ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাড়ে তিন মাসে ধর্ষিত শতাধিক নারী ও শিশু

দক্ষিণাঞ্চলে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে

প্রকাশিত: ১১:০২, ৫ মে ২০১৯

দক্ষিণাঞ্চলে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ আকস্মিকভাবে দক্ষিণাঞ্চলে আশঙ্কাজনকহারে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে। মানবাধিকার সংগঠনের হিসেব মতে, দক্ষিণাঞ্চলে গত সাড়ে তিন মাসে ধর্ষিত হয়েছেন শতাধিক নারী ও শিশু। মরণ নেশা ইয়াবার চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে ধর্ষণ নামক সামাজিক ব্যাধি। বিভিন্ন নারী সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন, আইনজীবী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও শিক্ষক সমাজ সবাই এ বিষয়ে দ্রুতবিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা এবং নিজ নিজ সন্তানদের ওপর অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। সূত্রমতে, বরিশালের হিজলা উপজেলার মেমানিয়া গ্রামের বাসিন্দা অষ্টম শ্রেণীতে পড়ুয়া এক মাদ্রাসা ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষিতা ও তার পিতা অতিসম্প্রতি বরিশাল প্রেসক্লাবে এসে সংবাদ সম্মেলন করে ধর্ষকের বিচার দাবি করেছেন। জেলার মুলাদী উপজেলার প্রত্যন্ত চরকালেখান নেছারিয়া কামিল মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণীতে পড়ুয়া এক ছাত্রীকে অপহরণের পর দুইদিন আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয়েছে। ধর্ষণের ভিডিও চিত্র মোবাইল ফোনে ধারণ করে এ ঘটনায় মামলা দায়ের করা হলে ওই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয় ধর্ষক। উভয় ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। গৌরনদী উপজেলার কটকস্থল গ্রামের শিশু শ্রেণীতে পড়ুয়া (৬) এক ছাত্রীকে জিলাপী খাওয়ানোর প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করেছে প্রতিবেশী আলী বেপারী (৪৫)। এ ঘটনায় ১ মে ওই শিশুর মা বাদী হয়ে থানায় মামলা দায়ের করেছেন। এরপূর্বে গত ৩১ মার্চ গৌরনদী উপজেলার সুন্দরদী গ্রামের নবীনগর গ্রামের এক বখাটে শারীরিক ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ঘটনার একদিন পর ধর্ষিতার মা বাদী থানায় মামলা দায়েরের পর পুলিশ অভিযান চালিয়ে ধর্ষক আলামিন মাঝিকে গ্রেফতার করেছে। বরিশাল নগরীতে যৌতুক মামলার বাদী হিন্দু সম্প্রদায়ের এক নারী (৩০) গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ওই নারী বর্তমানে বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। স্বামীর বিরুদ্ধে দায়ের করা যৌতুক মামলায় গত ১৬ এপ্রিল বরিশাল আদালতে হাজিরা দিয়ে গৌরনদীর নলচিড়া গ্রামের বাবার বাড়িতে ফেরার পথে ওই গৃহবধূকে তার স্বামী ও দুই ননদ জামাতা তাদের আরও তিনজন সহযোগীকে নিয়ে তুলে নিয়ে গণধর্ষণ করে। এ ঘটনায় কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। গত ১৫ এপ্রিল বরগুনার পাথরঘাটায় পর্যটন কেন্দ্র হরিণঘাটা বনে নিয়ে প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে অষ্টম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনার মূল আসামি আব্দুল জলিলকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গত ২ এপ্রিল রাতে পিরোজপুর সদর উপজেলার কদমতলা ইউনিয়নের খানাখুনিয়ারী গ্রামে ১৪ বছর বয়সী অষ্টম শ্রেণীতে পড়ুয়া স্কুল ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে দুই বখাটে। নির্যাতিতা কদমতলা জর্জ হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। একই এলাকায় গত ২৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় এক সন্তানের জননীকে (২২) ধর্ষণ করেছে কাওছার খান নামের এক বখাটে। একই মাসে এক কলেজছাত্রীকে বিয়ের প্রলোভন দিয়ে ধর্ষণের অভিযোগে পুলিশ কনস্টেবল ও মঠবাড়িয়া উপজেলার বয়াতীর হাটগ্রামের খালেক ঘরামীর পুত্র সাহেব আলী ঘরামীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন ভুক্তভোগী ছাত্রী। ধর্ষণে সহায়তার অপরাধে বিলাসী বেগম নামের এক নারীকেও মামলায় আসামি করা হয়। পুলিশ অভিযান চালিয়ে বিলাসী বেগমকে গ্রেফতার করলেও মূলধর্ষক আত্মগোপনে রয়েছে। এ বিষয়ে বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন টিপিডিওর নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আলী