ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

খালেদার প্যারোল নিয়ে নানা বক্তব্য, বাস্তবে কী ঘটতে যাচ্ছে!

প্রকাশিত: ১০:১৫, ৮ এপ্রিল ২০১৯

  খালেদার প্যারোল নিয়ে নানা বক্তব্য, বাস্তবে কী ঘটতে যাচ্ছে!

শরীফুল ইসলাম ॥ বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা হলেও এটি এখনও অস্পষ্ট। তাকে প্যারোলে মুক্ত করতে হলে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতার প্রয়োজন। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোন সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে কোন পক্ষ থেকেই জানানো হয়নি। তবে বিএনপির কিছু নেতা খালেদা জিয়াকে প্যারোলে মুক্ত করতে ভেতরে ভেতরে আওয়ামী লীগের কিছু নেতার সঙ্গে দেনদরবার চালিয়ে যাচ্ছেন। বিদেশী কূটনীতিকদের মধ্যেও কেউ কেউ এ প্রক্রিয়ায় জড়িত। তাই শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি হয় কি না আর হলেও কখন হয় তা এখনও স্পষ্ট নয়। উল্লেখ্য, খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার পর থেকেই আইনী প্রক্রিয়ায় মুক্তির চেষ্টা করে বিএনপি। এক পর্যায়ে কারাগারে খালেদা জিয়া অসুস্থ হয়ে পড়লে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেনসহ ক’জন নেতা তাকে সুচিকিৎসার জন্য প্যারোলে মুক্তির দাবি জানান। কিন্তু দলের সিদ্ধান্তের বাইরে এ দাবি জানানোর কারণে লন্ডন প্রবাসী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ কিছু নেতা এতে ক্ষুব্ধ হন। এরপর আর দলের কোন নেতা খালেদা জিয়ার প্যারোলের দাবি জানাননি। সম্প্রতি কারাগারে বিএনপি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে আত্মীয়স্বজনদের ইচ্ছায় বিএনপির কিছু নেতা ভেতরে ভেতরে আওয়ামী লীগের কিছু নেতার সঙ্গে প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি নিয়ে দেনদরবার শুরু করেন। ১ এপ্রিল খালেদা জিয়াকে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেবিনে ভর্তি করে চিকিৎসা শুরুর পর আবার তার প্যারোলের বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা শুরু হয়। বিএনপির ক’জন নেতাও এ নিয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে দলের কিছু নেতা চেষ্টা করলেও প্রকাশ্যে মহাসচিব মির্জা ফখরুলসহ অন্য নেতারা প্যারোলে খালেদা জিয়া মুক্তি নেবেন না বলে জানান। আবার কেউ কেউ বলেন, প্যারোলে মুক্তি নেবেন কি না সেটা খালেদা জিয়ার ইচ্ছের ওপর নির্ভর করবে। এদিকে অতি সম্প্রতি খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি নিয়ে সারাদেশে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়। এ পরিস্থিতিতে ৫ এপ্রিল ২১ দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বিএনপি নেতারা বৈঠক করে খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসা ও মুক্তির বিষয়ে তাদের সহযোগিতা চান। এরপর খালেদা জিয়ার প্যারোলের বিষয়টি আরও বেশি আলোচনায় আসে। এ পরিস্থিতিতে ৬ এপ্রিল জামালপুরে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, খালেদা জিয়া যদি সুনির্দিষ্ট কারণ দেখিয়ে প্যারোলে মুক্তির আবেদন করেন, তাহলে বিষয়টি আমরা ভেবে দেখব। প্যারোলে মুক্তি পেতে হলে একটি সুনির্দিষ্ট ও যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে আবেদন করতে হবে। তবে তার প্যারোলে মুক্তির জন্য এখনও কোন আবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পায়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের একদিন পর রবিবার আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ ধানম-ির রাজনৈতিক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের কাছে বলেন, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি রাজনৈতিক কোন বিষয় নয়, এটা তো আইনী বিষয়। তবে তার প্যারোলে মুক্তির মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তিনি বলেন, সাধারণত দন্ডপ্রাপ্ত কারও আত্মীয়-স্বজন মারা গেলে তাকে শেষ দেখার জন্য, শেষকৃত্যের জন্য ও অসুস্থ হলে প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি আসে। তবে আমার জানা মতে, তার তেমন কোন পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন রবিবার কুমিল্লার এক মামলায় খালেদা জিয়ার হাইকোর্টের জামিন সুপ্রীমকোর্টে বহালের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তি পাবেন কি পাবেন না তা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। তিনি এক বছরেরও বেশি সময় ধরে কারাগারে থেকে অসুস্থ হয়ে পরেছেন। এখন ম্যাডাম প্যারোল চাইবেন কিনা এবং সরকার প্যারোল দেবে কিনা এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। আমরা আইনজীবী হিসেবে এটুকু বলতে পারি যে, চিকিৎসার জন্য প্যারোল চাওয়া যায়। আবার রাষ্ট্রও প্যারোলে মুক্তি দিতে পারে। বিভিন্ন দেশে প্যারোলে রাজবন্দীদের মুক্তির উদাহরণ তুলে ধরে খন্দকার মাহবুব বলেন, বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত ও পাকিস্তানে প্যারোলে মুক্তির বহু নজির আছে। রাজবন্দীদের প্যারোলে মুক্তির কথা প্রায়ই শোনা যায়। আমরা চাই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে আইনগতভাবে মুক্তি দেয়া হোক। তিনি বলেন, খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় আটক রাখা হয়েছে। তার সব মামলা রাজনৈতিক বিবেচনায়। তাই আইনী প্রক্রিয়ার চেয়ে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার মুক্তির পথ খুঁজতে হবে। খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে সরকার তাকে মুক্তি দেবে বলে আশা করছি। রবিবার খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে গণঅনশন কর্মসূচীতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তি নেবেন না। তিনি আইনী প্রক্রিয়ায়ই মুক্তি পাবেন। তাকে মুক্তি না দিলে আমরা দুর্বার আন্দোলনের মাধ্যমে মুক্ত করে আনব। আমরা খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি চাই না। আমরা আইনী প্রক্রিয়ায় তার মুক্তি চাই। একই কর্মসূচীতে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, কারো অনুকম্পা বা দয়ায় নয়, আন্দোলনের মাধ্যমেই খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হবে। গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, খালেদা জিয়া আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের কাছে ফিরে আসবেন। তবে শেখ হাসিনা প্যারোলে মুক্তি নিয়েছিলেন। কিন্তু খালেদা জিয়া প্যারোল নেননি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তি নেবেন না। সূত্র মতে, খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি চায় দলের একটি অংশ। আর অপর অংশটি চায় আইনী প্রক্রিয়ায় মুক্ত করতে। এ নিয়ে দলের নেতারা দ্বিধাবিভক্ত। এ পরিস্থিতিতে করণীয় ঠিক করতে খোদ খালেদা জিয়ার নির্দেশের অপেক্ষায় বিএনপি। তাই যত দ্রুত সম্ভব দলের ক’জন নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চিকিৎসা বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে এ বিষয়ে খালেদা জিয়ার নির্দেশনা চাইবেন। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে প্যারোলে মুক্ত করতে হলে এ দলটিকে বেশ ক’টি শর্ত মানতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে, দেশের ইমেজ ক্ষুণ্ণ হয় দল থেকে এমন কোন কাজ না করা, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দল থেকে নির্বাচিত ৬ জনকে শপথ নিয়ে সংসদে যোগদান, রাজপথে কোন নেতিবাচক আন্দোলন কর্মসূচী পালন না করা, এ সরকারের অধীনে সকল নির্বাচনে অংশ নেয়া এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কোন নেতিবাচক প্রচার না করা ইত্যাদি। জানা যায়, দলের উদারপন্থী নেতারা বিশেষ করে যারা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচিত হয়েছে তাদের এসব শর্তের বিষয়ে তেমন আপত্তি না থাকলেও কট্টরপন্থী নেতারা এসব শর্ত মেনে খালেদা জিয়াকে প্যারোলে মুক্ত করতে নারাজ। তবে খালেদা জিয়ার আত্মীয়-স্বজন ও উদারপন্থী নেতারা মনে করেন, আইনী লড়াইয়ে তাকে মুক্ত করা সম্বব নয়। আপাতত তার জামিনও হচ্ছে না। এ ছাড়া তার শারীরিক অবস্থাও ভাল নয়। এ পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়াকে প্যারোলে মুক্ত করে হয় দেশের ইউনাইটেড হাসপাতাল না হয় লন্ডনে নিয়ে চিকিৎসা করাতে চান। তা করা গেলে চিকিৎসার পাশাপাশি দল পরিচালনার জন্য খালেদা জিয়ার নির্দেশনাও নেয়া যাবে। এতে বিএনপিও লাভবান হবে। অভিজ্ঞ মহলের মতে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে প্যারোলে মুক্ত করতে হলে বিএনপিকে সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছতে হবে। আর তা করতে হলে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের অনুমতি লাগবে।
×