বেগম রোকেয়ার অবরোধ বাসিনীরা আজ সুলতানার স্বপ্ন হয়ে আসমুদ্র হিমালয় ও মহাশূন্য জয় করা কর্ম ক্ষেত্রে ছুটে চলা মানুষ। যে কাজগুলো নিয়মিত ঘরে করা হয়, কিন্তু তার স্বীকৃতি, মূল্যায়ন ও আর্থিক মূল্য নেই, যেমন- পরিবারের প্রতি ভালবাসা, ঘরসাজানো, সন্তান লালন পালন, পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের দেখাশোনা করা, বাড়িঘর পরিষ্কার রাখা ইত্যাদি কাজকেই গৃহস্থালির কাজ বলা হয়। ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্ক শহরে একটি পোশাক কারখানায় নারী শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরি ও শ্রমের দাবিতে আন্দোলন, ১৯০৮ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্কে পোশাক শ্রমিক ইউনিয়নের নারীরা ১৪ দিন ধরে প্রতিবাদ সমাবেশ করে যে অধিকার আদায় করেন তার সুফলস্বরূপ আজ বর্তমান বিশ্বে ২২ জন নারী বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠা, পাকিস্তানে মালালা ইউসুফজাইয়ের নোবেল পুরস্কার লাভ, নিশাত মজুমদারের হিমালয় পর্বত জয়, সালমারা আজ বিশ্ব ক্রিকেট জয়ের পথে, জুয়েনা আজিজের জ্যেষ্ঠ সচিব, মুনজারিন রাইয়ান ও ক্যাপ্টেন আলিয়া মান্নানদের বিমান বাংলাদেশের বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার ‘আকাশবীণা’র ফার্স্ট অফিসার হয়ে ওঠা, বাগেরহাটের মেয়ে মিরোনা আজ ফুটবল কোচ হওয়া, সাবিনা ইয়াসমিনদের উবারে মোটরসাইকেল চালিয়ে যাত্রী বহন করে জীবিকা নির্বাহ করা, কিশোরগঞ্জের সাবরিনারা আজ হাওড়ের মুক্ত পরিবেশ ছেড়ে বাংলাদেশ পুলিশে যোগ দিয়ে পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে দেশের শান্তি ও শৃঙ্খলা ও সহিংসতা বন্ধে ১৮ ঘণ্টা ডিউটি করা।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউএন উইমেন প্রচার করে হিপ্পো রোলার, বাইসাইকেল, ইন্টারনেট, স্যানিটারি প্যাড ও প্যান্ট আবিষ্কারের ফলে নারীদের জীবনযাপন সহজ হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে নারীর অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অফিসে অফিসে নারী নিরাপত্তা সেল, মোরাল কমিটি গঠনের এবং নারীদের সন্ধ্যা ৬টার পর কর্মক্ষেত্র থেকে ছেড়ে দেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছে সরকার। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭৯ সালে নারীর প্রতি সকল বৈষম্য দূরীকরণের সনদ জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত হয়। জাতীয় পর্যায়ে ধর্মীয় বিধান পরিপালনসহ সাধারণ আইনের পাশাপাশি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০, যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮, বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন, ২০১৭, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ প্রভৃতি আইন ও বিধিবিধান প্রয়োগের ফলে কর্মক্ষেত্রে নারীদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবমতে ব্যাংকিং সেক্টরে ২২% নারী নিয়োজিত, গার্মেন্টস শিল্পে ৯০% নারী শ্রমিক কাজ করে বৈদেশিক রেমিটেন্স আয় করে। বাংলাদেশের