ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নার্গিছ আকতার ॥ এক অদম্য নারীর এগিয়ে যাওয়া

প্রকাশিত: ১২:৩৭, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

নার্গিছ আকতার ॥ এক অদম্য নারীর এগিয়ে যাওয়া

রক্ষণশীল, গতানুগতিক শ্রেণী বিভক্ত সমাজে মানুষে মানুষে ব্যবধান যেমন প্রকট একই গতিতে নারী-পুরুষের বৈষম্য ও দৃষ্টিকটুভাবে দর্শনীয়। বিভাগীয় এবং রাজধানী শহর ঢাকা এবং বন্দর নগরী চট্টগ্রাম কিন্তু এক সময় অভিন্ন ছিল না এখনও সেভাবে নেই। ’৪৭-এর দেশ বিভাগ আমাদের বাংলাদেশের ভাগ্যোন্নয়নে তেমন কোন প্রভাব রাখতে পারেনি এমন ঐতিহাসিক তথ্যের তেমন কোন ঘাটতি এখন অবধি হয়নি। ধীরগতিতে হলেও ব্যক্তি মানুষের সচেতনতা এবং জাগরণে সমাজ এগিয়েছে। ব্যক্তিগত সাফল্যও এসেছে। সেখানে নারীরাও কোনভাবেই পিছিয়ে থাকেনি। সংখ্যায় কম হলেও তারা শিক্ষাঙ্গনে প্রবেশ করেছে, পেশার ক্ষেত্রে সম্পৃক্ত হয়েছে, কৃতী সন্তানের মা হিসেবে নিজের অবস্থান মজবুত করতেও সময় লাগেনি। মিসেস নার্গিছ আকতার ষাটের দশকে তার শিক্ষা কার্যক্রমের সুবর্ণ সময় পার করে স্বাধীনতা পরবর্তী সত্তরের দশকের মাঝামাঝিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। চট্টগ্রামের নারী শিক্ষার ইতিহাস বাংলাদেশের অন্যান্য বিভাগীয় শহরের মতোই আকর্ষণীয় এবং প্রচলিত ছিল যদিও সংখ্যায় তা হাতেগোনার মতো। নার্গিছ আকতার চট্টগ্রামের বিখ্যাত স্কুল অপর্ণা চরণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং সিটি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক করে এক সময় স্নাতক ডিগ্রীও লাভ করেন। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করে কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। নার্গিছ আখতার অতি বাল্যকাল থেকে সম্ভান্ত পরিবারে জন্ম নেয়া এক স্বাধীনচেতা বালিকা। দৃঢ়তার সঙ্গে নিজের আশা-আকাক্সক্ষা, সিদ্ধান্তকে অনমনীয় অভিব্যক্তিতে ধারণ করা অসামান্য নারী ব্যক্তিত্ব। পারিবারিক শুদ্ধ আবহ তার চলার পথে যেভাবে আলো বিকিরণ করে সেটাই জীবন গড়ার এক অন্যতম নিয়ামক শক্তি। পিতা মোহাম্মদ ইসমাইল ছিলেন ১৯৩৫ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে স্নাতক করা স্বল্প সংখ্যক বাঙালী মুসলমানদের একজন। মা লায়লাও ছিলেন আইনবিদ পিতার যোগ্য কন্যা সন্তান। তৎকালীন সময়ে তিনি দশম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন বলে জানা যায়। এ কথা সুবিদিত যে মাতামহ মোঃ ইদ্রিসও ছিলেন একজন সুশিক্ষিত মুসলিম আইনবিদ। সুতরাং এক শিক্ষিত পারিবারিক পরিম-লে নার্গিছ আকতারের শৈশব-কৈশোর অতিক্রমের সুবর্ণ সময়ে মাতৃহারা হওয়ার মতো দুর্যোগও উপস্থিত হয়। ছোট ভাই সাদেককে জন্ম দিতে গিয়ে প্রসবকালীন সময়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণই মায়ের মৃত্যুর অন্যতম কারণ। নার্গিছ তখন আড়াই বছরের শিশু। বড় ভাই মোহাম্মদ ইউসুফের বয়স ১২ বছর। মেজ ভাই মোঃ ইসহাক শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী। আর সদ্য মাতৃহারা সাদেককে নিয়ে যান তাদের ঘনিষ্ঠতম এক খালা। বাবার দ্বিতীয় বার বিয়ে করা ছাড়া কোন পথ ছিল না। সংসারে আগমন হয় অন্য এক নতুন মায়ের। তবে নার্গিছ এবং তাদের ভাইয়েরা তাকে পূর্ণ মায়ের মর্যাদা দিয়ে ঘিরে রাখে। বড় ভাই মোঃ ইউসুফ নিজের ক্ষমতা, দক্ষতা ও যোগ্যতায় বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে তৈরি করেছিলেন। জাতীয় দৈনিক আজাদ, সংবাদ, জনপদসহ আরও অনেক পত্রিকায় নিজের কর্মক্ষমতা বিকশিত করে যশস্বী সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর প্রিয় মানুষ সহকর্মী, বন্ধু এবং নিকটাত্মীয়ের কাছাকাছি