিশছে। বর্জ্য অপসারণের ভাল ব্যবস্থা না থাকায় রক্ত পচে যে দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয় তাতে জনস্বাস্থ্যের বিরাট ক্ষতি হচ্ছে। এখানে বায়ু ও পানিদূষণ হচ্ছে। বায়ুদূষণের কারণে শ্বাসকষ্ট ও শরীরের ভেতরে ইনফেকশন দেখা দেয় আর পানিদূষণের কারণে পেটের পীড়া ও চর্মরোগ হয়। বৈজ্ঞানিক পদ্বতিতে এখান থেকে বর্জ্য অপসারণ না করতে পারলে এ এলাকায় ব্যাপক স্বাস্থ্যহানি ঘটবে। চুয়াডাঙ্গা পৌসভার মেয়র ওবায়দুর রহমান চৌধুরী জিপু বলেন, সমস্যা সমাধানে বাজারে একটি আধুনিক মানের কসাইখানার প্রয়োজন। এজন্য ইতোমধ্যেই ইউজিপ-৩ এর দ্বিতীয় ফেজে একটি প্রকল্পের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। আশা করি এ প্রস্তাব পাস হয়ে আসবে। তখন আধুনিক মানের একটি কসাইখানা নির্মাণ করলে এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। চুয়াডাঙ্গা বড়বাজারের উৎকট দুর্গন্ধে ব্যবসায়ী, ক্রেতাসহ এলাকায় বসবাসরতদের নাকাল অবস্থা। তারা এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে চায়। তারা বলছেন, দ্রুত বর্জ্য অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হোক। পাশাপাশি প্রতিদিন জীবাণুনাশক ওষুধ ব্যবহার করে এলাকা জীবাণুমুক্ত করা হোক। করা হোক আধুনিক মানের কসাইখানা।
×