বাবু বলেন, বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে নারী ও শিশুদের ওপর সহিংসতার ঘটনা বেড়েই চলেছে। আমাদের কাছে যে পরিসংখ্যান রয়েছে তা খুবই উদ্বেগজনক। আমরা কেন নারী ও শিশুদের জন্য নিরাপদ আবাস গড়তে পারছি না, সেটি নিয়ে ভাবতে হবে। তিনি আরও বলেন, মূলত বিচারহীনতার জনই এমনটা হচ্ছে। শাস্তির দিকে মনোযোগ না দিয়ে, সংশোধনে মনোযোগ দেয়া জরুরী। নতুবা এ সমস্যা আরও প্রকট হবে। নারী নেত্রী অধ্যাপক শাহ সাজেদা বলেন, বরিশালের আদালতগুলোতে অসংখ্য ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন মামলা ঝুলে রয়েছে। এসব মামলার বিচার চলছে কচ্ছপগতিতে। যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ ঘটনারোধে বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগের কোন বিকল্প নেই। অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হলে এ ধরনের ঘৃণ্য কাজ সমাজ থেকে হ্রাস পাবে। বরিশাল মেট্রোপলিটন প্রেসক্লাবের সভাপতি আলহাজ মোঃ আবুল কালাম আজাদ বলেন, এ ধরনের জঘন্যতম কাজের বিচার প্রক্রিয়া ধীরগতির কারণে অনেকেই মনে করে বিচার থেকে রক্ষা পাবে। তাই বিচার বিভাগ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আরও কঠোর হতে হবে। তিনি আরও বলেন, স্কুল থেকেও শিক্ষকদের ছাত্রছাত্রীদের নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বরিশাল জেলা শাখার সভাপতি রাবেয়া খাতুন ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার পেছনে সরাসরি বিচার বিভাগকে দায়ী করে বলেন, ধর্ষকের বিচার কাজ ধীরগতিতে হওয়ায় অনেক সময় ধর্ষকরা আইনের ফাঁকফোকড় পেরিয়ে বেরিয়ে আসে। তাই ধর্ষকের শাস্তি যত দ্রুত সম্ভব সম্পন্ন করা এবং ধর্ষকের ফাঁসি হওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, আকাশ সংস্কৃতিরোধ করতে হবে, যে সব চ্যানেল বা সাবস্ক্রাইবার যৌন বিষয়ে প্রদর্শন করে তা সরাসরি বন্ধ করা দরকার। এ বিষয়ে পরিবার ও শিক্ষকদের ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যেহেতু ছেলে কিংবা মেয়ে সাবালিকা হলে সে কোথায় যায়, কার সঙ্গে সময় কাটায় এটা যেমন পরিবারের দেখা দরকার তেমনি দিনের একটি বেশি সময় স্কুল-কলেজে থাকায় ছেলেমেয়েদের প্রতিও শিক্ষকদের ভূমিকা রাখতে হবে। তিনি বলেন, নারী সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন, আইনজীবী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, শিক্ষক সমাজ, সাংবাদিক, জনগণ ও সচেতন অভিভাবকসহ সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধরোধ করা সম্ভব। বরিশাল ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের অতিরিক্ত দায়িত্বপালনকারী সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার মোঃ রাসেল সম্প্রতি সময়ে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, আমরা চাই ধর্ষিতা নারী দ্রুতবিচার পান। এজন্য ধর্ষণের কোন ঘটনার সংবাদ পাওয়া মাত্রই ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার থেকে দ্রুত আন্তরিকতার সঙ্গে সাপোর্ট দেয়া হয়। কার্পণ্য কিংবা প্রভাবিত হওয়ার কোন সুযোগ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে পুলিশ কমিশনারের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। তবে অনেক সময় অনেক নারী লজ্জায় ঘটনা ঘটার কয়েকদিন পর আমাদের কাছে সংবাদ পৌঁছায় অথবা ভিকটিম নিজেই লজ্জায় আলামত নষ্ট করে ফেলেন। সেক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষে ধর্ষণ হয়েছে কিনা তা নিরূপণ করা মেডিক্যাল বোর্ডের কষ্টকর হয়ে যায়। ধর্ষণ সামাজিক ব্যাধি উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, জনগণ সবারই সচেতন হতে হবে, তবেই কেবল সামাজিক এ ব্যাধি রোধ করা সম্ভব। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী এ্যাডভোকেট রনজিত সমদ্দার বলেন, বিচার প্রক্রিয়ায় ধীর গতি এটা বলা যাবে না। এজন্য মেডিক্যাল সিস্টেম দায়ী। কেননা ধর্ষণের আলামত সংগ্রহ থেকে শুরু করে আদালত পর্যন্ত রিপোর্ট পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়ে থাকে। তিনি আরও বলেন, সচেতনতার অভাবেই ধর্ষণের মতো ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধর্ষককে সমাজ থেকে বয়কট করার পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধি পেলেই এ ঘটনারোধ করা সম্ভব হবে।
×