চলে আসেন। পিতা, মাতামহ ছাড়াও বড় ভাই মোঃ ইউসুফ ও তার সমৃদ্ধ জীবন তৈরিতে নিয়ামকের ভূমিকা রাখেন বলে এখনও তিনি মনে করেন। নার্গিছের এখনও স্মরণে আছে সেই ১৯৬২-৬৩ সাল থেকে মহিলাদের জন্য সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পত্রিকার নিয়মিত পাঠক হওয়ার সুখস্মৃতি। যা তার সাংস্কৃতিক চেতনা আর পাঠ্যাভ্যাস তৈরিতে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখে। শুধু তাই নয় একটু তেজি, জেদি আর প্রত্যয়ী বোনটির জন্য বড় ভাইয়ের মমতা ছিল অন্যরকম। শুধু ‘বেগম’ পত্রিকার গ্রাহক করে দেয়া নয় সঙ্গে মাসিক কিছু হাত খরচও যোগাতেন ইউসুফ সাহেব তার সীমিত আয় থেকে। স্নাতক ডিগ্রী লাভ করার পর বাবা চাননি আর পড়াতে। বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু এক রোখা ও নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকা এই সফল নারী কারও কথা শোনার মতো ছিলেন না। নিজের ব্যাপারে তার মতই ছিল সবার ওপরে। আর সেই বিশ্বাস আর আস্থায় জীবনভর নিজেকে শুধু এগিয়েই নিয়েছেন। বিয়ে হয় একজন মুক্তিযোদ্ধা আর সফল আইএমএস অফিসারের সঙ্গে। স্বামীও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নেয়া। এই কৃতী সরকারী অফিসার তার আমলাতান্ত্রিক জীবনের ব্যস্ততম সময়ে দেশ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতাকে সবার আগে ভাবতেন। সেভাবে ইউএনও, এডিসি, ডিসি এবং সর্বশেষ যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হিসেবে অবসরে যান। নার্গিছ নিজেও একজন সফল শিক্ষক ও সমাজ কর্মী। নারীবাদী হিসেবে অতখানি দাপট না থাকলেও মানুষ হিসেবে নিজের সমস্ত অধিকার ও স্বাধীনতাকে অর্জন করতে বিন্দুমাত্র ছাড় দেননি। মতের অমিল হলে ভাই কিংবা স্বামীই শুধু নন বর্তমানে পুত্রদের সঙ্গেও আপোস করতে দেখা যায়নি কখনও। উল্লেখ্য, তিনি একজন সফল মাও। বড় ছেলে রনি কানাডা থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করে ব্যবসায়ী হিসেবে নিজের কর্মক্ষেত্রকে সম্প্রসারিত করছে। দুই যমজ সন্তানের একজন ফার্মাসিস্ট ও অন্যজন ডাক্তার। তিনি পুত্র সন্তান ও স্ব-স্ব জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। কলেজ থেকে অবসরে যাওয়া নার্গিছ আজও ব্যস্তমত সময় পার করছেন। কারও বিয়ে ঠিক করে দেয়া, কোন মেধাবী সন্তানের লেখাপড়ায় সাহায্য করা, অন্য কোন সঙ্কট থেকে বিপন্নদের উদ্ধার করা, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনে নিজেকে সম্পৃক্ত করা সব ব্যাপারে তার কাছ থেকে আগ্রহীরা সহায্য, সহযোগিতা পায়। সেই উদীয়মান কিশোরী থেকে ষাটোর্ধ প্রোঢ়ত্ব তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। এখনও সাবলীলভাবে মানুষের জন্য বিশেষ করে অসহায় ও বঞ্চিতদের পাশে থেকে তাদের কারণে কিছু করার তাগিদ তার অনুভবে জিইয়ে রেখেছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেখান থেকে তিনি মুক্তিও চান না। নিজের তিন ছেলের জন্য এখন তাকে তেমন কিছু করতে হয় না। তারা নিজেরাই স্বাবলম্বী। তিন ছেলের মা নার্গিছকে দেখে মনে হয় একটি কন্যা সন্তানের আকাক্সক্ষা ভেতরে প্রচ্ছন্ন ছিল। তার ছেলের বউরা যেমন প্রত্যাশিত ইচ্ছায় তাকে নাড়া দিতে পারে। এই সামান্য তৃপ্তিটুকু যেন তার জীবন ও মনকে কানায় কানায় পূর্ণ করে দেয়। ‘মানুষ মানুষের জন্য’ এই স্মরণীয় বার্তায় তার ফেলে আসা জীবন চালিত হয়েছে, সমৃদ্ধতায় ভরেও উঠেছে, নিজের সুখ-শান্তিও সেভাবেই যাত্রাপথকে অবারিত করেছে। বাকি জীবনটাও যেন তিনি সেভাবেই কাটাতে পারেন। শুধু তাই নয় ক্রান্তিকালীন সময়টাও যেন উদ্দীপ্ত চেতনায় এগিয়ে নিতে পারেন এই দোয়া আর আন্তরিক অভিনন্দন এই সফল নারীকে।
×