নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রথম ভাষণে শেখ হাসিনা জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন। দেশকে এগিয়ে নেয়ার স্বার্থে আহ্বানটি আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের জাতির পিতা, বাংলার মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ মুক্তির কান্ডারি। তার নেতৃত্বে দেশ এখন উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে। বিশ্বে বাংলাদেশের এখন ভিন্ন পরিচয়। বিশ্বমঞ্চে বাঙালী জাতি এখন শির উঁচু করে দাঁড়াতে শিখেছে। আমাদের অর্থনীতি, সংস্কৃতি, বৈশ্বিক রাজনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে প্রাপ্তঅর্জনগুলো প্রমাণ করে শত আঘাতের শত চক্রান্তেও এই ছোট ভূখন্ডের মানুষ যে মাথা নোয়াবার নয়। উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে চলেছি দুর্বার, এখন সময় বাংলাদেশের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার- প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে একেবারেই যথার্থ। সত্যিই বাংলাদেশের এখন ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যাওয়ারই সময়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি এখন আরও সামনের দিকে প্রসারিত। জাতির পিতার সোনার বাংলা আর বেশি দিন স্বপ্ন হয়ে থাকবে না। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দূরদর্শী সাহসী নেতৃত্বে বাংলাদেশ এক নতুন আলোকোজ্জ্বল স্তরে উন্নীত হবে।
মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল বা এমডিজির বেশির ভাগ সূচকে বাংলাদেশের সাফল্য জাতিসংঘ তথা দেশ-বিদেশে প্রশংসিত। দারিদ্র্য বিমোচন, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, নারী-পুরুষ সমতা, নারীর ক্ষমতায়ন, মায়ের স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এরই মধ্যে জাতিসংঘের রোল মডেল। এমডিজির সাফল্যের পর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল বা এসডিজি বাস্তবায়নেও আমরা অনেকটা পথ এগিয়েছি। জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজি বাস্তবায়নের মেয়াদ শেষ হবে ২০৩০ সালে। এর অনেক আগেই বাংলাদেশ এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা পরিপূরণে সক্ষম হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
মাত্র কিছুদিন আগেই স্বল্পোন্নত দেশের আয়সীমা অতিক্রম করে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ। এখন আমাদের লক্ষ্য, ২০২১ সালের মধ্যেই মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় দেশের অবস্থান সুদৃঢ় করা। অত্যন্ত জনবহুল এবং রাজনৈতিক অস্থিরতায় আক্রান্ত একটি দেশ হওয়া সত্ত্বেও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় থাকায় বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্যের চমক দেখিয়েছে। সরকার বর্তমান মেয়াদে সাফল্যের একটি বিশেষ পর্যায়ে পৌঁছে দিতে চান বলেই জাতির ঐক্যবদ্ধ হওয়াকেই এ মুহূর্তে জরুরী বলে মনে করছেন।
ঐক্যবদ্ধভাবে এবার তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে মহারণে অবতীর্ণ হতে চান। এটি একটি সংগ্রাম এবং সকলের সহযোগিতা এখানে বিশেষ প্রয়োজন। পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে যে হারে দেশে দুর্নীতির ডালপালা ছড়িয়েছে, তা থেকে দেশকে আর মুক্ত করা যায়নি। বরং নানা অনুষঙ্গে মিলেমিশে দুর্নীতি এখন মহাজঞ্জালে পরিণত হয়েছে। এই জঞ্জাল দূর করা মোটেই সহজ বিষয় নয়। ইতোপূর্বে প্রধানমন্ত্রী যে জঙ্গীমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন- মাদকমুক্ত সুস্থ সমাজ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন, সে উদ্যোগ চলমান আছে। অনেকাংশে সফলও হয়েছেন। আরও অনেকদূর যেতে হবে- লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে চলবে না। সাম্প্রতিক ভাষণে তিনি নির্বাচনী ইশতিহারের কথাই স্মরণ করিয়ে দিলেন এবং সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একসঙ্গে কাজ করে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করতে হবে এই সংকল্পই ব্যক্ত করলেন তিনি। দুর্নীতিকে শূন্য মাত্রায় নামিয়ে আনা হয়তো সম্ভব নয় তবে তা কমিয়ে সহনীয় মাত্রায় আনাই হবে বর্তমান লক্ষ্য। বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসা শেখ হাসিনার সরকার এ কাজটি সফলভাবে করতে পারবে বলে বিশ্বাস করতে চাই। একটি হিসেবে দেখা গেছে যে, দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে পারলে দেশের জিডিপি আরও দুই শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। অর্থাৎ মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছাতে কোন সমস্যাই থাকবে না। এখন দেখতে হবে এই নতুন বিপ্লবের সাফল্য কত দ্রুত ঘটতে যাচ্ছে। মিয়ানমারে চালানো গণহত্যা থেকে বাঁচতে পালিয়ে আসা প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত আমাদের প্রধানমন্ত্রী। তাই তাকে ‘প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা’ শ্রেণীতে সেরা ১০ চিন্তাবিদের তালিকায় রেখেছে যুক্তরাষ্ট্রের সাময়িকী ‘দ্য ফরেন পলিসি’। এক্ষেত্রে আমাদের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি মন্তব্য খুব করে মনে পড়ছে আমার। তিনি বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ^কে একটি অঘটনের হাত থেকে রক্ষা করেছেন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে।’ টানা তৃতীয়বার সরকার প্রধান হিসেবে সম্প্রতি দায়িত্ব শুরু করেছেন আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর নেতৃত্বে চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় বসার পরই সুখবর পেলেন শেখ হাসিনা। তিনি যে এবারই ‘ফরেন পলিসি’ তালিকায়, তা কিন্তু নয়। ২০১৫ সালের ‘শত চিন্তাবিদের’ তালিকায়ও শেখ হাসিনার নাম ছিল। সেবার জলবায়ু পরবির্তনের বিরূপ প্রভাব নিয়ে সচেতনতা তৈরিতে ভূমিকার জন্য তালিকায় ‘ডিসিশন মেকার্স’ ক্যাটাগরিতে বিশ্বের শীর্ষ ১৩ জনের মধ্যে রাখা হয়েছিল নেত্রীকে।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী ফোর্বসের করা বিশ্বের ক্ষমতাধর ১০০ নারীর তালিকায় ছিলেন শেখ হাসিনা। ২০১৭ সালে নবেম্বরে করা ওই তালিকায় ৩০তম অবস্থানে ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনাকে ‘লেডি অব ঢাকা’ আখ্যায়িত করে ফোর্বস-এ বলা হয়েছিল, শেখ হাসিনা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সহায়তার অঙ্গীকার করেছেন এবং তাদের জন্য ২০০০ একর জমি বরাদ্দ দিয়েছেন, যা মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর আং সান সু চির অবস্থানের পরিষ্কার বিপরীত। ২০১৪ সালে এশিয়ার প্রভাবশালী শীর্ষ ১০০ জনের তালিকায় ২২তম অবস্থানে ছিলেন বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা আজ অভিজ্ঞতায় অনেক সমৃদ্ধ। অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি অনেক শক্তিশালী। বুদ্ধিমত্তা আগের মতোই প্রখর, সহনশীলতা ও দৃঢ়তা, ধৈর্য, যেন তার চরিত্রগত ধর্ম। ভালবাসায় ও সহমর্মিতায় তিনি এখনও বন্ধুদের কাছে প্রিয় এবং সকলের অতি আপনজন। শেখ হাসিনা আজ দেশ ও জনদরদি নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। পিতার মতোই অসীম সাহসী, দৃঢ়তায় অবিচল, দেশপ্রেম ও মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন একজন আদর্শবাদী নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা মানুষের কাছে আজ সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় নেতা। দেশের যে কোন সংকটে তার নেতৃত্ব দলমত নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কাছে তিনিই একমাত্র গ্রহণযোগ্য। সেখানে দ্বিতীয় কোন বিকল্প নেই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে শেখ হাসিনা তার সততা, আত্মত্যাগ, দূরদর্শিতা ও দেশপ্রেমের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন- এটাই হচ্ছে তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে আজ এ কথা বলা যায়- এ যাবতকালে বাংলাদেশে যত সরকার এসেছে তিনি তাদের মধ্যে সবচেয়ে সফল রাষ্ট্রনায়ক, বিশ্বে প্রভাবশালী নারী প্রধানমন্ত্রী, অনুকরণীয় অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। শুধু দেশেই নয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তাঁর কাজের স্বীকৃতি মিলেছে। বাংলাদেশের সফলতা ও নেতৃত্বগুণের জন্য তিনি বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন ও নানাবিধ সম্মানে ভূষিত হয়ে বাংলাদেশের নাম বিশ্বব্যাপী উজ্জ্বল করেছেন।
বিশ্বের প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ এখন শেখ হাসিনাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে। বিশ্ব গণমাধ্যমে শেখ হাসিনা এখন বহুল আলোচিত ও প্রশংসিত নেতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পর শেখ হাসিনা ছাড়া এমন গুণাবলীসম্পন্ন আর কোন নেতা বাংলাদেশের মানুষ পায়নি। এ কারণে তার সঙ্গে অন্য কোন নেতার তুলনা চলে না, শেখ হাসিনা নিজেই নিজের তুলনা। আমাদের সৌভাগ্য আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা মানবতার নেত্রী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পেয়েছি। তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে এদেশের মানুষকে বঙ্গবন্ধুর মতোই ভালবেসে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে এসেছেন। তিনি পরিবার হারিয়ে বাংলার মানুষকে পরিবার হিসেবে নিয়েছেন। জীবন বাজি রেখে রাজনীতিতে আসা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকেও দেশের মানুষও ভালবেসে বুকে জড়িয়ে নিয়েছেন। বলেছেন ‘এদেশের মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়ে যদি আমার মৃত্যুও হয় তবুও আমি পিছপা হবো না।’
তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। স্থায়ী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, খাদ্যে স্বনির্ভরতা, নারীর ক্ষমতায়ন, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গ্রামীণ অবকাঠামো, যোগাযোগ, জ্বালানি ও বিদ্যুত, বাণিজ্য, আইসিটি এবং এসএমই খাতে এসেছে ব্যাপক সাফল্য। এছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জঙ্গীবাদ প্রতিরোধ, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের বিচার, পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি সম্পাদন, একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতিসহ জাতীয় জীবনের বহুক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছেন তিনি। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে নাড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বকে। আজ সারা বিশ্বেই তাঁর নাম আলোচিত হচ্ছে ‘বিশ্ব মানবতার বিবেক’ হিসেবে।
নতুন শতাব্দীতে বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানো মূলত সেখান থেকেই, যা গত কয়েক বছর ধরেই অব্যাহত রয়েছে। যদিও দশ বছর খুব বেশি সময় নয়; অথচ এ সময়েই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, কৃষি, বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তিসহ সব সূচকে যেভাবে তিনি অগ্রগতি, সাফল্য আর উন্নয়নের ধারা সৃষ্টি করেছেন; তাতে সহজেই অনুমেয়-আগামীর বাংলাদেশ ২০৪১ সালের আগেই তাঁর নেতৃত্বে উন্নত দেশের সারিতে কাঁধ মেলাতে সক্ষম হবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও রাজনীতি বিশ্লেষক
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: