স্টাফ রিপোর্টার ॥ সরকারের দেয়া বকেয়া মজুরি পরিশোধের ঘোষণা বাস্তবায়িত না হওয়া ও মজুরি কমিশন বাস্তবায়নের দাবিতে আবারও পাটকল শ্রমিকরা রাজধানীর ডেমরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। তীব্র গরমের মধ্যে টানা ষষ্ঠ দিনে শনিবার সকাল ৬টা থেকে কারখানার উৎপাদন বন্ধ রেখে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টারের সড়ক অবরোধ করেন রাষ্ট্রায়ত্ত লতিফ বাওয়ানী ও করিম জুট মিলের শ্রমিকরা। এতে আশপাশের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ভয়াবহ যানজটে আটকে পড়ে অনেকে হেঁটে গন্তব্যস্থলে গেছেন। পথচারী, অফিসগামী মানুষ, শিক্ষার্থীরা চরম দুর্ভোগে পড়েন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল ৬টার দিকে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টারের সড়ক অবরোধ করেন পাটকল শ্রমিকরা। এক পর্যায়ে তারা ডেমরা-যাত্রাবাড়ী, ডেমরা-রামপুরা ও ডেমরা-শিমরাইল সড়ক অবরোধ করেন। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোতে গাছের গুঁড়ি, ঢালাইয়ের খুঁটি ও ইট পাথর ফেলে যান চলাচল বন্ধ করে দেন। রাস্তায় টায়ার, কাঠ-বাঁশে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ ও লাঠি মিছিল করেন। গাড়ি চালকরা স্টাফ কোয়ার্টার এলাকায় আসলেই শ্রমিকরা গাড়ি থেকে নামিয়ে তাদের মারধর করতে দেখা গেছে। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা জানান, তাদের প্রায় ১০ সপ্তাহের মজুরি বকেয়া রয়েছে। ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। অনেকের সন্তানদের পড়ালেখাও বন্ধ হয়ে গেছে। আন্দোলনরত কয়েকজন নারী শ্রমিক জানান, রোজার মাসে আমরা টাকার অভাবে ইফতার করতে পারি না। সেহরিতেও ভাল কোন খাবার জোটে না। রোজা রেখে এ গরমের মধ্যে আমরা যে রাস্তায় আছি। এ দুঃখ-দুর্দশার কথা কি সরকারের কানে পৌঁছাবে না? শ্রমিকরা জানান, আমরা গরিব-অসহায় বলে আমাদের দিকে পাটকল কর্তৃপক্ষের কোন নজরদারি নেই। কিন্তু আমাদের ঘাম-রক্তের কামাই কিছুতেই নষ্ট হতে দেব না। যত দিনই লাগুক আমরা আন্দোলন অব্যাহত রাখব। প্রয়োজনে রাস্তায় জীবন দেব। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা বিজেএমসিকে দোষারোপ করে বলেন, বিজেএমসির লোকজন পাটকলগুলোকে লুটেপুটে খেয়েছে। এখন শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ করতে পারছে না সরকার। সরকার সঠিকভাবে তদন্ত করলেই পাটকলের দুর্নীতির রহস্য বের হয়ে যাবে। তখন লুটপাটকারীরা ধরা পড়ে যাবে। আন্দোলনরত শ্রমিক নেতারা জানান, আমাদের নয় দফার মধ্যে অন্যতম তিনটি দাবি হচ্ছে, বকেয়া মজুরি পরিশোধ, মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন ও ঈদের আগেই উৎসব-ভাতা দেয়া। পরে পুলিশের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে শ্রমিকরা রাস্তা সরে গেলে দুপুরের দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। এ ব্যাপারে ডেমরা জোনের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার মোঃ রবিউল আউয়াল জানান, শ্রমিকদের রাস্তা সরে যাওয়ায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, গত সোমবার থেকে ডেমরার স্টাফ কোয়ার্টার এলাকায় অবরোধ শুরু করেন নারায়ণগঞ্জের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল লতিফ বাওয়ানী জুট মিল ও করিম জুট মিলের নারী-পুরুষ শ্রমিকরা