ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পোল্ট্রি খাতের উন্নয়নে নেয়া হচ্ছে ১২৩ কোটি টাকার প্রকল্প

প্রকাশিত: ০৯:৪৮, ৩০ মে ২০১৯

 পোল্ট্রি খাতের উন্নয়নে নেয়া হচ্ছে ১২৩ কোটি টাকার প্রকল্প

ওয়াজেদ হীরা ॥ সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে বিবেচনা করা হয় পোল্ট্রিখাতকে। বিভিন্ন খরচ বৃদ্ধিসহ নানা সমস্যা থাকলেও সফলতাও রয়েছে এ খাতে। এবার পোল্ট্রি খাতের উন্নয়নে আরও বেশি নজর দিচ্ছে সরকার। এ খাতের উন্নয়নে গবেষণাসহ প্রশিক্ষণে জোর দিচ্ছে । এ খাতের উন্নয়নে নেয়া হচ্ছে ১২৩ কোটি টাকার প্রকল্প। ফলে প্রকল্পের মাধ্যমে আমিষের ঘাটতি পূরণে বেশি মাংস ও ডিম উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণসহ নানা পদক্ষেপ নেয়া হবে। পোল্ট্রির গুণগতমান বাড়াতে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টির আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পোল্ট্রি শিল্প। অনেকেই এ খাতের মাধ্যমে হয়েছেন স্বাবলম্বী। তবে অনেক সময়ই এই খাতে নানা ধরনের সমস্যাও দেখা যায়। সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে এই খাতকে আরও এগিয়ে নিতে সরকারের বিভিন্ন মহল বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন। এরই প্রেক্ষিতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ‘পোল্ট্রি গবেষণা ও উন্নয়ন জোরদারকরণ’ নামের প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। যার খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে ১২৩ কোটি টাকা। জানা যায়, আশির দশকে শুরু হওয়া এই শিল্পের বিনিয়োগ বর্তমানে ছাড়িয়ে গেছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থান হয়েছে তাদের। প্রায় ৬০ লাখ মানুষের। তাদের জীবন-জীবিকা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এখন এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। এ খাতে কর্মরতদের প্রায় ৪০ শতাংশই নারী। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ ও নারীর ক্ষমতায়নে কৃষির পরই সবচেয়ে বড় অবদান রাখছে বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প। পোল্ট্রি এ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, সারাদেশে বর্তমানে প্রায় ৬৫-৭০ হাজার ছোট-বড় খামার রয়েছে। এসব খামারে প্রতিদিন মুরগির মাংসের উৎপাদন প্রায় ১ হাজার ৮৫১ টন। প্রতিদিন ডিম উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ থেকে ২৫ লাখ। আগে ডিম এবং ব্রয়লার মুরগি আমদানি করতে হতো। এখন তা শূন্যের কোটায় দাঁড়িয়েছে। এ খাতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির বর্তমান হার প্রায় ১৫ শতাংশ। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (ডব্লিউএফও) এর তথ্য মতে গ্রামীণ ও প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিদের জীবন-যাত্রার মান উন্নয়নে প্রাণিসম্পদের অবদান প্রায় ৭০ শতাংশ। তাই, প্রাণিসম্পদের উন্নয়ন মাত্র রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নয় এটা সমাজের হতদরিদ্র মানুষের বাঁচার জন্য আশার আলো হিসেবে কাজ করছে এবং সে সঙ্গে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের অন্যতম খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশের মোট প্রাণিজ আমিষের শতকরা ৪০-৪৫ ভাগই জোগান দেয় পোল্ট্রি শিল্প। বর্তমানে জিডিপিতে ২ দশমিক ৪ শতাংশ অবদান রাখা এ খাতের ১৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রমাণ করেছে পোল্ট্রি শিল্পের সম্ভাবনা। তবে, বর্তমানে খামারিদের ব্যয় বাড়লেও ডিম ও মুরগির সঠিক দাম না পাওয়ার আক্ষেপ আছে তাদের। পরিসংখ্যান ব্যুরোর-তথ্য মতে, এই খাদ্য চাহিদার ১০ শতাংশ আসে পোল্ট্রি খাত থেকে। মোট প্রাণিজ আমিষের ৪০-৫০ ভাগও জোগান দেয় এই খাত। জানা গেছে, আমিষ ও পুষ্টি চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশে দিন দিন বেড়ে চলছে পোল্ট্রি শিল্প। