ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

টাঙ্গাইলে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর বরাদ্দের নামে ব্যাপক অনিয়ম

প্রকাশিত: ০৯:১৫, ১১ মার্চ ২০১৯

 টাঙ্গাইলে আশ্রয়ণ প্রকল্পের  ঘর বরাদ্দের নামে ব্যাপক অনিয়ম

নিজস্ব সংবাদদাতা, টাঙ্গাইল, ১০ মার্চ ॥ দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল ইউনিয়নে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর বরাদ্দের নামে ব্যাপক অনিয়ম ও ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। ‘আশ্রয়ণের অধিকার, শেখ হাসিনার উপহার’ এ স্লোগান নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ‘সবার জন্য বাসস্থান’ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাস্তবায়িত হচ্ছে আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাজ। প্রকল্পের আওতায় পাথরাইল ইউনিয়নে ২৫টি ঘর ইতোমধ্যে ২০ হাজার টাকা করে বিক্রি করার অভিযোগ উঠেছে চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের বিরুদ্ধে। আর চেয়ারম্যান বলছেন, এসব টাকা দিতে হচ্ছে বিভিন্ন উচ্চ পর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তাদের। পাথরাইল ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের নরুনদা গ্রামে ৫টি ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। প্রতিটি ঘরই নিম্ন মানের কাঠ, টিন, ইট, বালু, সিমেন্ট দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। ঘরের ভিতরের কাঠের পরিবর্তে বাঁশের ধরনা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। ঘরের সঙ্গে একটি করে স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন দেয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হয়নি। উপকারভোগী সোহরাব মিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ঘর বুঝিয়ে দিলেও ঘরের বাইরে প্লাস্টার করা হয়নি। ঘরে ব্যবহার করা হয়েছে নিম্নমানের ইট, বালি, কাঠ, সিমেন্ট। এছাড়া দেয়া হয়নি ল্যাট্রিন। সোহরাব মিয়া বলেন, ঘর বাবদ তিনি স্থানীয় ইউপি সদস্য শফিকুল ইসলামকে ২০ হাজার টাকা দিয়েছেন। নির্মাণ শ্রমিকদের ঠিকমতো মজুরি না দেয়ায় ঘরের কাজও ঠিকমতো করেনি। একই এলাকার আফছন বেগমের ঘরে কাজ শেষ হলেও লাগানো হয়নি জানালা। দায়সারাভাবে কাজ করায় ঘর দিয়ে পানি পড়ে। তিনি একটি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে ঘরের জন্য দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, এনজিও থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে স্থানীয় নারী ইউপি সদস্য রুম্মান পারভীন নাসুর কাছে মাসের পর মাস অপেক্ষার পর ঘর পেয়েছেন। ঘর পেলেও টাকার অভাবে তা সম্পূর্ণ করতে পারছেন না। প্রতিদিন ঘরের মিস্ত্রির জন্য ৩০০ টাকা করে দিতে হয়। বর্তমানে তার কাছে কোন টাকা না থাকায় কাজ বন্ধ রয়েছে। ঘরের নির্মাণসামগ্রী পরিবহন খরচ, বালু, সিমেন্ট ও শ্রমিকদের মজুরি বাবদ আরও প্রায় ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। তার চেয়ে তিনি ৬০ হাজার টাকা খরচ করলে এর চেয়ে উন্নতমানের ঘর দিতে পারতেন বলে দাবি করেন। আফছনের মা লালবানু বেগম জানান, সরকার বিনা