ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

তাল নিয়ে যত কথা

প্রকাশিত: ০৯:২১, ১ জুন ২০১৯

 তাল নিয়ে যত কথা

তাল নেমেছে। কাঁচাতাল। কেউ বলে তালের শাঁস। খাওয়ার মজা আলাদা। তালের সময়কে বেতাল করে দিয়ে একটু করে পাকা তালও নেমেছে। এলোমেলো হয়ে পড়া ঋতুতে তালের ক্ষির ফিরনি পায়েস পিঠাপুলির খাওয়ার সময়ও বুঝি এগিয়ে এলো। কচি তাল শাঁসের কদর গ্রামে ও শহরে আছে। তালখুর বা তালের শাঁস উপাদেয় খাবার। প্রবীণরা বলেন এর দ্রব্যগুণ ও ঔষধিগুণ দুইই আছে। সামজিক বিশ্লেষণ হলো, মৌসুমের ফল খেতে হয়। তবে তালের রস নিয়ে কথা আছে। এই সময়ে তালের রস গাছ চুইয়ে পড়ছে। সংগ্রহ করা টাটকা রস শরীরে ফিল্টারের কাজ করে। বিপাকে পড়তে হয় সংগৃহিত রস বিলম্বে পান করলে- তখন বেতালই নয় সমতল ভূমিকেও অসমতল দেখা যায়। এই অবস্থায় লোকজন বুঝতে পারে কি হয়েছে। বাংলায় বাগ্বিধিতে তাল আছে। জনজীবনে ‘তাল’ শব্দটি যে কতভাবে এসেছে...। ঋতু বৈচিত্র্যেও এসেছে তাল। গরমে তাপের মাত্রা বেড়ে গেলে বলা হয়, তাল পাকানোর গরম। প্রকৃতিই পি-াকৃতির সুপক্ব ফলটি পাকিয়ে ঘন লালচে রঙের করে দিতে তাপ বাড়িয়ে দেয়। তালপাতার কদরও কম নয়। তালপাতার পাখা গরমে স্বস্তির উপকরণ। এক সময় তালপাতায় বর্ণমালা লেখা হতো। ছিপছিপে গড়নের লম্বা মানুষকে দেখলে বলা হয় তালগাছ। তাল নিয়ে যে কত কথা...। কেউ উলটপালট কথা বললে, আনন্দে ধৈর্য্যচ্যুতি হয়ে কিছুটা অস্বাভাবিক আচরণ করলে বলা হয় ‘বেতাল হয়ে গিয়েছে’। গানের সময় তবলার তাল কেটে গেলে বলা হয়- তাল কেটে বেতাল হয়েছে। গায়ক সুরের থেই হারিয়ে ফেলে। কোন কাজে এলোমেলো কিছু করলে বলা হয় ‘তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে’। এক শ্রেণীর মানুষ কারও কাছে ভাল সেজে থাকতে তাল মিলিয়ে কথা বলেন। ভিলেজপলিটিকস্ থেকে শুরু করে সমাজ জীবনে, চাকরি জীবনে তাল মিলিয়ে চললে মন পাওয়া কঠিন নয়। মোসাহেবী করতে তাল মিলিয়ে চলা বাঞ্ছনীয়। তালগাছের আদি নিবাস আফ্রিকায়। বহুকাল আগে এই দেশে তার আগমন। বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন বোরাসুস ফ্লাবেলিয়ার। খুবই ধীরে বাড়ে। দীর্ঘ হয়ে ফল দিতে সময় নেয় অন্তত দশ বছর। বসন্তের শেষে ফুল ধরে। ফল পাকে শরতে। পোক্ত কান্ডের তালগাছ ঘরের শক্ত খুঁটি হিসাবে ব্যবহার হয়। তালের আঁশ দিয়ে হস্তশিল্পের নানা কিছু তৈরি হচ্ছে। কুটির শিল্পে পরিণত হয়ে রফতানি হচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তনে বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ায় হতাহতের থাবা থেকে মুক্তি পেতে দেশজুড়ে তালগাছ রোপণ অভিযান চলছে। বিশ্বের অনেক দেশ তাল গাছ রোপণ করে বজ্রপাত নিয়ন্ত্রণ করেছে। আফ্রিকার তাল তাল মিলিয়ে দাপটে আছে দেশে দেশে। গ্রামের সুন্দর দৃশ্য আঁকতে তালগাছ জুড়ে না দিলেই নয়। একটা সময় তালগাছ নেই এমন গ্রাম খুঁজে পাওয়া যেত না। তালগাছ ছিল গাঁয়ের কোন বাড়ি চেনার দিক নির্দেশক। গেল শতকের মধ্যভাগে গ্রামে তালগাছ কমে যাওয়া শুরু হয়। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে খ-িত পরিবার শুরু হওয়ায় বাড়ির ধারের তালগাছে কুঠারাঘাত হয় আগে। বর্তমানে সড়কের ধারে সারিবদ্ধ তালগাছ দেখা যায়। তালগাছ নিয়ে আমাদের বড় গর্ব শৈশবের পাঠে সেই পদ্য- ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে.....” রচনা করেছেনে কবিগুরু বরীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই দেশেই। আমাদের কাব্যে সাহিত্যে জায়গা করে নিয়েছে তালগাছ। বনফুলের ‘নুড়ি ও তালগাছ’ গল্পটি সাহিত্যে অমর হয়ে আছে। গল্পের বর্ণনায়- বিশাল প্রান্তরে দাঁড়িয়ে নিঃসঙ্গ এক তালগাছ। তলায় পাথরের ছোট্ট নুড়ি। ঘাসই তার ভুবন। উঁচু তালগাছ তার কাছে বিস্ময়। নুড়ি গাছকে জিজ্ঞাসা করে- কে আপনি? অত উঁচুতে কী দেখেন। এভাবেই গল্পের গতি নিপুন ছন্দে এগিয়ে যায়। তালপাতার পুঁথি ও তালপাতার সেপাইয়ের কথা কে না জানে। কেচ্ছা কাহিনী ও শিশু সাহিত্যেও তালগাছকে নিয়ে অনেক মজা আছে। বিশাল পাথারে এক তালগাছ তাতে মামদো ভূতের বাস। কেচ্ছায় ভরদুপুর এই তালগাছ। এমন গল্প আজও প্রবীণদের কাছে শোনা যায়। গল্পের ভূতপেত্নী না থাক পিঠে তাল পড়লে ক্যাঁকু করতেই হবে। প্রকৃতির আর্কিটেক্ট বাবুই তালগাছের সরু ডগায় খড়কুটা দিয়ে যে বাসা বানায় তা চিরকালের ক্লাসিক শিল্পকর্ম হয়ে আছে। ওদের কাছে বড় আশ্রয়ের জায়গা তালগাছ। ......তাল নিয়ে এত কথার পরও বুঝি বলতে হয় সব কিছুই কি তালগোল পাকিয়ে গেল....। -সমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×