ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মঙ্গল শোভাযাত্রা যেভাবে বাঙালীর নববর্ষ উৎসবের প্রচ্ছদ

প্রকাশিত: ১০:০৯, ৮ এপ্রিল ২০১৯

 মঙ্গল শোভাযাত্রা যেভাবে বাঙালীর নববর্ষ উৎসবের প্রচ্ছদ

সমুদ্র হক ॥ পহেলা বৈশাখ বরণে মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের প্রচ্ছদ হয়ে চিরন্তন মঙ্গলের প্রতীক রূপে এসেছে বাঙালী জীবনে। শহুরে জীবনে গ্রামীণ সংস্কৃতির এই প্রচ্ছদ এখন সারাবিশ্বে বাঙালীর পরিচিতির প্রচ্ছদ। ৩৩ বছর আগে যশোরে নববর্ষ বরণে প্রথমবারের মতো আনন্দ শোভাযাত্রা গোটা শহর প্রদক্ষিণ করে। আনন্দ শোভাযাত্রার এই লোকজ ঐতিহ্য বাঙালীর অসাম্প্রদায়িক চেতনার একমাত্র উৎসবে যোগ হয়েছে। এখন তো নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা বইয়ের প্রচ্ছদের মতো নববর্ষের উৎসবের প্রচ্ছদ হয়ে উঠেছে। এই সেদিনও মঙ্গল শোভাযাত্রায় নানা ধরনের মুখোশ পরে তরুণরা নেচে গেয়ে আনন্দ প্রকাশ করত। বর্তমানে এই ধারায় অনেকটাই পরিবর্তন এসেছে। মঙ্গল শোভাযাত্রায় বাঙালীর জীবনাচরণ ঐতিহ্য থাকবে না তা কী হয়? মুখোশের পর চারুকর্মে প্রথমে এ দেশের প্রাণিকুল হাতি, সিংহ, বাঘ, কুমির, ঘোড়া, দোয়েল, কোয়েল, কোকিল, ঘুঘু শালিখ, লক্ষ্মী পেঁচাসহ গাছ-গাছালি নদ-নদী সবই উঠে আসে। গত দু’বছর ধরে মঙ্গল শোভাযাত্রায় শোলার ঘোড়ার গাড়ি বানিয়ে বাঙালীর বিয়ের বর কনেকে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। কৃষক রোদ বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে মাথায় মাথল এঁটে লাঙ্গল দিয়ে যেভাবে জমি চাষ করে তা নৃত্যের ছন্দে ছন্দে ফুটিয়ে তোলা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রায়। এভাবে কিষান-কিষানি, জেলে-জেলেনী, মাঝি-মাল্লা ঢুলি সবই মঙ্গল শোভাযাত্রায় নৃত্যের ছন্দে তুলে ধরা হয়। বর্তমানের মঙ্গল শোভাযাত্রা আর দশটা শোভাযাত্রার মতো নয়। সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। সর্বজনীন এমন মঙ্গল শোভাযাত্রা দেশজুড়ে নববর্ষে সম্প্রীতির আনন্দ বয়ে আনে। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর আনন্দ উৎসবে (যেমন ঈদ, পূজা, ক্রিস্টমাস, বৌদ্ধ পূর্ণিমা ইত্যাদি) শুধু সেই ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণে আনন্দ থাকে। ওইসব অনুষ্ঠানে অন্য ধর্মের মানুষ সম্প্রীতির আমন্ত্রণে বা নিমন্ত্রণে অংশগ্রহণ করেন মাত্র। বাঙালীর নববর্ষের বৈশাখের উৎসবে সকল ধর্মের সকল বর্ণের মানুষের মিলনমেলা হয়ে ওঠে। সম্প্রীতির এমন মেলবন্ধন বিশ্বের অন্য কোন উৎসবে নেই। যে কারণে বৈশাখের আনন্দ শোভাযাত্রাটি মঙ্গল শোভাযাত্রায় রূপান্তরিত হয়ে ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হয়ে এসেছে। জাতিসংঘের সংস্থা ইউনেস্কো ’১৬ সালের ৩০ নবেম্বর বাঙালীর নববর্ষের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রাকে’ বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। এর আগে সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ইউনেস্কোয় মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকার জন্য আবেদন করে। ওই বছর ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবায় ইউনেস্কোর সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক পর্ষদ ‘ইন্টারগবর্নমেন্টাল কমিটি ফর দ্য সেফগার্ড অব দ্য ইনট্রানজিবল কালচারাল হেরিটেজে’ বিষয়টি উত্থাপিত হলে বাংলাদেশের প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয়। এর আগে এই স্বীকৃতি পেতে ২০০৬ সাল থেকে ইউনেস্কোর চাহিদা অনুযায়ী সকল কাগজপত্র উপস্থাপন করা হয়। ধারাবাহিকতায় ’১৪ সালে প্যারিসে ইউনেস্কোর সদর দফতরে আবেদন করে। মঙ্গল শোভাযাত্রার আগে ১৯৮৬ সালে প্রথমে চারুপীঠ নামে যশোরের একটি সংগঠন নববর্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করে। যেখানে ছিল পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, পুরান বাদ্যযন্ত্র। এই আনন্দ শোভাযাত্রা দেশে আলোড়ন তোলে। এরই ধারাবহিকতায় সকল অপশক্তির অবসান কামনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ’৮৯ সালের ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষে প্রথম আনন্দ শোভাযাত্রা বের হয় ঢাকায়। সারাদেশের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বাঙালীর সর্বজনীন উৎসব নববর্ষে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই শোভাযাত্রায় ছিল বিশাল চারুকর্ম, পুতুল, হাতি, ঘোড়া, কুমির বাদ্যযন্ত্র নানা ধরনের মুখোশ। পরের বছরে নানা ধরনের শিল্পকর্মে আনন্দ শোভাযাত্রা আরও জনপ্রিয়তা পায়। ’৯১ সালে জনপ্রিয়তায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয় ঢাবি উপাচার্য, শিক্ষক, বিশিষ্ট লেখক, শিল্পীসহ সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ। নৃত্যগীতের সঙ্গে ঐতিহ্যের নিদর্শন প্রদর্শিত হয় আনন্দ শোভাযাত্রায়। এভাবেই পহেলা বৈশাখ বরণে মঙ্গল শোভাযাত্রায় আরও নতুন মাত্রা যোগ হয়। শোভাযাত্রার সামনের সারিতে রং বেরঙের পোশাক পরে চারুকলা ও বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঐতিহ্যের নানা জিনিস নিয়ে নাচের তালে এগোতে থাকে। ’৯৩ সালে ১৪০০ বঙ্গাব্দে প্রবেশের পয়লা বোশেখে এই আনন্দ শোভাযাত্রা এতটাই বর্ণাঢ্য হয়ে ওঠে যা দেশজুড়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান নেয়। প্রতি বছর বাংলা নববর্ষের এমন সর্বজনীন আনন্দঘন শোভাযাত্রা ১৯৯৬ সালের ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রায়’ রূপান্তর হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রার গতি আর থেমে থাকেনি। এর দশ বছর পর বাঙালীর মঙ্গল শোভাযাত্রা জাতিসংঘের ইউনেস্কোর বিশ^ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে এতটাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যা বর্তমানে বিশে^র দেশে দেশে পালিত হচ্ছে। ’১৭ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা শহর প্রদক্ষিণ করে। ভারতের উড়িষ্যা, ত্রিপুরা, আসামে বাঙালীর মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন লোকজ উৎসবে রূপ নিয়েছে। বাঙালীর আরও তিনটি জিনিস একই মর্যাদা পেতে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড কালচারাল হেরিটেজ ফাইলে সংযুক্ত আছে। এর মধ্যে ২০০৮ সালে বাঙালীর বাউল গান, ’১৩ সালে বয়ন শিল্প জামদানি এবং ’১৫ সালে সিলেটের বয়ন শিল্প শীতল পাটি বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় বিবেচিত হয়ে আছে। নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রায় বাউল, জামদানি শাড়ি, শীতল পাটি প্রদর্শিত হয়। তবে নববর্ষে মেয়েরা লাল পেড়ে সাদা শাড়ি ও ছেলেরা বাহারি পাঞ্জাবি পরে ঐতিহ্যের ধারা তুলে ধরে। নববর্ষে বাঙালী ঐতিহ্যের সব কিছুই উঠে আসে, যা অন্য কোন উৎসবে আসে না। গ্রামীণ জীবনের গেরস্থালি সামগ্রী মাটির পাতিল, কুলা, ডালা, ধামা, হোঁচা, চাটাই, ছিকা, বেড়া বাঙালীর ঘরে আসে। পাশাপাশি খাবারদাবার যেমন মুড়ি মুড়কি, চিড়া দই, খই, খাগরা, বাতাসা, লই, কদমা, জিলাপি, ছাঁচের নক্সি খাবার, রসগোল্লা, টক দই ওইদিনের খাদ্য তালিকায় যুক্ত হয়। পান্তা ভাত তো বৈশাখের অন্যতম খাবার হিসেবে অনেক আগেই যোগ হয়েছে। না বুঝেই শহুরে মানুষ যোগ করে পান্তা-ইলিশ। তবে ইলিশ পান্তার চল ইদানিং উঠে যাচ্ছে সব কিছু ছাপিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙালীর নববর্ষ বরণে সব আয়োজনের প্রচ্ছদ হয়ে চিরন্তনের মঙ্গল হয়ে এসেছে। চিরন্তনের এই প্রচ্ছদ বিশ্বে বাঙালীর পরিচিতির প্রচ্ছদ।
×