ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রোগীদের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে

দেশের চিকিৎসাসেবার অবকাঠামো মজবুত, দুর্বলতা প্রযুক্তিতে

প্রকাশিত: ১১:০০, ২৮ মার্চ ২০১৯

দেশের চিকিৎসাসেবার অবকাঠামো মজবুত, দুর্বলতা প্রযুক্তিতে

নিখিল মানখিন ॥ বিদেশে গিয়ে চিকিৎসাসেবা নেয়ার প্রবণতা বেড়েই চলেছে। বছরে হাজার হাজার রোগী ভাল চিকিৎসা নেয়ার আশায় বিদেশে পাড়ি জমান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের সর্বত্র প্রাথমিক চিকিৎসা সেবার অবকাঠামো বেশ মজবুত। কিন্তু দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রযুক্তিগত দিক এখনও সর্বজনীনভাবে আন্তর্জাতিক মানের হয়ে উঠতে পারেনি। স্বাস্থ্য সেক্টরের অবকাঠামো শক্তিশালী হলেও আন্তর্জাতিক মানের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা নেই বললেই চলে। তথ্য বিভ্রাটের শিকার হয়ে অনেকে বিদেশে যায়। ধনাঢ্য পরিবারের সদস্যরা বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণ করে আত্মতৃপ্তি পেতেই বিদেশে গিয়ে থাকেন। অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কেউ কেউ দেশীয় চিকিৎসা পদ্ধতির ওপর আস্থা রাখতে পারেন না। তাদের অনেকে দেশের প্রথম শ্রেণীর সকল হাসপাতালের খোঁজ-খবর নেন না। আর অনেক ক্ষেত্রে রোগীরা বাধ্য হয়েই বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান। দেশে এখনও কিছু সংখ্যক জটিল রোগের সর্বাধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি নেই। দেশীয় চিকিৎসকদের আচরণগত সমস্যা এবং এজেন্টদের কারণেও বিদেশে পাড়ি জমান অনেক রোগী। বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা চিকিৎসকরা বলেন, দেশেই বিশ্বমানের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত সম্ভব। বহু লোক বিদেশে চলে যাচ্ছে চিকিৎসা নিতে। যারা বড়লোক তারা বিদেশে যাবে, তাতে আপত্তি নাই। কিন্তু সমমানের চিকিৎসা আমাদের দেশের ডাক্তাররা দিতে পারবে না, এটা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। কারণ দেশের ডাক্তাররা যথেষ্ট মেধাবী। তাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। উন্নত ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশের চিকিৎসকদের মেধাবী আখ্যায়িত করে তাদের কাজের সুযোগ করে দেয়া উচিত। বোনম্যারো প্রতিস্থাপন থেকে শুরু করে অনেক জটিল রোগের চিকিৎসা দেশেই দেয়া হচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। বিদেশে চিকিৎসাসেবা নিতে যাওয়ার কারণসমূহ উল্লেখ করতে গিয়ে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আব্দুল্লাহ আল সাফী মজুমদার জনকণ্ঠকে জানান, তথ্য বিভ্রাটের শিকার হয়ে অনেকে বিদেশে যান। ধনাঢ্য পরিবারের সদস্যরা বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণ করে আত্মতৃপ্তি পেতেই বিদেশে গিয়ে থাকেন। অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কেউ কেউ দেশীয় চিকিৎসা পদ্ধতির ওপর আস্থা রাখতে পারেন না। তাদের অনেকে দেশের প্রথম শ্রেণীর সকল হাসপাতালের খোঁজ খবর নেন না। আর অনেক ক্ষেত্রে রোগীরা বাধ্য হয়েই বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান। দেশে এখনও কিছু সংখ্যক জটিল রোগের সর্বাধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি নেই। লিভার সংযোজন ও কার্ডিয়াক হার্ট ট্রান্সপ্লান্টেশনের ব্যবস্থা নেই। এমন অবস্থায় রোগীকে বিদেশে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। বিদেশে যাওয়ার পেছনে দেশীয় চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রযুক্তিগত দুর্বলতাকে দায়ী করলেন ডক্টর ফর হেলথ এ্যান্ড এনভায়রন্টমেন্টের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ রশিদী-ই মাহবুব। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, বাংলাদেশীরা মূলত দুটি কারণে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান। এক শ্রেণীর মানুষ বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণ করে আত্মতৃপ্তি পাওয়ার চেষ্টা করেন। আর দেশে চিকিৎসা গ্রহণের পরেও শারীরিক অবস্থার উন্নতি না ঘটলে ওই রোগী বিদেশে যাওয়ার চিন্তা করে থাকেন। তিনি আরও জানান, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেক্টরের অবকাঠামো অনেক শক্তিশালী। কিন্তু এখনও দেশের সর্বত্র কিছু জটিল রোগের চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা নেই। শুধু তাই নয়, কিছু জটিল রোগের চিকিৎসা পদ্ধতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনও পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়ে গেছে। কয়েক মাসে দেশে শুরু হয়েছে বোনম্যারো প্রতিস্থাপন কার্যক্রম। তাও আবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কেন্দ্রিক। পরীক্ষামূলকভাবে অপারেশন সম্পন্ন হলেও দেশের কোন হাসপাতালেই স্থায়ীভাবে লিভার সংযোজন কার্যক্রম শুরু হয়নি। কিন্তু প্রাথমিক চিকিৎসা নয়, জটিল রোগের চিকিৎসা করানোর জন্যেই মানুষ এক দেশ থেকে আরেক দেশে পাড়ি জমায় বলে অধ্যাপক ডাঃ রশিদী-ই মাহবুব। বিশেষজ্ঞরা আরও জানান, যখনই মানুষ দেশ থেকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাড়ি জমান, তখনই মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই ব্যয়িত অর্থ বৈধভাবে খরচ হলেও দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের একটি বড় অংশ চলে যায়। পাশাপাশি অবৈধভাবে অনেকে খরচ মেটানোর জন্য অর্থ বহন করেন। গবেষণাকালে দেখা গেছে, সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষ চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন দেশে যেয়ে থাকেন। এই সামর্থ্যরে মধ্যে তিনটি উপাদান রয়েছে- আর্থিক সঙ্গতি, লোকবলের সঙ্গতি, যোগাযোগের সঙ্গতি। মূলত আর্থিক সঙ্গতির ওপর নির্ভর করে থাকে মানুষ চিকিৎসার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, রাশিয়া, চীন ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশে যাবে কি না। চিকিৎসার সময়ে রোগীর সঙ্গে এটেন্ডেন্ট নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভিসা প্রসেসিংও অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পাশাপাশি যে হাসপাতালে চিকিৎসা নেবে তাতে সরাসরি যোগাযোগ কিংবা আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব আগে চিকিৎসা নিয়েছেন অথবা এখনও ওই দেশে অবস্থান করছেন- সেটিও মেডিক্যাল ট্যুরিজমের ক্ষেত্রে ওই রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট হাসপাতালকে নির্বাচন করা অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় অর্ধেকেই ভারতে মেডিক্যাল ট্যুরিজমের জন্য গিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চিকিৎসার নামে হাজার হাজার কোটি টাকা পাঠানো হচ্ছে। চিকিৎসা বাবদ দেশ থেকে প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকা বিদেশ চলে যায়। দেশের অগোছালো চিকিৎসা সেক্টরের সুযোগটা লুফে নিচ্ছে তিন শতাধিক এজেন্ট। যার মাধ্যমে প্রতি মাসে ১৩ থেকে ১৫ হাজার রোগী বিদেশে পাঠানো হয়। এর মধ্যে ভারতেই যাচ্ছেন গড়ে প্রতি মাসে ৭ হাজার রোগী। বাকিরা চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া যাচ্ছেন বলে এজেন্ট প্রতিনিধিরা উল্লেখ করেন। এ হিসাবে প্রতি বছরের কমপক্ষে আড়াই লাখ লোক বিদেশে চিকিৎসার জন্য যান বলে এজেন্ট প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। এসব এজেন্ট প্রতিনিধি ভিসা প্রসেস ও সংশ্লিষ্ট দেশের ডাক্তারের সঙ্গে সাক্ষাত করানোর জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকেন। এজন্য তারা প্রত্যেক ব্যক্তি থেকে তিন হাজার টাকা ফি নেন বলে জানিয়েছেন। এ প্রক্রিয়া ছাড়াও সরকারের মন্ত্রী, এমপিসহ প্রশাসনের বড় বড় কর্মকর্তা ও ব্যবসায়িক ব্যক্তিরা অনেক সময়ে বিদেশে ভ্রমণ করার সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে চিকিৎসাসেবা নিয়ে থাকেন। যার প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায় না। তাতেও কোটি কোটি টাকা খরচ হয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
×