উৎপাদন বন্ধ রেখে সড়ক অবরোধ করে এই বিক্ষোভ করে আসছে। মঙ্গলবার তারা কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর ও দোকানপাটে হামলা চালালে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ারশেল ছোড়ে পুলিশ। এর আগে গত মাসে নয় দফা দাবিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাটকল শ্রমিকরা সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেছিলেন। সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে ২৫ এপ্রিলের মধ্যে শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধ ও ১৮ মে’র মধ্যে মজুরি কমিশন বাস্তবায়নের আশ্বাস দেয়া হয়েছিল। একই দাবিতে খুলনার রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল শ্রমিকরা লঙ্গরখানা খুলে সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করছেন।
খুলনা ॥ স্টাফ রিপোর্টার, খুলনা অফিস থেকে জানান, একদিন বিরতির পর শনিবার থেকে আবার খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল শ্রমিকরা বকেয়া মজুরি পরিশোধসহ নয় দফা দাবিতে ধর্মঘট ও রাজপথ-রেলপথ অবরোধ কর্মসূচী শুরু করেছেন। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় তারা এ দিন কোন কর্মসূচী পালন করেননি।
শনিবার সকাল ৬টা থেকে মিলগুলোতে শ্রমিকরা কর্মবিরতি শুরু করেন। এর পাশাপাশি বিকেলে নগরীর নতুন রাস্তা মোড় এলাকায় সড়ক ও রেলপথ অবরোধ কর্মসূচী পালন করেন। অবরোধ চলাকালে সড়কে টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়।
৫ মে রবিবার বিকেল থেকে একে এক খুলনা-যশোর অঞ্চলের নয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের সাধারণ শ্রমিকরা তাদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে মিলের উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। এর একদিন পর থেকে কর্মবিরতির পাশাপাশি বিকেল চারটা হতে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত তিন ঘণ্টা রাজপথ-রেলপথ অবরোধসহ রাজপথেই আসর ও মাগরিবের নামাজ আদায় ও ইফতারি করেন। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এ কর্মসূচী চলে আসলেও শুক্রবার শ্রমিকরা রাস্তায় নামেননি। শনিবার থেকে ফের একই কর্মসূচী শুরু করেছেন।
পাটকল শ্রমিকরা জানান, শনিবার বিকেল ৪টার দিকে খালিশপুরের ক্রিসেন্ট, প্লাটিনাম, খালিশপুর, ও দৌলতপুর এবং দিঘলিয়া উপজেলার স্টার জুট মিলের শ্রমিকরা মিছিল সহকারে নগরীর নতুন রাস্তা মোড়ে গিয়ে খুলনা-যশোর মহাসড়ক ও সংলগ্ন এলাকায় রেলপথ অবরোধ করেন। অবরোধস্থলে আসরের নামাজ পড়েন। ইফতার করেন এবং মাগরিবের নামাজ আদায় করে তারা ফিরে যান। এছাড়া আলিম ও ইস্টার্ন জুট মিলের শ্রমিকরা আটরা শিল্প এলাকায় এবং যশোরের নওয়াপাড়ার রাজঘাট এলাকার যশোর জুট ইন্ডাস্ট্রি জেজেআই ও কার্পেটিং জুট মিলের শ্রমিকরা একই কর্মসূচী পালন করেন বলে শ্রমিক নেতারা জানান।
শ্রমিক নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ১০-১২ সপ্তাহের মজুরি বকেয়া পড়েছে। শ্রমিকরা পবিত্র রমজান মাসে পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর দিন কাটাচ্ছে। বকেয়া পাওনার জন্য তারা গত কয়েকদিন ধরে রাজপথে আন্দোলনে থাকলেও এ ব্যাপারে বিএজএমসি কর্তৃপক্ষ যেন উদাসীনতার পরিচয় দিচ্ছেন। নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি প্রদানসহ নয় দফা বাস্তবায়নের দাবি জানান।