ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘হেলেন কেলার’ বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী

প্রকাশিত: ০৯:১৩, ৩০ মে ২০১৯

 ‘হেলেন কেলার’ বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী

একজন অসাধারণ শিক্ষয়িত্রী এ্যান স্যুলিভানের তত্ত্বাবধায়নে বিনির্মিত হয়েছিলেন দৃষ্টি-বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী কিন্তু অদম্য মানসিক দৃঢ়তা ও বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী হেলেন কেলার (২৭ জুন ১৮৮০-১ জুন ১৯৬৮)। এ্যান স্যুলিভানের অতিমানবিক প্রেরণায় হেলেন কেলারের নেতিবাচক সবকিছুর বিপরীতে ঘুরে দাঁড়ানোর সেই কাহিনী নিয়ে নাট্যসংগঠন স্বপ্নদলের একক অভিনীত প্রযোজনা ‘হেলেন কেলার’। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটারে ২৪ মে ২০১৯ মঞ্চস্থ হলো স্বপ্নদলের দর্শকনন্দিত এ মনোড্রামার ২৪তম প্রদর্শনী। ‘বিশ্বের বিস্ময়’ মহীয়সী নারী হেলেন কেলারের জীবন-কর্ম-স্বপ্ন-সংগ্রাম-দর্শন রূপায়িত হয়েছে ব্যতিক্রমী এ প্রযোজনায় নিপুণ কুশলতায়। আমরা দেখতে পাই, মানবতাবাদী হেলেন কেলার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকিতে নিজ দেশ আমেরিকার নিষ্ঠুর-নির্দয় আণবিক বোমাহামলার ঘটনায় সমমর্মিতায় হয়েছেন রুদ্ধবাক! মানবতাবাদের পক্ষে এবং যুদ্ধ-ধ্বংস-সহিংসতা-বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মহীয়সী হেলেনের স্পষ্ট অবস্থানের কথা বিধৃত হয়েছে পুরো প্রযোজনা জুড়ে! তাঁর দৃপ্ত উচ্চারণ, ‘যুদ্ধ প্রস্তুতিতে যে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে দেশে দেশে তা খরচ করা হোক জনকল্যাণে’। তিনি খুঁজে ফিরেছেন নিরন্তর সেই অনাদি প্রশ্নের উত্তর- ‘মানুষের মুক্তি কোথায়? বিপ্লবে নাকি সংহতিতে, বিভেদে নাকি সমন্বয়ে, বিনাশে নাকি পরস্পরের ভাব গ্রহণে?’ আবার এর উত্তর তিনি খুঁজে পেয়েছেন বিশ্বকবি-বাঙালী কবি রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শনে। তার উপলব্ধিজাত ভাষ্য- ‘ব্যক্তি ও জাতির প্রকৃত সুখ আর সর্বমানবের কল্যাণ যে অভিন্ন- রবীন্দ্রনাথের মহত্তম সেই সত্যের উপলব্ধি হলে পৃথিবীতে যুদ্ধ থাকত না, ঘৃণা থাকত না, মুছে যেত সব সীমান্ত, লোপ পেত সব গোঁড়ামি। তখন মানুষ বাঁচত মহত্তর কিছু অর্জনের অভিপ্রায়ে, সমগ্র পৃথিবী হতো তার দেশ, তার অভিষ্ট হতো গোটা স্বর্গলোক।’ প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে হেলেনের সম্পর্ক তথা পাশ্চাত্যের হেলেনের জীবনে প্রাচ্যের রবীন্দ্রনাথ তথা রবীন্দ্রদর্শনের প্রবল প্রভাব এ প্রযোজনার একটি অভিনব গবেষণার ক্ষেত্র! হেলেন কেকলারের ব্যক্তিজীবনের নানা পূর্ণতা-অপূর্ণতার প্রসঙ্গও স্বাভাবিকভাবেই উঠে এসেছে ‘হেলেন কেলার’-এ। তার জীবনেও প্রেম এসেছিলো প্রবল জলোচ্ছ্বাসের মতো উদ্বেলিত করে, কিন্তু সে প্রেমকে তিনি চাঁপা দিয়েছেন নীরবে, প্রিয় শিক্ষয়িত্রী এ্যান স্যুলিভানের হেলেনের জন্য সমগ্র জীবন উৎসর্গ করার কথা চিন্তা করে। অতিমানবী হেলেন কেলারের এ আত্মত্যাগ সে মুহূর্তে দর্শকহৃদয় প্রকৃতই আবেগাক্রান্ত করে! প্রদর্শনীশেষেও হেলেন কেলারের উচ্চারিত এক প্রশ্নের দ্বারা তাড়িত হই আমরাÑ ‘আমি হেলেন কেলার, আমি আমৃত্যু লড়ব অসহায় মানুষদের পাশে থেকে, যারা অন্ধ নয়, বধির নয়, মূক নয়, তারাও কি লড়বে না?’ ‘হেলেন কেলার’ প্রযোজনাটির মঞ্চসজ্জা, আলোক নির্দেশনা, পোশাক পরিকল্পনা এবং সর্বোপরি চরিত্রায়ন-সত্যিই অসাধারণ! হেলেনের জীবনের নানাস্তর বয়ানের কালে ব্যাকস্ক্রিনে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল, আইনস্টাইন, জর্জ বার্নাড শ, জন এফ কেনেডি, চার্লি চ্যাপলিন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে হেলেন কেলারের দুর্লভ স্থিরচিত্র, নাৎসি বাহিনীর সামনে এডলফ হিটলারের ভাষণের ভিডিও, অ্যান স্যুলিভানের সঙ্গে হেলেন কেলারের ভিডিও, চ্যাপলিনের ‘দি গ্রেট ডিক্টেটর’ চলচ্চিত্রের অংশবিশেষ, হিরোশিমা-নাগাসাকি হামলা প্রভৃতির ভিডিও যৌক্তিকভাবে প্রদর্শন প্রযোজনাটির প্রামাণ্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিঃসন্দেহে বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। পাশাপাশি ‘আলো’ সম্পর্কিত বিভিন্ন রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রাসঙ্গিক ব্যবহার প্রযোজনাটিতে যোগ করেছে এক ভিন্ন মাত্রা। ‘হেলেন কেলার’-এ জুয়েনা শবনম একক অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শককে ধরে রেখেছেন, দীর্ঘ এক ঘণ্টা সময় ধরে, মন্ত্রমুগ্ধ করে! আসলে জুয়েনা চরিত্রের সঙ্গে এমনভাবে মিশে গেছেন, এতটাই মনপ্রাণ ঢেলে অভিনয় করেছেন, তাঁর অভিব্যক্তি এতটাই স্বতঃস্ফূর্ত-সাবলীল-বাস্তবসম্মত যে মনে হয়েছে যেন অন্ধ-বধির হেলেন কেলার স্বয়ং মঞ্চে উপস্থিত! অপূর্ব কুমার কুন্ডু-র অপূর্ব পান্ডুলিপি, জুয়েনা শবনমের মনোমুগ্ধকর অভিনয় দক্ষতা এবং এবং জাহিদ রিপনের নতুন মাত্রার অনন্য নির্দেশনা- এ তিনের সমন্বয়ে ‘হেলেন কেলার’ প্রযোজনাটি সত্যিই হয়ে উঠেছে অনন্যসাধারণ!
×