ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরসহ ইমিগ্রেশনে সতর্কতা

বাংলাদেশী ২০ আইএস জঙ্গীর দেশে ফেরা ঠেকাতে কঠোর নির্দেশ

প্রকাশিত: ১০:৫৯, ২৫ এপ্রিল ২০১৯

বাংলাদেশী ২০ আইএস জঙ্গীর দেশে ফেরা ঠেকাতে কঠোর নির্দেশ

শংকর কুমার দে ॥ বাংলাদেশে ফিরতে চায় ২০ ইসলামিক স্টেটস (আইএস) জঙ্গী। বাংলাদেশ থেকে আইএসে যোগ দিতে সিরিয়া-ইরাক গেছে ৪০ জন। এর মধ্যে মারা গেছে ২০। সিরিয়া-ইরাকে আইএস জঙ্গীদের শেষ ঘাঁটি পতনের পর জীবিত ২০ আইএস জঙ্গী দেশে ফিরে আসার চেষ্টা করছে। শ্রীলঙ্কায় ভয়াবহ বোমা হামলার বিষয়ে আইএস জঙ্গীরা দায় স্বীকার করার পর বাংলাদেশী আইএস জঙ্গীরা দেশে ফিরে আসতে পারে এমন আশঙ্কায় বিমানবন্দর, স্থলবন্দর, সীমান্ত এলাকায় বার্তা পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে যারা আইএসে যোগদান করেছে কালোতালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ওরা যাতে দেশে ঢুকতে না পারে সেজন্য সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দেশে ফিরে আসার চেষ্টা করলেই আইএস জঙ্গীদের গ্রেফতার করা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, শ্রীলঙ্কায় ভয়াবহ বোমা হামলায় বাংলাদেশী ও বিদেশীসহ বহু হতাহতের ঘটনায় আবারও আলোচনায় এসেছে আইএস জঙ্গীর বিষয়টি। বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে গোপনে নানা কৌশলে ইরাক-সিরিয়ায় গিয়ে আইএসে যোগ দিয়েছে ৪০ বাংলাদেশী। তাদের তালিকা হাতে পেয়েছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। বিভিন্ন দেশের সহযোগিতা ও তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে তালিকাটি তৈরি করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরা সবাই জন্মসূত্রে বাংলাদেশী অথবা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত। অনেকে আবার বাংলাদেশ ছাড়াও অন্য দেশের দ্বৈত নাগরিক। তবে এদের মধ্যে ২০ জন ইতোমধ্যে মারা গেছে, বাকিরা বাংলাদেশে ফেরার চেষ্টা করছে বলে গোয়েন্দা সংস্থাকে জানিয়েছে কয়েকটি বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা। আইএসে যোগদানকারীরা দেশে ফিরলেই তাদের গ্রেফতার করা হবে বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ জন্য দেশের সব বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে তাদের নামের তালিকা পাঠানো হয়েছে। তারা যেন কোনভাবেই দেশে ঢুকতে না পারে, আর আসলেই যাতে গ্রেফতার করা হয় সে বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাদের শনাক্ত করা মাত্রই গ্রেফতার করবে এবং বিষয়টি তাৎক্ষণিক কাউন্টার টেররিজম ইউনিটকে জানানোর নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। যেসব বাংলাদেশী জঙ্গী দেশে ফিরে আসতে চায়, তারা বাংলাদেশের জন্য হুমকি বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, তালিকাভুক্ত যে ৪০ বাংলাদেশী আইএস জঙ্গীর খাতায় নাম লিখিয়েছে তারা সবাই রাজনীতিবিদ, শিল্পপতি ও উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের আত্মীয়-সন্তান। আর এদের মধ্যে আইএসের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিল সাইফুল হক সুজন ও আশিকুর রহমান। আইটি বিশেষজ্ঞ সাইফুল হক সুজন সিরিয়ায় যুদ্ধে নিহত হয়েছে। তার স্ত্রীর নাম সায়মা আক্তার মুক্তা। দুই সন্তানসহ গর্ভবতী স্ত্রীকে নিয়ে সিরিয়া যায় সুজন। সিরিয়া যাওয়ার পর ওসমান নামে তার একটি সন্তান হয়। খুলনার ইকবাল নগরে তাদের বাসা। মারা যাওয়ার পর আইএস তাকে ‘সাহসী মুজাহিদ’ হিসেবে অভিহিত করে। কাওরানবাজারে তার একটি কম্পিউটার ফার্ম ছিল। সম্প্রতি স্পেন থেকে সুজনের ভাই আতাউল হক ৫০ লাখ টাকা পাঠায় এই ফার্মের নামে। এই টাকাসহ সুজনের বাবা ও তার আরেক ভাইকে গ্রেফতার করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। পরে কারাগারে তার বাবা মারা যান। ওই ৫০ লাখ টাকা গুলশানের হলি আর্টিজান হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিমকে দেয়ার জন্য পাঠানো হয়েছিল। এটা জঙ্গী অর্থায়নের টাকা। সুজনের সিরিয়া যাওয়ার বিষয়টি জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানায় তার বাবা-ভাই। আরেক জঙ্গী নেতা প্রকৌশলী বাশারুজ্জামান উত্তরাঞ্চলে অভিযানে নিহত হয়। সে সুজনদের ফার্মে কাজ করত। তার সঙ্গে সিরিয়ার আইএসের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল বলে জানতে পেরেছে তদন্ত সংস্থা। তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক ডাঃ রোকন উদ্দিন খন্দকার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে সিরিয়া গিয়েছিলেন আইএসের পক্ষে কাজ করতে। যুদ্ধাহত আইএস জঙ্গীদের চিকিৎসা সেবার দায়িত্বে ছিলেন তিনি। তার স্ত্রীর নাম নাইমা আক্তার, মেয়ে রেজোয়ানা রোকন, জামাই সাদ কায়েজ ও মেয়ে রোমিকা রোকন। ঢাকার খিলগাঁও চৌধুরীপাড়ায় তাদের বাড়ি। সব বিক্রি করে তারা সিরিয়া যায়। যৌথবাহিনীর আক্রমণে সিরিয়ায় আইএস ছিন্নভিন্ন হওয়ায় তারা এখন দেশে ফিরতে চায়। যৌথবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে রোকনউদ্দিন খন্দকার ও তার পরিবার। তবে পালিয়ে বাংলাদেশে আসার চেষ্টা এখনও চালিয়ে যাচ্ছে পাঁচ সদস্যের এই পরিবার। অপরদিকে ইব্রাহিম হাসান খান ও জুনায়েদ খান নামে দুই ভাইও সিরিয়া গিয়েছিল। তাদের মা-বাবা সৌদি আরবে থাকে। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ডাঃ আনোয়ার ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী। সেও সপরিবারে ব্রিটেন থেকে সিরিয়া যায়। যুক্তরাজ্য সরকার তার পাসপোর্ট বাতিল করেছে। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক হবিগঞ্জের বাসিন্দা ইবনে হামদুদ আইএসের সদস্য। তার আসল নাম সামিউন রহমান। আইএসের দেয়া নাম ইবনে হামদুদ। বাংলাদেশে আসার পর তার কর্মকা-ে আইএসের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পায় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। এই তিনজন গ্রেফতারও হয়। তখন দেশের সুশীল সমাজের একটি অংশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ইবনে হামদুদ ব্রিটিশ সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে জড়িত। পরে জামিনে মুক্ত পায় সামিউন। এ ঘটনার কিছুদিন পর সামিউন দিল্লীতে গেলে ভারতের গোয়েন্দা নেটওয়ার্কে ধরা পড়ে সামিউনের আইএসে জড়িত থাকার কর্মকা-। পরে তাকে গ্রেফতার করা হয় বলে জানা গেছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক উর্ধতন কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশের ৪০ জনের তালিকা বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরসহ সব ইমিগ্রেশনে পাঠানো হয়েছে। সিরিয়া ও ইরাক থেকে যারা আসবে তাদের সব তথ্য দেখে তালিকাভুক্তদের কেউ থাকলে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা হবে। তিনি বলেন, এয়ারপোর্ট ও স্থলবন্দরগুলো কঠোর নজরদারিতে রাখা হয়েছে। আইএসের সদস্য আসা মাত্রই গ্রেফতার করা হবে। এ বিষয়ে অন্যান্য ইন্টেলিজেন্সের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। ইরাক-সিরিয়ায় আইএসের শেষ ঘাঁটি পতনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আইএসের সর্বশেষ ঘাঁটির পতন ঘটেছে এমন খবর পেয়েছেন ঢাকার গোয়েন্দারাও। এ অবস্থায় যেসব বাংলাদেশী সদস্য আইএসে যোগ দিয়ে অত্যাধুনিক অস্ত্র চালনা ও বোমা তৈরিতে পারদর্শী হয়েও বেঁচে আছে তারা যদি দেশে ফিরতে সক্ষম হন, তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে এ নিয়ে নতুন করে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আইএসফেরত যোদ্ধারা বাংলাদেশের জন্য হুমকি হয়ে উঠবে- এটিই স্বাভাবিক। তারা বসে থাকবেন না এবং অন্যদের জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ করবে। এ কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক রয়েছে বলে পুলিশের ওই কাউন্টার টেররিজম ইউনিট কর্মকর্তার দাবি।
×