মোট উদ্যোক্তার ৩২% নারী, ২০১৩ সালে উচ্চ পদে নারীর সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ২০১৭ সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার-(৮ মার্চ ২০১৯, পৃষ্ঠা প্রথম, ১৩তম, প্রথম আলোর প্রতিবেদন)। অর্থনৈতিকভাবে নারীরা আজ পুরুষের সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছে ফোবার্সের তালিকায় সবচেয়ে কম বয়সী বিলিয়নিয়রের তালিকায় নাম লিখিয়েছে কাইলি কসমেটিকের প্রতিষ্ঠাতা কাইলি জেনার। আমাদের দেশেও অনের নারী উদ্যোক্তা আছেন। যাদের মধ্যে মৌসুমী ইসলাম যার প্রতিষ্ঠান প্রোমিক্স লিমিটেড, মালিহা মেহের কাদির সহজ ডটকম, শারমিন ইসলামের সাজগোজ ডটকম, আফরোজা বেগমসহ অনেকে আছেন।
২০১৮ সালের আইএলওর ফেয়ার ওয়ার্ক এ্যান্ড কেয়ার জবস ফর দ্য ফিউচার ডিসেন্ট ওয়ার্ক শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয় এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নারীরা পুরুষের তুলনায় চার গুণ বেশি সময় গৃহস্থালির কাজ করে। ২০১২ সালের টাইম ইউজড সার্ভে বলেছে, ১৫ বছরের বেশি বয়সী কর্মজীবীদের মধ্যে ঘরের বিভিন্ন কাজে নারী দৈনিক ৩.৬ ঘণ্টা ও পুরুষ দৈনিক ১.৪ ঘণ্টা শ্রম দেয়। ২০১৭ সালে এ্যাকশন এইড বাংলাদেশর প্রতিবেদনে বলা হয় গৃহস্থালি কাজে নারী প্রতিদিন গড়ে ৭.৫০ ঘণ্টা ও পুরুষ প্রতিদিন ২.৩৭ ঘণ্টা ব্যয় করে। ২০১৪ সালে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ যৌথভাবে গবেষণার ফলাফলে বলা হয় নারী প্রতিদিন গড়ে ১২টির বেশি মজুরিবিহীন কাজ করেন। ১৯৯৫ সালে বেজিং সম্মেলনে প্লাটফর্ম অব এ্যাকশনে নারীর কাজের পরিধি, মূল্যহীন কাজকে দৃশ্যমান করা এবং মূল্যায়িত করা ও মূল্যায়িত করতে একটি জুতসই পরিসংখ্যান পদ্ধতি বের করতে বলা হয়। সিডিপি কাজের ছায়া মূল্যের মাধ্যমে প্রতিস্থাপন পদ্ধতি ব্যবহার করে দেখেন জিডিপিতে নারীর আবদান ৭৬.৮ শতাংশ। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ বাস্তবায়নে ২০১৩ সালের কর্মপরিকল্পনায় গৃহস্থালি কাজের স্বীকৃতি এবং জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। তবে এতে বাস্তবায়নের উপায় বাতলে দেয়া হয়নি। নারীর গৃহস্থালির কাজের বোঝা এবং স্বীকৃতি না থাকার ফলে ঘরের ভেতরে নারী নির্যাতনের ঘটনা বেশি ঘটছে। সরকারকে অতিদ্রুত জাতীয় হিসাব পরিমাপের এমন একটি পদ্ধতি বের করতে হবে, যাতে নারীদের বেতনহীন কাজ জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এ্যাকশন এইড বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার বিষয়ক সচেতনামূলক প্রকল্প ‘পাওয়ার’-এর প্রচারণার পুরুষদের গৃহস্থালি কাজে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে, নারীদের অংশগ্রহণ কমতে শুরু করেছে মাত্র। এভাবে চলতে থাকলে নারীরা তাদের শ্রম ও মেধা উৎপাদনমূলক কাজে ব্যয় করার সুযোগ পাবে। এভাবে প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে নারীদের গৃহস্থালি কাজের মূল্য নিরূপণ করা সম্ভব হলে নারী নির্যাতন বন্ধ হয়ে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হবে।
শীর্ষ সংবাদ: