যশোর মানে সেতু। পশ্চিম ও পূর্ব বাংলার মধ্যে সেতুবন্ধন এই যশোর। ব্রিটিশ আমলে এই যশোর সর্বপ্রথম জেলাতে উন্নীত হয়। যশোরের খড়কী শরীফের পীর পরিবারের ঐহিত্য সর্বজনবিদিত। সম্রাট আকবরের আমলে যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে রাজা মানসিংহের নেতৃত্বে এখানে এক অভিযান পরিচালিত হয়। এই সময় ঐ সৈয়দ সুলতান নামে এক সুফীর এখানে আগমন ঘটে। যশোরের চাঁচড়ার রাজা শুকদেব সিংহ রায় সৈয়দ সুলতানকে রাজকড়ির খিড়কী এলাকার প্রচুর নিস্কর সম্পত্তি প্রদান করেন। এই খিড়কী থেকে এলাকার নাম হয়ে যায় খড়কী। সৈয়দ সুলতান এখানে একটি খানকা শরীফ স্থাপন করেন। এই খানকাকে কেন্দ্র করে সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ইলমে তাসাওউফ চর্চার ব্যাপক প্রসার ঘটে।
সৈয়দ সুলতানের বংশধরেরা পুরুষানুক্রমে এই ধারা অব্যাহত রাখেন। সৈয়দ সুলতানের পূর্বপুরুষ দক্ষিণ আরবের ইয়েমেন থেকে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজীর আমলে দিল্লীতে আসেন এবং দিল্লীর কুতুব মিনারের পাশে অবস্থিত বুয়াতুল কুয়াতুল ইসলাম মাদ্রাসার শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।
সৈয়দ সুলতানের উত্তরপুরুষ শাহ্ করিম উদ্দিন একজন বুজুর্গ ব্যক্তি ছিলেন তার পুত্র শাহ্ সেলিম উদ্দিন চিশতী। শাহ্ সেলিম উদ্দিন চিশতীর পুত্র মাওলানা শাহ্ আব্দুল করিম (রহ) একজন উঁচু স্তরের সুফী ছিলেন। তিনি বাংলা ভাষায় ইরশাদে খালেকিয়া বা খোদা প্রাপ্তি তত্ত্ব নামক মৌলিক এবং নির্ভরযোগ্য এসওয়াফ গ্রন্থ রচনা করে বাংলাভাষায় তাসওয়াফ চর্চার পথ সুগম করেন। এই গ্রন্থ বাংলা ভাষায় সর্ব প্রাচীন তাসওয়াফ গ্রন্থ। তিনি ১৮৯১ খৃ: ১৫, ১৬ এবং ১৭ চৈত্র খড়কী শরীফে উরস মোবারকের দিন ধার্য করে মাহফিল কায়েম করেন। এই উরসে হাজার হাজার লোকের সমাগম হতে থাকে। ১৯১৫ খ্রী: মাওলানা শাহ আবদুল করিম (রহ.) ইন্তেকাল করলে তার জ্যেষ্ঠপুত্র শাহ আবুল মঈম খড়কী শরীফের গদিনসিন পীর হন। শাহ আবু নঈম (রহ) অত্যন্ত উঁচু স্তরের কামিল অলি আল্লাহ্ ছিলেন। তাঁর সময়ে এই দরবারের বিস্তৃতি বগুড়া রংপুর দিনাজপুর প্রভৃতি অঞ্চলে ঘটে। তিনি মাদারিয়া ও কাদেরিয়া তরিকার তালিম দিতেন। তাঁর রচিত হেলালে তরিকত তাসাউফ চর্চার জন্য এক অমূল্য পুস্তক। তিনি মানবতাবাদী বিপ্লবী চেতনার উন্মেষ ঘটান। ১৯২৯ খ্রী: তিনি ইন্তেকাল করেন। তিনি ইন্তেকাল করলে তাঁকে দাফন করা হয় পিতা শাহ আব্দুল করিমের মাজার শরীফের পাশে। শাহ আবু নঈম (রহ) এর ইন্তেকালের দুই বছর পর তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা মাওলানা শাহ্ আবুল খায়ের (রহ.) ভ্রাতার কায়েম মোকাম বা গদিনসিন হন। শাহ মোঃ আবুল খায়ের (রহ) খড়কী দরবারের দায়িত্বভার গ্রহণ করে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শাহ আবু নঈম (রহ.) এর ধারাবাহিকতা অক্ষুণœ রাখেন। খড়কী শরীফে তিন দিনব্যাপী উরসে জনসমাগম এত বিশালত্ব লাভ করেছিল যে, একবার ভিড়ের চাপে পড়ে ৩ জন লোকের মৃত্যু ঘটেছিল। বাধ্য হয়ে এই উরসকে তিনদিনের স্থলে ১৬ চৈত্র একদিন ধার্য করা হয়। যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। প্রতি বছর ১৬ চৈত্র মোতাবেক ৩০ মার্চ এই উরস মোবারক অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। শাহ মোঃ আবুল খায়ের বিপ্লবী কর্মতৎপরতা সমগ্র দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৯৪৯ খ্রী: ২৩ জুন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের নেপথ্যে মাওলানা আবুল খায়েল (রহ.) অবদান ছিল তাঁর প্রথম পুত্র আবদুল হক একজন কিংবদন্তি বিপ্লবী নেতা। তাঁর লিখিত পত্রাবলী সন্ধানী নামে প্রকাশিত হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে গুরুত্ব সহকারে খড়কী পীরের উল্লেখ রয়েছে। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী যশোরে এলে মাওলানা শাহ মোঃ আবুল খায়ের (রহ) মেহমান হতেন। এবং মাওলানা শাহ ্আবদুল করিম এবং মাওলানা শাহ্্ আবূ নঈম (রহ.) এর মাযার শরীফ জিয়ারত করতেন এবং দীর্ঘক্ষণ সেখানে বসে মুবাকাবা করতেন। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে শাহ্্ মোহাম্মদ আবুল খায়ের ইন্তেকাল করেন। তিনি ইন্তেকালের পূর্বে মওলানা শাহ্্ আবদুল মতিনকে কায়েম মকাম বা স্থলাভিষিক্ত করে যান।
মওলানা শাহ মোহাম্মদ আবদুল মতিন যুগশ্রেষ্ঠ সুফী এবং যুগ সংস্কারক পীর ছিলেন। তাঁর পরশে খড়কী পরস্পরের জৌলুস বৃদ্ধি পায়। তিনি খড়কী শরীফে আঞ্জুমানে খালেকিয়া নামে কয়েকতলা বিশিষ্ট অত্যাধুনিক ইয়াতিমখানা প্রতিষ্ঠিত করেন। খড়কী উরস মুবারকের সৌন্দর্যশোভা আরও উচ্চতা লাভ করে। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকাল ৩০ মার্চ তথা ১৬ চৈত্র পাক হানাদার বাহিনীর আক্রমণে এই উরস বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। তারা পীর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছিল শাহ্্ মোহাম্মদ আবদুল মতিন (রহ.) এর তত্ত্বাবধানে বেশ কয়েকখানা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মীনারেনুর নামে বৃহৎ তাসাউফ গ্রন্থ।
২০১১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ সেপ্টেম্বর তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর জানাজার সালাতে কয়েক লাখ লোকের সমাগম হয়েছিল। জানাজার সালাতের ইমামতি করেন তাঁর বড় জামাতা দ্বারিয়াপুর শরীফের পীর অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম। জানাজা শেষে যখন তাঁকে কবরের শায়িত করা হয়, তখন ভীষণ ভূমিকম্প সংঘটিত হয় এবং বৃষ্টি বর্ষিত হয়। তিনি ইন্তেকালের পূর্বে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র শাহ কামরুল হাসান হাসুকে নকশবন্দী তরিকার সবক দিয়ে গদিনসিন করে যান। শাহ কামরুল হাসান হাসুর পরিচালনায় খড়কী উরস মোবারক প্রতি বছর ১৬ চৈত্র তথা ৩০ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এবং এই উরসে ব্যাপকতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এই উরসে মিলাদ ও কিয়াম পরিচালনা করেন শাহ্্ আবদুল মতিন (রহ.) এর বড় নাতি আলহাজ শাহ আবিফ বিল্লাহ মিঠু উরস মোবারকে পবিত্র কুরআনের উপর আলোচনা, মাজার শরীফ জিয়ারত ও মুনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। পীর শাহ্্ কামরুল হাসান হাসু মুনাজাত করেন।
পীর শাহ্্ কামরুল হাসান হাসুর মুনাজাতের এত আবেগ থাকে যে, উপস্থিত সবার মধ্যে এক অপূর্ব কন্দনের জোয়ার সৃষ্টি হয়।
লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