ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এক অসামান্য প্রেমের বিয়োগান্তক পরিণতি!

প্রকাশিত: ০৯:৪৮, ২১ মে ২০১৯

 এক অসামান্য প্রেমের বিয়োগান্তক পরিণতি!

স্টাফ রিপোর্টার, মুন্সীগঞ্জ ॥ কিডনি দিয়ে জীবন বাঁচাতে বিয়ে করে স্বামী রাজীবকে আর বাঁচিয়ে রাখতে পারলেন না রোমানা। সব বাঁধন ছিঁড়ে সোমবার রাজীব চলে গেছে না ফেরার দেশে। রাজধানীর ডাঃ সিরাজুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সোমবার সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এতে আবারও একা হয়ে গেলেন রাজীবকে কিডনি দিয়ে বাঁচাতে এগিয়ে আসা রোমানা। আনোয়ার হোসেন রাজীব। বয়স ৩১ বছর। হঠাৎ জীবনে নেমে এলো অন্ধকার। জানলেন দুটি কিডনিই নষ্ট। কিডনি দেয়ার মতো কেউ নেই, কেনার সুযোগ-সামর্থ্যও নেই। বড় অসময়ে সুন্দর পৃথিবী তাকে ছাড়তে হবে। এক নিদারুন কষ্ট তার। এই কষ্ট পোড়াচ্ছে মা-বাবাকেও। ঠিক তখনই আশার আলো হয়ে এলেন রোমানা নামের এক তরুণী। প্রস্তাব দিলেন, তিনি একটি কিডনি দিতে চান। অবিশ্বাস্য লাগছে রাজীবের। শুধু তাকিয়ে থাকেন। বললেন, আত্মীয় না হলে তো কিডনি দিতে আইনে বাধা আছে। এবার চূড়ান্ত প্রস্তাবটিই দিলেন রোমানা। বললেন, শুধু কিডনিই নয়, এর আগে তিনি বিয়েও করতে চান। মানবিক প্রেমের এই অনিন্দ্য সুন্দর ঘটনাটি ঘটেছিল রাজধানী ঢাকায় ২০১৭ সালের শুরুর দিকে। মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার বেজগাঁও ইউনিয়নের সুন্দিসার গ্রামে আনোয়ার হোসেন রাজীবের বাড়ি। আর রোমানা তাসমিনের বাড়ি জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামে। তারা থাকতেন ঢাকার লালবাগের একটি ভাড়া বাসায়। ২০১৭ সালের ১৩ জানুয়ারি রাজীবকে বিয়ে করেন রোমানা। জানা গেছে, সেই সময়ে ফেসবুকের কল্যাণে রাজীবের সঙ্গে পরিচয় হয় রোমানা তাসমিনের। ফেসবুকেই জানতে পারেন, কিডনি রোগী রাজীবের বাঁচার আশা প্রায় শেষ। জানতে পারেন রাজীবের রক্তের গ্রুপ। নিজের কিডনি রাজীবের সঙ্গে ম্যাচ করবে, ভাবতে শুরু করেন রোমানা। নিজেকে প্রশ্ন করেন, অপরের জীবন রক্ষার সুযোগই বা কয়জনের হয়? এই প্রশ্ন তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। এক পর্যায়ে তিনি নিজের মাঝে রাজীবকে আবিষ্কার করেন। সিদ্ধান্ত নেন, প্রয়োজন হলে তিনি রাজীবকে বিয়ে করতে চান, তবু মানুষটি বেঁচে যাক। রোমানার মুখে এ কথা শুনে রাজীব পুনরায় বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। রাজীবের কাছে যেন এক অকল্পনীয় ব্যাপার। মহৎ হৃদয়ের তরুণী এমন একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের জীবনকেও ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছেন তো? এই প্রশ্নও রোমানাকে করলেন রাজীব। শেষ পর্যন্ত জয়ী হয় প্রেম। রোমানা পেশায় একজন প্যারামেডিক। কেরানীগঞ্জের সাজেদা হাসপাতালে তিনি কর্মরত। তার সামান্য আয়ে রাজীবের চিকিৎসা চলছে। একই সঙ্গে কবিতা লেখেন রোমানা-রাজিব। রোমানা কেন নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজীবকে বিয়ে করলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, রাজীবের সঙ্গে ফেসবুকের একটি গ্রুপে বছর তিন আগে তার বন্ধুত্ব হয়। ফেসবুকে রাজীবের কিডনি রোগের কথা প্রথম দিনেই জেনেছেন রাজীবের কাছ থেকে। আস্তে আস্তে তার প্রতি মমতা বেড়ে যায়, আর তা এক সময়ে ভালবাসায় রূপ নেয়। তাই সব কিছু জেনেও তিনি রাজীবকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। রাজীব স্ত্রী পেয়েছেন, কিডনি পাচ্ছেন। কিন্তু এত কিছুর পরও থমকে আছে রাজীবের কিডনি প্রতিস্থাপন। অর্থাভাবে রাজীবের কিডনি প্রতিস্থাপন করা যাচ্ছে না। এখন শুধু প্রয়োজন অর্থ, যা সবার সহযোগিতা ছাড়া সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। রাজীবের কিডনি প্রতিস্থাপন করতে প্রয়োজন প্রায় তিন লাখ টাকা। কিন্তু এর আগেই কিডনি চিকিৎসায় দেশে-বিদেশে অনেক টাকা খরচ করে ফেলায় রাজীবের পরিবারের পক্ষে এই টাকা জোগাড় করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে রাজীবের চিকিৎসার জন্য এগিয়ে আসতে সমাজের বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন রাজীবের ফেসবুক বন্ধুরা। এই নিয়ে ২০১৭ সালে এই বিষয়টি বিভিন্ন পত্রিকায় আসার পর রাজনৈতিক নেতা, দেশের খ্যাতিমান আইনজীবীসহ সমাজের বৃত্তবানরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। মুন্সীগঞ্জ-২ (লৌহজং-টঙ্গীবাড়ি) আসনের এমপি অধ্যাপিকা সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি রাজীবকে দেখতে যান তার ঢাকার বাসায়। এমিলি বলেছিলেন, অবশ্যই রাজীবের চিকিৎসা ব্যয়ভারের ব্যবস্থা করা হবে। যেভাবেই হোক আমরা রাজীবের চিকিৎসার ব্যবস্থা করব। রাজীবের ঢাকার লালবাগের বাসায় গিয়ে রাজীব-রোমানার খোঁজখবর নিয়েছিলেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি রাজীবের চিকিৎসার জন্য তাৎক্ষণিক কিছু আর্থিক সহযোগিতা করেন এবং কিডনি প্রতিস্থাপনের সময় আরও আর্থিক সহায়তা করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। লৌহজং উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ মোঃ ওসমান গণি তালুকদার, তৎকালীন টঙ্গীবাড়ি উপজেলার চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার কাজী ওয়াহিদ রাজীবের চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছিলেন। তাদের মতো অনেকেই সে সময় আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন রাজীবের চিকিৎসার জন্য। আর্থিক সহযোগিতা পেয়ে কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য রাজীব রোমানা ভারতে যান। সেখানকার ডাক্তার তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আরও কিছু সমস্যা পান। শরীরের মধ্যে খুঁজে পান হেপাটাইসিস-সিসহ নানান রোগের উপসর্গ। সেখানকার ডাক্তার তাকে পরামর্শ দেন আগে অন্যান্য রোগের চিকিৎসা করাতে। তার পর কিডনি প্রতিস্থাপন। তাই তারা সেখান থেকে দেশে ফিরে এসে ডাঃ সিরাজুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কিডনির ডায়ালাইসিসসহ চিকিৎসা নিচ্ছেলেন। অবশেষে সোমবার তিনি চিকিৎসারত অবস্থায় মারা যান। তাই কিডনি দিতে বিয়ে করলেও কিডনি দেয়া হলো না রোমানার। আবার একাই হয়ে গেলেন তিনি। পারিবারিক সূত্র জানায়, আনোয়ার হোসেন রাজীব লৌহজং পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০২ সালে এসএসসি পাস করেন। ২০০৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এমএ শেষ করেছেন। তিনি পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালে সিনিয়র অফিসার হিসেবে চাকরি করতেন। বাবা নূর মোহাম্মদ একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে রাজীব ২০১৪ সালের ১২ নবেম্বর প্রথম ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি হন এবং প্রথম দিন থেকেই তার ডায়ালাইসিস শুরু হয়।
×