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে পোল্ট্রি শিল্পের অবদান ২ দশমিক ৪ শতাংশ। লাভজনক, টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব পোল্ট্রি প্রযুক্তি কৃষি পদ্ধতির উন্নয়ন, উদ্ভাবন ও ব্যবহারের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী খাদ্য নিরাপত্তা তথা আমিষের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, অধিক জনসংখ্যা, খরা, বন্যা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ, চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কম, নিরক্ষরতা, গ্রামীণ দরিদ্রতা ইত্যাদি প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এদেশে প্রাণিসম্পদ ও পোল্ট্রির উৎপাদন অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছে। এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) আগামী সভায় অনুমোদনের সুপারিশ করা হয়েছে। অনুমোদন পেলে চলতি বছর থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট। প্রকল্প প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, এদেশের মানুষ প্রাচীনকাল থেকেই হাঁস-মুরগি লালন-পালন করে আসছে। গত ২০ থেকে ২৫ বছরে হাঁস-মুরগি পালনের এই পেশাটি ক্রমাগতভাবে পরিবর্তন হয়ে বাণিজ্যিক বা শিল্পের আকার ধারণ করেছে। এদেশে ২৩ দশমিক ৯৩ মিলিয়ন গরু, ১ দশমিক ৪৭ মিলিয়ন মহিষ, ২৫ দশমিক ৯৩ মিলিয়ন ছাগল, ৩ দশমিক ৪০ মিলিয়ন ভেড়া এবং ৩২৯ দশমিক ২ মিলিয়ন হাঁস-মুরগি রয়েছে। জিডিপিতে প্রাণিসম্পদের প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ হারে প্রতি বছর বেড়ে চলেছে। যার ফলে গত এক দশকে দুধ, মাংস ও ডিমের উৎপাদন যথাক্রমে ৪২ দশমিক ৫, ১৪২ দশমিক ৩ এবং ১০৬ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়েছে। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে একজন মানুষ বছরে ২৪০টি ডিম খেয়ে থাকে। পুষ্টিবিদগণের মতে একজন সুস্থ মানুষকে বছরে কমপক্ষে ১৮০টি ডিম খেতে হবে। এদেশে একজন মানুষ সারা বছর খেতে পারে মাত্র ৯৫টি ডিম যেখানে বছরে জনপ্রতি কমপক্ষে খাওয়া উচিত ১০৪টি। অপরদিকে একজন মানুষের দৈনিক ১২০ গ্রাম মাংস গ্রহণ প্রয়োজন সেখানে প্রাপ্যতা ১০২ দশমিক ৬০ গ্রাম যার প্রায় ৫৫ শতাংশ পোল্ট্রি খাতের অবদান। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে মাংস উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৭ দশমিক ১৫ মেট্রিক টন এবং লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭৭ দশমিক ১৪ মেট্রিক টন। সে হিসেবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশে মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও উন্নত বিশ্বের দেশে রূপান্তরের লক্ষ্যে আরও মাংস উৎপাদন এবং গুণগতমান আবশ্যিকভাবে বাড়াতে হবে। সেক্ষেত্রে পোল্ট্রি গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবিত প্রযুক্তি পর্যাপ্ত ভূমিকা রাখতে পারে। এ বিষয়ে প্রকল্পটির দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সদস্য জাকির হোসেন আকন্দ পরিকল্পনা কমিশনের মতামত দিতে গিয়ে বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে পোল্ট্রির প্রজাতিগুলো সংগ্রহ, সংরক্ষণ, জাত উন্নয়ন এবং অধিক মাংস ও ডিম উৎপাদনশীল জাত উদ্ভাবন, পোল্ট্রির শিল্পের উন্নয়নে বিভিন্ন প্রায়োগিক গবেষণা কার্যক্রম নেয়ার মাধ্যমে নিরাপদ মাংস ও ডিমের উৎপাদন বৃদ্ধি, ছোট মাঝারি ও বাণিজ্যিক পোল্ট্রি খামারিদের প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দেয়া, বিএলআরআই এর প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান এই ল্যাবের সঙ্গে সমন্বিত গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। তাই প্রকল্পটি অনুমোদনের সুপারিশ করা হয়েছে। প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমগুলো হচ্ছে, পোল্ট্রি প্রজাতিগুলো সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও জাত উন্নয়নের জন্য গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা, নিরাপদ মাংস ও ডিমের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা ৩৫টি, ৬ হাজার ৮০৪ জন খামারিদের পোল্ট্রি প্রযুক্তি বিষয়ক এবং গবেষকদের দক্ষতা বাড়ানোর প্রশিক্ষণ দেয়া, সাভার বিএলআরআই এর প্রধান কার্যালয়ের পোল্ট্রি রিসার্স এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার ও আঞ্চলিক পর্যায়ের সাব সেন্টার স্থাপন, বিজ্ঞানী, গবেষক রিসার্চ ফেলোদের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কোলাবরেশনের মাধ্যমে গবেষণা সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং অফিস ভবন গবেষণাগার ও গবেষণা শেড নির্মাণ করা হবে। পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা মনে করছেন দেশের অনেক বেকারদের কর্মসংস্থান হয়েছে এই শিল্পের মাধ্যমে। এছাড়াও এর সুষ্ঠু অগ্রযাত্রায় আগামী দিনে আরও ভূমিকা রাখবে। প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে নিরাপদ মাংস ও ডিমের উৎপাদন বৃদ্ধির বিষয়টি আছে সেই সঙ্গে ছোট মাঝারি ও বাণিজ্যিক পোল্ট্রি খামারিদের প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দেয়ার মাধ্যমে এই শিল্পের আরও বিকাশ হওয়া সম্ভব। তাই এই প্রকল্প নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন কর্মকর্তারা।
×