টাকায় ঘর দিলেও রক্তচোষারা সেই ঘরের বিনিময়ে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বদনাম সৃষ্টি হচ্ছে। যারা ঘুষ নিয়েছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তিনি। একই গ্রামের গোলাম মিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় একই অবস্থা। তার ঘরে কাঠের ধরনার পরিবর্তে বাঁশের ধরনা লাগানো হয়েছে। দেয়া হয়নি স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন। এছাড়া তিনি দুই বস্তা সিমেন্ট, ৮ বস্তা বালু ও ৪ বস্তা খোয়া কিনে দিয়েছেন ঘর পাকা করার জন্য। গোলাম মিয়া বলেন, আমি ঘর পাইনি। টাকা দিয়ে ঘর কিনে এনেছি। গোলামের স্ত্রী নার্গিস বেগম জানান, তিনি স্বামীকে ঋণ নিয়ে সেই টাকা মেম্বারদের দিয়ে ঘর আনতে হবে না। সে আমার কথা না শুনে এনজিও থেকে ২০ হাজার টাকা তুলে ইউপি সদস্য শফিকুল ইসলাম দিয়ে ঘর এনেছেন। তারপরেও ঘরের নির্মাণসামগ্রী পরিবহনের খরচ, শ্রমিক খরচ ও শ্রমিকদের খাবার বাবদ প্রায় ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। টাকার বিনিময়ে যে ঘর পেলাম, সেই টাকা খরচ করে নিজেরা দিলে তার চেয়ে ভাল ঘর দিতে পারতেন। পাথরাইল ইউনিয়ন পরিষদ সূত্র জানায়, প্রতিটি ঘর নির্মাণের বিপরীতে এক লাখ টাকা করে গৃহনির্মাণ প্রকল্পের বরাদ্দ আসে। সঙ্গে ল্যাট্রিন দেয়ার কথাও রয়েছে। এর মধ্যে পাথরাইল ইউনিয়নে ৩৭৪টি ঘরের চাহিদা দিলেও ২৫টি ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ঘুষ নেয়ার বিষয়ে পাথরাইল ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য রুম্মান পারভীন জানান, প্রতিটি ঘর বাবদ ১৫ হাজার টাকা করে নেয়া হয়েছে চেয়ারম্যান হানিমুজ্জামান লিটনের নির্দেশে। এবং এই টাকা তিনি চেয়ারম্যানের কাছে জমা দিয়েছেন। ঘর কেমন হলো সেটি তার জানার প্রয়োজন নেই। আরেক ইউপি সদস্য শফিকুল ইসলাম জানান, চেয়ারম্যান টাকা নিতে বলেছে, তাই তারা প্রতি ঘরে ১৫ হাজার টাকা করে নেয়া হয়েছে। ঘর নির্মাণে শ্রমিকদের খাবার উপকারভোগীদের দিতেই হয়। প্রতিটি ঘর গুণগতমান মোটামুটি ভালই হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। ইউপি সদস্য ময়না বেগম পেয়েছেন ৫টি, লায়লা আজাদ পেয়েছেন ৫টি ও ভজন কুমার বসাক পেয়েছেন দুটি ঘর। তারা জানান, চেয়ারম্যানের নির্দেশে প্রতিজনের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা করে নেয়া হয়েছে। এতে আমাদের কি করার আছে, আমরা তো সামান্য মেম্বার মাত্র। পাথরাইল ইউপি চেয়ারম্যান হানিফুজ্জামান লিটন জানান, তিনি এ বছর ২৫টি আশ্রয় প্রকল্পের ঘর পেয়েছেন এবং এই ঘরগুলো এক লাখ ২০ হাজার টাকায় কিনে এনেছেন। এই ঘরের বরাদ্দ আনার জন্য যে টাকা খরচ হয়েছিল তার জন্য ঘর বরাদ্দপ্রাপ্তদের কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা করে নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে দেলদুয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাদিরা আক্তার জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া ঘরগুলো বিনা পয়সায় বরাদ্দ দেয়ার কথা। কেউ টাকা নিয়ে থাকলে সেটি অন্যায় করেছে। আর ঘরগুলো নির্মাণ করতে যে টাকা লাগবে সরকারের পক্ষ থেকেই সেই টাকা খরচ করা হবে।
×