ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

৫, ৭ ও ১০ শতাংশ হিসাবে আদায় করা হবে

ভ্যাটের হার নির্ধারণে দীর্ঘ জটিলতার অবসান

প্রকাশিত: ১০:৫৮, ২ এপ্রিল ২০১৯

ভ্যাটের হার নির্ধারণে দীর্ঘ জটিলতার অবসান

এম শাহজাহান ॥ দীর্ঘ সাত বছরের জটিলতার অবসান ঘটিয়ে ভ্যাটের হার নির্ধারণের বিষয়ে এনবিআর-ব্যবসায়ীরা মতৈক্যে পৌঁছেছে। পনেরো শতাংশের পরিবর্তে ব্যবসা ও পণ্য ভেদে ৫, ৭ ও ১০ শতাংশ এই তিনটি হারে ভ্যাট আদায় করা হবে। সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে ভোগ্য ও নিত্যপণ্যের ওপর কোন ধরনের ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে না। আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে দেশে ভ্যাট আইন-২০১২ কার্যকর করার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বহু স্তরের ভ্যাট হার নির্ধারণে খুশি ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তারা। এনবিআর আশা করছে, তিনটি হার নির্ধারণ হওয়ায় ভ্যাট আদায়ের আওতা বাড়বে। ফলে রাজস্ব আদায়ে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে বলে মনে করছে সংস্থাটি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। সূত্রমতে, তিনটি হারে ভ্যাট আদায়ের এই ফর্মুলা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এসেছে। এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া জোর দিয়ে বলেছেন, ভ্যাট হারের বিষয়ে এনবিআর ও ব্যবসায়ীরা এবার ঐকমত্যে পৌঁছেছেন। আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হচ্ছে। তিনি বলেন, এবার ভ্যাটের কয়েকটি স্তর করা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে ভ্যাট দাতাদের ভয়ের কিছু নেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট হার থাকলেও রেয়াত সুবিধার আওতায় অতিরিক্ত অর্থ ফেরত দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। তবে কতিপয় আমদানিকারক আছে যারা সব জায়গায় সব সময় ভ্যাট ফাঁকি দিতে চান। এরা নামমাত্র ভ্যাট দিয়ে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম চালান। এ রকম কোম্পানি চাই না। এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, অনলাইনে ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন করুন। এখন থেকে মাসে একবার অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করবেন আর প্রতিদিন লেনদেনের তথ্য প্রদান করবেন। জানা গেছে, এনবিআরের সঙ্গে ভ্যাট সংক্রান্ত একাধিক বৈঠকে ব্যবসায়ীরা ১৫ শতাংশের পরিবর্তে বহু স্তরের ভ্যাটের কথা বলেছেন। বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর অবশেষে তিনটি হার যথাক্রমে ৫, ৭ এবং ১০ শতাংশ হারে ভ্যাট হার নির্ধারণের বিষয়টি ভালভাবে মেনে নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। শুধু তাই নয়, ভ্যাট আইন-২০১২ বাস্তবায়নে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ভাল বোঝাপড়া হয়েছে এনবিআরের। সোমবার রাজধানীর কাকরাইলের ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ভবনে অনলাইনে রিটার্ন দাখিলের সুবিধা উদ্বোধনকালেও এনবিআর চেয়ারম্যান জানান, ভ্যাট হার নির্ধারণের বিষয়ে এনবিআর ও ব্যবসায়ীরা ঐকমত্যে পৌঁছেছেন। আগামী ১ জুলাই থেকে ভ্যাট আইন-২০১২ বাস্তবায়ন হবে। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের যাতে কোন অসুবিধা না হয় সেজন্য নিত্যপণ্যের ওপর কোন ভ্যাট থাকছে না। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীর দিক নির্দেশনা রয়েছে। প্রসঙ্গত, মূল্য সংযোজন কর, সম্পূরক শুল্ক এবং টার্নওভার কর আরোপের ক্ষেত্র বিস্তৃত করতে গত সাত বছর আগে জাতীয় সংসদে মূল্য সংযোজন কর বিল-২০১২ (পরবর্তীতে ভ্যাট আইন-২০১২) সংসদে উত্থাপন করেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ওই সময় তিনি জানান, ১৯৯১ সালের মূল্য সংযোজন কর আইনে নানাবিধ বিচ্যুতি অনুপ্রবেশ করে। যা একটি মানসম্মত মূল্য সংযোজন কর ব্যবস্থা বাস্তবায়নে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে এসব বিচ্যুতি দূর করে দেশে একটি