ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা ইস্যু চাপা দিতেই এই অপপ্রয়াস?

প্রকাশিত: ১১:০৬, ৯ এপ্রিল ২০১৯

রোহিঙ্গা ইস্যু চাপা দিতেই এই অপপ্রয়াস?

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ দেশের সর্ব দক্ষিণ পয়েন্টে সেন্টমার্টিন দ্বীপের অবস্থান। এটি বাংলাদেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ। দেশের মানচিত্রে এর অবস্থান সুরক্ষিত। অথচ, প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার সাম্প্রতিক সময়ে এ দ্বীপ তাদের বলে দাবি করে ঔদ্ধত্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছে। মিয়ানমার সে দেশের রাখাইন রাজ্য থেকে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে বাস্তুচ্যুত করে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে। ওরা এখন বাংলাদেশে মানবিক কারণে আশ্রিত হয়ে আছে। কিন্তু এই রোহিঙ্গা ইস্যুটি সারাবিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। যদিও মিয়ানমার সরকার বরাবরই এই ইস্যুর সমাধানে গোয়ার্তুমি মনোভাব প্রদর্শন করে চলেছে। এ ইস্যুতে মিয়ানমার বিশ্বব্যাপী মানবতাবিরোধী অপরাধের কাঠগড়ায় রয়েছে। পৃথিবীর বহু দেশে মিয়ানমার সরকার ও সে দেশের এনএলডি নেত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আউং সান সুচি বিভিন্নভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়ে আছেন। এসব বিষয়াদি নিয়ে মিয়ানমার সরকারের সার্বিক অবস্থান নেতিবাচক পর্যায়ে রয়েছে। রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরোচিত কায়দায় হত্যাকা-, ধর্ষণ, জ্বালাও পোড়াও ও জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করার ঘটনা এবং তাদেরকে পুনরায় নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের ইস্যুটি দীর্ঘ সময়ের জন্য চাপিয়ে রাখতেই স্বাধীন সার্বভৌম এদেশের মানচিত্র খচিত প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন নিয়ে ষড়যন্ত্রের বহির্প্রকাশ ঘটিয়েছে। যা বর্মী ষড়যন্ত্রের আগ্রাসন ও নতুন রূপ হিসেবে ইতোমধ্যে চিহ্নিত হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন সূত্রে ইতোমধ্যে বিষয়টি পরিষ্কার করে জানান না দিলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে ‘সেন্টমার্টিন নিয়ে বাড়তি সতর্কতা’ নিয়েছে সরকার। হঠাৎ করে কেন এ সতর্কতার বিপরীতে ভারি অস্ত্র সাজে বিজিবি সদস্যদের মোতায়েনÑ তা নিয়ে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসছে মিয়ানমার সরকারের অপকৌশলের নানা চিত্র। ২শ’ বছরেরও বেশি সময় আগে টেকনাফের দক্ষিণে সমুদ্রবক্ষে জেগে ওঠে একটি ভূখ-, যার নাম প্রথমে ছিল জিরানো (জিরিয়ে নেয়া)। পরে দ্বীপটিতে সারি সারি নারিকেল গাছ লাগানোর পর এ দ্বীপের নাম হয় নারিকেল জিঞ্জিরা। আরও পরে খ্রীস্টান সাধু মার্টিনের নামানুসারে এটির নাম হয়ে যায় ‘সেন্টমার্টিন’ দ্বীপ। কালের পরিক্রমায় এই দ্বীপটি পর্যটকদের আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। এ দ্বীপ নিয়ে মিয়ানমার সরকার ইতিপূর্বে কখনও কোন ধরনের দাবি তোলেনি। এমনকি বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারকালীনও করেনি। কিন্তু গত বছরের অক্টোবরে মিয়ানমার সরকারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তাদের মানচিত্রে এই সেন্টমার্টিন দ্বীপকে তাদের ভূখ-ের অংশ হিসেবে প্রদর্শন করা হয়। বিষয়টি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গত বছরের ৬ অক্টোবর ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে এর তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। তখন ঘটনাটি মিয়ানমারের ভুল বলে বক্তব্য দেয়া হয় এবং মানচিত্র থেকে সেন্টমার্টিনকে সরিয়ে দেয়ার আশ্বাসও প্রদান করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে আরও একদফায় মিয়ানমারের পক্ষে অনুরূপ ঘটনার অবতারণা করা হয়। শুধু তাই নয়, গত ফেব্রুয়ারি মাসেও মংডু টাউনশিপে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে মিয়ানমারের কর্মকর্তারা বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন দ্বীপকে তাদেরই অংশ বলে দাবি জানায়। বিষয়টি একদিকে নীতি নৈতিকতা বিবর্জিত ঘটনা এবং অনাহূতভাবে একটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা জন্ম দেয়ার বহির্প্রকাশ হিসেবে চিহ্নিত হয়। এ অবস্থায় গত ৬ এপ্রিল থেকে মিয়ানমারের নেপিদো শহরে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত সম্মেলন। শেষ হবে আগামীকাল ১০ এপ্রিল। এ সম্মেলন থেকে দুই দেশের সীমান্ত নিয়ে কি বক্তব্য আসবে তা অপেক্ষমাণ। এ অবস্থায় গত রবিবার দুপুর থেকে আকস্মিকভাবে সরকারের নির্দেশে এ সেন্টমার্টিন দ্বীপে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। সোমবার দ্বিতীয় দিন থেকে শুরু হয়েছে বিওপি (বর্ডার আউট পোস্ট) প্রতিষ্ঠার কাজ এবং সশস্ত্র বিজিবি টহল দান। উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত এ দ্বীপে তৎকালীন বিডিআর মোতায়েন ছিল। এরপর এর দায়িত্ব অর্পিত হয় বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের ওপর। রবিবার থেকে কোস্টগার্ডের সঙ্গে এ দ্বীপের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যুক্ত হলো বিজিবি। উল্লেখ করা যেতে পারে, দ্বীপটিতে বর্তমানে প্রায় ৮ হাজার মানুষের বসবাস রয়েছে। দেশের সর্ব দক্ষিণে মূল ভূখ- টেকনাফ থেকে বিচ্ছিন্ন এ দ্বীপে ট্রলার বা জাহাজযোগে যেতে সময় লাগে প্রায় আড়াই ঘণ্টা। সমুদ্র পথে দূরত্ব প্রায় ৩২ কিলোমিটার। দ্বীপটির বিস্তৃতি প্রায় ৮ বর্গ কিলোমিটার। ব্রিটিশ শাসনামল থেকে এ দ্বীপটি কক্সবাজার জেলার ভূখ- হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৩৭ সালে তৎকালীন বার্মা ও ভারত যখন বিভক্ত হয় তখন এ দ্বীপটি ভারতের অংশে পড়ে। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় দ্বীপটি পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্ব পাকিস্তানের অংশে অন্তর্ভুক্ত থাকে। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হলে তখনও এটি বাংলাদেশের সঙ্গেই অন্তর্ভুক্ত থাকে। ১৯৭৪ সালে সেন্টমার্টিনকে বাংলাদেশের অংশ ধরে নিয়েই মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা চুক্তি সম্পাদিত হয়। পরবর্তীতে সমুদ্রসীমা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে দীর্ঘ সময় মামলা চলার পর মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণে রাখা বিশাল সমুদ্রসীমা বাংলাদেশের অংশ হিসেবে রায় ঘোষিত হয়। সেন্টমার্টিন দ্বীপের আয়তন প্রায় ৮ বর্গ কিলোমিটার ও উত্তর-দক্ষিণে আড়াআড়িভাবে লম্বা। দ্বীপটির প্রস্থ কোথাও ৭শ, আবার কোথাও ২শ মিটার। দ্বীপের পূর্ব-দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে সাগর এলাকা পর্যন্ত রয়েছে অসংখ্য শিলাস্তূপ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এ দ্বীপের গড় উচ্চতা ৩ দশমিক ৬ মিটার। পশ্চিম-উত্তর-পশ্চিম দিকজুড়ে রয়েছে ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটারের প্রবাল প্রাচীর। দ্বীপটির ভূপ্রকৃতি মূলত সমতল। গঠন উপাদান চুনা পাথরে। এ দ্বীপে প্রায় ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির গুপ্তজীবী উদ্ভিদ, ২৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪ প্রজাতির উভয়চর ও ১২০ প্রজাতির পক্ষীকুলের অবস্থান রয়েছে। এছাড়া রয়েছে ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সামুদ্রিক কচ্ছপ এবং জলপাই রঙের কাছিম প্রজাতির ডিম পাড়ার উপযুক্ত স্থান হিসেবে এটির খ্যাতি রয়েছে। গত দুই দশকের বেশি সময়জুড়ে এ দ্বীপটি পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রে পরিণত হয়ে আছে। সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমার সরকার এ দ্বীপটিকে তাদের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করে দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়ে মূলত কোন স্বার্থ হাসিল করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত রয়েছে তা এখনও পুরোপুরিভাবে সুস্পষ্ট নয়। সে দেশের সরকারের দুটি ওয়েবসাইটে তাদের মানচিত্রে সেন্টমার্টিনকে অন্তর্ভুক্ত করে তাদের ভূখ-ের অংশ দেখানোর অপচেষ্টা রোধে বাড়তি সতর্কতা হিসেবে রবিবার থেকে আপাতত স্থায়ীভাবে বিজিবি মোতায়েনের ঘটনা ঘটেছে বলে বিভিন্ন সূত্রে ধারণা পাওয়া গেছে। তবে মিয়ানমার পক্ষকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, ২০১২ সালে সমুদ্রসীমা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়েও প্রমাণিত হয়েছে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন বাংলাদেশের অভিন্ন একটি অংশ।
×