ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদ সামনে রেখে বেদম ছোটাছুটি

দিন রাত কেনাকাটা, বাড়ি ফেরার তোড়জোড়

প্রকাশিত: ০৯:৪১, ২৭ মে ২০১৯

দিন রাত কেনাকাটা, বাড়ি ফেরার তোড়জোড়

মোরসালিন মিজান ॥ ঢাকার মানুষ সারা বছরই ব্যস্ত। যে যার কাজ নিয়ে থাকেন। তবে এখন শুধু ব্যস্ততা নয়, রীতিমতো ছুটছে মানুষ। ঈদ সামনে রেখে এক ধরনের দৌড়ঝাঁপ স্পষ্ট। যানজটের শহর বটে। থেমে নেই কিছু। দিনভর শপিং। রাতেও তা-ই। একদিকে কেনাকটা। অন্যদিকে গ্রামে ফেরার প্রস্তুতি। ফেলে আসা গ্রাম বা মফস্বল শহরে বাবা মা। নিকটাত্মীয়। বছরে একবার অন্তত তাদের বুকে জড়িয়ে ধরা চাই। রেলওয়ে স্টেশন বা বাসকাউন্টারে তাই যোদ্ধাবস্থা। টিকেটের জন্য যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। ঈদে খরচও বেশি। পুষিয়ে নিতে বহু মানুষ খাটুনি বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর অসৎ যারা, অন্যেরটা কেড়ে নিতে তৎপর হয়েছে। সাধারণ মানুষের জন্য হাজারটা ফাঁদ পেতে রেখেছে তারা। আরও কত রকমের মন্দ ভাল কর্মকান্ড ! ব্যস্ততা। সব মিলিয়ে অন্যরকম সময়। সময়টি যারপরনাই দৃশ্যমান হয়েছে। সব মানুষ একসঙ্গে একই ইস্যুতে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় বেড়েছে দুর্ভোগও। তবে ঈদের আনন্দের কাছে এই দুর্ভোগ যেন নস্যি! হাসিমুখে মেনে নেয়া হয়েছে বলেই মনে হয়। আজ সোমবার রমজানের ২১তম দিন। ৮ থেকে ৯দিন পর ঈদ। শেষ মুহূর্তে এসে দিন রাত চলছে শপিং। সকাল বিকেল বিচার করার যেন কোন সুযোগ নেই। বিশেষ করে নারীরা এ কাজে অক্লান্ত। গত কয়েকদিনের প্রবণতা লক্ষ্য করে দেখা গেছে, সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে না হতেই ঘর থেকে বের হয়ে পড়ছেন নারীরা। ভিড় ঠেলার জন্য সঙ্গে থাকছে বড় ছেলে, সমবয়সী চাচাত মামাত ভাই কিংবা দেবর। নিজের কাজে ফাঁকি দিয়ে স্ত্রীর কেনাকাটায় সময় দিচ্ছেন স্বামীও। রবিবার বসুন্ধরা সিটি শপিংমলের ফুডকোর্টে একা বসেছিলেন জনৈক মাকসুদা। সামনে ইফতারের টেবিল। সেখানে অনেকগুলো ব্যাগ রাখা। কেমন হলো শপিং? জানতে চাইলে তিনি বললেন, এখনও শেষ হয়নি। দুপুরে এসেছিলাম। কিছু কেনাকাটা হয়েছে। বাকি কেনাকাটা ইফতারের পর হবে। কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার হাসব্যান্ডের অফিস ছিল, শেষ করে আসবে। ওর জন্য চেয়ার খালি রেখেছি। একসঙ্গে ইফতার করব। তার পর ওর পছন্দের কেনাকাটা। এলিফ্যান্ট রোডে মেয়েদের একটি পোশাকের শোরুমে কথা হয় সামিয়া ও মুনিয়ার সঙ্গে। দুই বোন। বড় বোন সামিয়া বললেন, আড়ংয়ের আসাদ গেট শাখা থেকে শপিং শুরু করেছিলাম। ওখানে মানুষের ভিড় শুধু। জামা দেখা যায় না। একটা তাও কিনেছি। অন্যটি খুঁজতে খুঁজতে এলিফ্যান্ট রোড পর্যন্ত চলে আসা বলে জানান তিনি। এভাবে একটি বা দু’টি মার্কেটে কেনাকাটার কথা ভেবে বের হয়ে অনেকেই শহর ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ইফতারের পর নতুন করে জমে উঠছে মার্কেট শপিংমল। মধ্যরাত অবদি খোলা থাকছে দোকানপাট। গত কয়েকদিন নিউমার্কেট এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নতুন জামা কাপড়ের পাশাপাশি বিছানার চাদর, পর্দার কাপড়, থালা বাটি, ডিনার সেট, গৃসসজ্জা সামগ্রীসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সমান আগ্রহ নিয়েই কিনছে মানুষ। দেখে বোঝা যায় বিক্রি বেড়ে গেছে দোকানিদের। মার্কেটের মসজিদের নিচে বেড কভার বিক্রি করেন মোঃ আমির। তিনি জানান, আগে দোকানে তিনি দুই এক ঘণ্টার বেশি থাকতেন না। ছেলেরা চালাত। এখন তিনি নিজে মধ্যরাত পর্যন্ত দোকানে বসেন। পরিবারের সবাইকে গতবারের চেয়েও সুন্দর একটি ঈদ উপহার দিতেই এমন বাড়তি খাটুনি বলে জানান তিনি। অবশ্য এ দেশে ঘুষখোর দুর্নীতিবাজদের সারা বছরই ঈদ। এর পরও তারাই বেশি খাই খাই করছে বলে অভিযোগ। হাঁটা যেন দ্বিগুণ হয়েছে। ঈদে বাড়তি কামাইয়ে নেমে গেছে পুলিশের কিছু লোক। সরকারী দফতরে উপরি দেয়া নেয়ায় গতি বেড়েছে। দেয়া শুরু করতে না করতেই উধাও হয়ে গেছে ট্রেনের টিকেট। বাসেও অনিয়মের শেষ নেই। অগত্যা সরকারের এক মন্ত্রীকে মুখ খুলতে হয়েছে। রবিবার এক বৈঠক থেকে বিআরটিসির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারীদের তিরস্কার করে তিনি বলেছেন, রমজান সংযমের মাস, এই মাসে ইনকামটা একটু কম করলে কী হয়?’ প্রকাশ্যে মন্ত্রীর এমন ভর্ৎসনার পরও দুর্নীতি কি কমবে? আশা করা বৃথা। ব্যবসায়ীরাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লুটেরার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। দেখে মনে হয়, বার মাসের আয় এক মাসেই করতে চাইছেন তারা। ব্যস্ততা তাই শেষ হতে চায় না। এসবের বাইরে আছে গ্রামের বাড়ি ফেরার তোড়জোড়। সারা বছর ঢাকায় থাকলেও, ঈদে বাড়ি ফেরা চাই। নাড়ির টানে বাড়ি। এই ফিরে যাওয়ার, ফিরে পাওয়ার কী যে আনন্দ! এবার ছুটিও বেশ লম্বা। প্রায় নয় দিনের সরকারী ছুটি। একটু আয়েশ করে কাটাতে বাড়ির পানে ছুটছে ঢাকার মানুষ। একাংশ ইতোমধ্যে গ্রামে পৌঁছে গেছে। বাকিদের কেউ ব্যাগ গুছাচ্ছেন। টিকেট সংগ্রহ করছেন কেউ। যাত্রীদের ভোগান্তি কমাতে এবারই প্রথম কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের বাইরে আরও চারটি জায়গা থেকে টিকেট বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়। এর পরও ভোগান্তি চরমে। অভাব অভিযোগের মধ্য দিয়ে রবিবার ট্রেনের অগ্রিম টিকেট বিক্রি শেষ হয়েছে। শেষ দিনে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, মানুষের গিজগিজ। প্ল্যাটফর্মের নোংরা পরিবেশ। চিৎকার চেঁচামেচি। গায়ে ধাক্কা। সেইসঙ্গে গ্রীষ্মের দাবদাহ। এ অবস্থার মধ্যেই টিকেট সংগ্রহের কাজ চলছে। আকবর নামের এক যাত্রী বললেন, অফিসের কাজ ফেলে রেখে এখানে এসেছি। যানজটের কারণে গাড়ি চলে না। আধাঘণ্টা পায়ে হেঁটেছি। তার পর টিকেট কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আছি প্রায় দেড় ঘণ্টা। সফল হয়ে তবেই ফিরবেন বলে জানান তিনি। বাসে বাড়ি ফেরার চেষ্টাও লক্ষ্যণীয়। বহু মানুষ প্রতিদিন ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছে। বাকিরা যাওয়ার অপেক্ষায়। কয়েক দিনের মধ্যেই ঢাকা ফাঁকা হতে শুরু করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তার আগের সময়টা চলছে এখন। তাই এত দৌড়ঝাঁপ। এদিকে, ঢাকায় যারা থাকবেন তাদের সংখ্যাও কম নয়। বাড়িটা রং করাতে হবে। গাড়িটা ধুয়ে নতুনের মতো ঝকঝকে করতে হবে। মিস্ত্রি ডেকে পানির ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করাতে হবে। বাড়ির ভাড়াটিয়ারা সব চলে যাবেন গ্রামে। চোর ঢুকে যায় কিনা, সজাগ থাকতে হবে বাড়িওয়ালাকে। নতুন তালা কিনে এই দরজায়, ওই গেটে ঝোলাতে হবে। টেনে দেখতে হবে প্রতিদিন। সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। আর যারা ঢাকার হতে পারেননি, গ্রামের পথও ভুলে গেছেন তারা হয়তো ঘরের ভেতর থেকে তালা দেবেন! দরিদ্র ছাত্র কিংবা চাকরির খোঁজে ঢাকায় আসা বেকার ছেলেটি হয়তো ঈদের দিন রেস্তরাঁ খুঁজে বেড়াবে। এমন প্রস্তুতিও নিচ্ছেন কেউ না কেউ! নিশ্চয়ই নিচ্ছেন।
×