মানসম্মত, ব্যবসা ও রাজস্ববান্ধব মূসক ব্যবস্থা বিনির্মাণ করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সর্বোত্তম রীতিনীতি সম্বলিত মূল্য সংযোজন কর আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন। বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে পাঁচ বছর পর ২০১৭-১৮ অর্থবছরের আইনটি বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন সাবেক অর্থমন্ত্রী মুহিত। কিন্তু ওই সময় ব্যবসায়ীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে আইনটি দু’বছরের জন্য স্থগিত করে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করে বলেন, আইনটির কিছু ধারা সংযোজন-বিয়োজন করে একটি বাস্তবমুখী ভ্যাট আইন করা হবে। ব্যবসায়ীরা যাতে খুশি থাকেন সেইভাবে আইনটি বাস্তবায়ন করবে এনবিআর। জানা গেছে, তিনটি হারে ভ্যাট হার নির্ধারণ হওয়ায় স্বস্তিতে রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তবে দু’একটি ইস্যুতে তাদের কিছু আপত্তি রয়েছে। বাণিজ্যিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে ভ্যাট এক অঙ্কের ঘরে রেখে বহু স্তর করার দাবি জানিয়েছে। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি ওসামা তাসীর সম্প্রতি বাজেট সংক্রান্ত এক অনুষ্ঠানে সিঙ্গেল ডিজিট ভ্যাট বাস্তবায়নের কথা বলেছেন। এছাড়া এনবিআরকে এ বিষয়ে চিঠিও দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, পণ্য ও ব্যবসাভেদে বহু স্তর ভ্যাট একটি আধুনিক ও যুগোপযোগী পদ্ধতি। তবে সর্বক্ষেত্রে সিঙ্গেল ডিজিট ভ্যাট প্রয়োজন। ভ্যাট দেন ক্রেতা, এ কারণে ভ্যাটের বিষয়টি সরাসরি ভোক্তার উপর পড়ে। এ বিষয়টির দিকে খেয়াল রেখে ভ্যাটের হার এক অঙ্কের ঘরে থাকা প্রয়োজন হয়ে পড়ছে। এছাড়া ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইও ভ্যাটের তিনটি হার নির্ধারণের বিষয়টি মেনে নিয়েছে। শীঘ্রই আগামী বাজেটের কর ব্যবস্থাপনা নিয়ে বৈঠক করতে যাচ্ছে এফবিসিসিআই ও এনবিআর। ওই বৈঠকে ভ্যাটের হার নির্ধারণের বিষয়ে এফবিসিসিআই আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে। এছাড়া কোন খাতে ভ্যাট ও ট্যাক্স নির্ধারণ হবে কিংবা কমানো যায় সে বিষয়ে পরামর্শ দেয়া হবে। এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রথম সহসভাপতি মোঃ জসিম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, বহু স্তর ভ্যাট পদ্ধতি একটি আধুনিক পদ্ধতি। তবে ক্রেতাদের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে সব ধরনের ভ্যাটের হার সিঙ্গেল ডিজিট হলে ভাল হয়। তিনি বলেন, ভ্যাট আইন-২০১২ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পরামর্শ ও আলোচনা করে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আশা করছি, নতুন আইনে ব্যবসায়ীরা খুশিই থাকবেন। জানা গেছে, খুচরা পর্যায়ে ভ্যাট ফাঁকি রোধে গত ২০০৮ সালে এসআরও জারির মাধ্যমে ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্টার (ইসিআর) পদ্ধতি চালু করা হয়। ওই সময় ১০ ক্যাটাগরিতে ভ্যাট আদায়ের জন্য ইসিআর ব্যবহার করার নির্দেশ দেয়া হয়ছিল। ব্যবসায়ীরা উৎসাহিত না হওয়ায় দীর্ঘ সময়েও ইসিআর মেশিনের ব্যবহার বাড়ানো যায়নি। ফলে ভ্যাট ফাঁকির প্রবণতা বেড়েছে। এই বাস্তবতায় শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর ফাঁকি রোধে এনবিআরের গোয়েন্দা কার্যক্রম জোরদার করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে জাতীয় বাজেটের পুরো টাকার জোগান দিতে চায় এনবিআর। ইতোমধ্যে এনবিআরের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচী ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, আগামী বাজেট থেকে ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। এ লক্ষ্যে ভ্যাট বিভাগকে অটোমেশন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করবে সরকার। জুলাইয়ে বাস্তবায়ন হতে যাওয়া ভ্যাট আইনে একাধিক স্তর থাকবে, এক্ষেত্রে সিঙ্গেল রেটের পরিবর্তে সহনীয় মাল্টিপল রেট করা হবে। এছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে কোন ভ্যাট দিতে হবে না।
×