ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী ॥ অতিথি থাকছেন শঙ্খ ঘোষ

ভাষা চেতনায় উদ্ভাসিত অমর একুশে গ্রন্থমেলা আজ শুরু

প্রকাশিত: ১০:৫৭, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

ভাষা চেতনায় উদ্ভাসিত অমর একুশে গ্রন্থমেলা আজ শুরু

মোরসালিন মিজান ॥ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি...। সেই ভাই হারানোর ব্যথা নতুন করে বুকে বাজছে। আছে মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষার গৌরবও। দু’টোকে একসঙ্গে ধারণ করে শুরু হচ্ছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। প্রতিবারের মতোই বাঙালী জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতীক বাংলা একাডেমি এ মেলার আয়োজন করছে। একাডেমি প্রাঙ্গণে আজ শুক্রবার মাসব্যাপী মেলার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই মঞ্চে অতিথি হয়ে থাকবেন পশ্চিমবঙ্গের কবি জীবন্ত কিংবদন্তি শঙ্খ ঘোষ। বইমেলা একই সঙ্গে প্রাণের মেলা হিসেবে স্বীকৃত। লেখক, পাঠক, প্রকাশকের এই মিলনমেলা সারা বিশ্বেই বিরল। দেশের সৃজনশীল সকল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এ মেলায় অংশ নিয়ে থাকে। বইকেন্দ্রিক হলেও, কালক্রমে আয়োজনটি বঙ্গ সংস্কৃতির মহোৎসবে পরিণত হয়েছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, অনন্য সাধারণ এই মেলার সূচনা হয়েছিল প্রকাশক চিত্তরঞ্জন সাহার হাত ধরে। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বর্ধমান হাউসের বটতলায় চট পেতে বই বিক্রি করতে বসেছিলেন এই প্রকাশক। মাত্র ৩২টি বই। বাংলাদেশী শরণার্থী লেখকদের লেখা এসব বই প্রকাশ করেছিল চিত্তরঞ্জন প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমান মুক্তধারা প্রকাশনী)। বইগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রথম অবদান। নিজের প্রকাশ করা বই বিক্রির এই চেষ্টা অনেক বছর ধরে অব্যাহত রাখেন চিত্তরঞ্জন। যতদূর জানা যায়, ১৯৭৬ সালে আরও কয়েকটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান একই জায়গায় বই বিক্রি শুরু করে। ১৯৭৮ সালে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলা একাডেমি। ১৯৭৯ সাল থেকে বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি মেলা আয়োজনে নিজেদের সম্পৃক্ত করে। কোন কোন সূত্র মতে, ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক থাকাকালে কাজী মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমিতে প্রথম অমর একুশে গ্রন্থমেলা আয়োজন করেন। বহু বছর এখানে মেলা আয়োজন করা হয়। বর্তমানে মেলা সম্প্রসারিত হয়েছে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত। বিগত দিনের ধারাবাহিকতায় আজ শুরু হচ্ছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৯। উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা ॥ আজ বিকেল ৩ টায় শুরু হবে উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা। একাডেমি প্রাঙ্গণে স্থাপিত মূল মঞ্চে দৃষ্টি থাকবে সবার। মঞ্চকে আলোকিত করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। থাকবেন বহু কালজয়ী কবিতার জনক খ্যাতিমান কবি শঙ্খ ঘোষ। পশ্চিমবঙ্গের এই কবি প্রথমবারের মতো মেলার উদ্বোধনী মঞ্চে থাকবেন বলে নিশ্চিত করেছে একাডেমি। একই সঙ্গে মঞ্চে থাকবেন মিসরের লেখক, গবেষক ও সাংবাদিক মোহসেন আল-আরিশি। প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও আমন্ত্রিত বিদেশী কবি ও লেখকরা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখবেন। একই দিন উদ্বোধনী মঞ্চে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০১৮ প্রদান করা হবে। ‘সিক্রেট ডক্যুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ গ্রন্থ সিরিজের দ্বিতীয় খ- প্রকাশিত হয়েছে। সদ্য প্রকাশিত ভলিউমের মোড়ক উন্মোচন করা হবে মঞ্চে। বইটিতে থাকবে ১৯৫১ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত দেয়া গোয়েন্দা রিপোর্ট ও নথিপত্র। এসবের ভিত্তিতে শেখ মুজিবুর রহমানকে তুলে ধরার প্রয়াস নেয়া হয়েছে। এছাড়াও বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেছে আরবী ভাষায় লেখা বইয়ের অনুবাদ ‘শেখ হাসিনা : যে রূপকথা শুধু রূপকথা নয়।’মোহসেন আল-আরিশি রচিত বইয়ের এই বাংলা অনুবাদ তুলে দেয়া হবে প্রধানমন্ত্রীর হাতে। পরে মেলা ঘুরে দেখবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মেলার সময়সূচী ॥ গ্রন্থমেলা ছুটির দিন ব্যতীত প্রতিদিন বিকেল ৩টায় শুরু হবে। চলবে রাত ৯ টা পর্যন্ত। ছুটির দিন সময় বাড়বে। বেলা ১১টায় খুলে দেয়া হবে দ্বার। বন্ধ হবে রাত ৯টায়। একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসে সকাল ৮টা থেকে শুরু হয়ে মেলা চলবে রাত সাড়ে ৮ টা পর্যন্ত। দুই ভেন্যু বর্ধিত পরিসর ॥ অমর একুশে গ্রন্থমেলার দুটি ভেন্যু। একটি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ। অন্যটি ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। দুই অংশ মিলিয়ে প্রায় ৩ লাখ বর্গফুট জায়গায় মেলা আয়োজন করা হচ্ছে। একাডেমি প্রাঙ্গণে স্থান পেয়েছে ১০৪ টি সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান। আছে তারুণ্যের প্ল্যাটফর্ম লিটল ম্যাগাজিন চত্বর। বয়ড়াতলায় ১৮০টি লিটলম্যাগকে ১৫৫টি স্টল দেয়া হয়েছে। ২৫ স্টলে ২টি করে লিটলম্যাগাজিন প্রদর্শন করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আর মূল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো থাকছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে। ৪ চত্বরে বিন্যস্ত করা উদ্যানে ৩৯৫টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান স্টল ও প্যাভিলিয়ন সাজিয়েছে। বাংলা একাডেমিসহ ২৪ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে ২৪টি প্যাভিলিয়ন। সব মিলিয়ে মেলায় অংশ নিচ্ছে ৪৯৯টি প্রতিষ্ঠান। বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৭৭০টি ইউনিট। একক ও ক্ষুদ্র প্রকাশনা সংস্থার বই পাওয়া যাবে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের স্টলে। গ্রন্থমেলায় আগতরা শতকরা ২৫ ভাগ ছাড়ে বই কিনতে পারবেন। এছাড়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে থাকছে শিশুচত্বর। বন্ধের দিনগুলোতে রাখা হবে বিশেষ শিশুপ্রহরও। বাংলা একাডেমির প্রকাশনা ॥ এবারের গ্রন্থমেলায় বাংলা একাডেমির স্টলে পাওয়া যাবে নতুন ও পুনর্মুদ্রিত বেশ কিছু বই। নতুন ও অপেক্ষাকৃত নতুন বইয়ের সংখ্যা হবে ১০২টি। লেখক বলছি ॥ মেলার নির্বাচিত বই নিয়ে থাকছে নতুন আয়োজন ‘লেখক বলছি।’ এই মঞ্চে প্রতিদিন ৫ লেখক তাদের বই নিয়ে পাঠকের মুখোমুখি হবেন। প্রত্যেক লেখক নিজের বই সম্পর্কে ২০ মিনিট বলার সুযোগ পাবেন। কিশোর লেখকদের উৎসাহিত করতেও থাকবে বিশেষ উদ্যোগ। সেমিনার কবিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ॥ আগামীকাল শনিবার থেকে প্রতিদিন বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে সেমিনার। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি-সমকালীন প্রসঙ্গ নিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হবে। চলবে আলোচনা। একই সঙ্গে বিশিষ্ট বাঙালী মনীষাদের জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। নতুন যোগ হয়েছে কবিতা। প্রতিদিনই থাকবে কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ এবং আবৃত্তি। শিশু-কিশোরদের জন্য থাকবে নানা আয়োজন। চিত্রাঙ্কন, সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বক্তৃতা এবং সঙ্গীত প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হবে। স্টল সজ্জায় পুরস্কার ॥ অমর একুশে গ্রন্থমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ২০১৮ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণগতমান বিচারে সেরা গ্রন্থের জন্য প্রকাশককে ‘চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার’ প্রদান করা হবে। একই বছর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্য থেকে শৈল্পিক বিচারে সেরা গ্রন্থ প্রকাশের জন্য ৩টি প্রতিষ্ঠানকে ‘মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ প্রদান করা হবে। শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণগত মান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থের জন্য ১টি প্রতিষ্ঠানকে ‘রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার’ দেয়া হবে। এবারের মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে স্টলের নান্দনিক সাজসজ্জায় শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হবে ‘কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’। সংবাদ সম্মেলন ॥ মেলার সর্বশেষ প্রস্তুতি সম্পর্কে জানাতে বৃহস্পতিবার বাংলা একাডেমি বিশেষ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। এতে মূল বক্তব্য রাখেন একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী। তিনি বলেন, আমরা বাহান্নর চেতনা নিয়ে একাত্তরে যুক্ত হয়েছিলাম। একটি দেশ পেয়েছিলাম। অমর একুশে গ্রন্থমেলার মধ্য দিয়ে সেই দেশ, সেই সংগ্রামের ইতিহাস আমরা তুলে ধরতে চাই। পরবর্তী প্রজন্মকে সংকোচহীনভাবে বলতে চাইÑ আমরা বাঙালী। শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের জাতির পিতা। সকলের সহায়তায় একটি সফল-সুন্দর মেলা উপহার দেয়ার আশা ব্যক্ত করেন একাডেমির নতুন এই মহাপরিচালক। সংবাদ সম্মেলনে গ্রন্থমেলার সার্বিক প্রস্তুতি সম্পর্কে অবহিত করেন গ্রন্থমেলার সদস্যসচিব ড. জালাল আহমেদ। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বাংলা একাডেমির সচিব মোঃ আব্দুল মান্নান ইলিয়াস। গ্রন্থমেলার নতুন লোগো উপস্থাপন করেন স্থপতি এনামুল করিম নির্ঝর।
×