ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ খোলাফায়ে রাশেদীনের নির্বাচন

প্রকাশিত: ০৯:৩৪, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ খোলাফায়ে রাশেদীনের নির্বাচন

আল্লাহ্ তায়ালা হযরত আদম আলায়হিস সালামকে সৃষ্টিকালে ফেরেশতাদের ডেকে বলেন, আমি পৃথিবীতে আমার খলিফা পাঠাচ্ছি। ফেরেশতারা তাঁদের অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন : হে আল্লাহ্্! আপনি কি এমন কিছু নিযুক্ত করতে যাচ্ছেন যারা সেখানে মারামারি খুনোখুনি করবে, আমরাই তো আপনার তসবিহ্্ পাঠ করি এবং আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করি। আল্লাহ বললেন : আমি যা জানি তোমরা তা জানো না। অতঃপর আদমকে সৃষ্টি করে তাঁকে সকল কিছুর নাম শিক্ষা দিলেন। তারপর যাবতীয় কিছু হাজির করে ফেরেশতাদের নাম বলে দিতে বললেন। ফেরেশতাগণ তাদের অপারগতা ব্যক্ত করলে আল্লাহ্ তায়ালা আদমকে ওসবের নাম বলতে বললে হযরত আদম (আ) একে একে সব কিছুর নাম বলে দিলে আল্লাহ্্ ফেরেশতাগণকে আদমকে সম্মানসূচক সিজ্্দা করতে বললে ফেরেশতাগণ আদমকে সিজ্্দা করলেন, কিন্তু ইবলিশ অহঙ্কার বশে সিজ্দা করল না, ফলে সে অভিশপ্ত হয়ে গেল। জান্নাত থেকে আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে আদম পৃথিবীতে আসেন। সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। প্রায় ১০ হাজার বছর পর শেষ নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ইসলামের পূর্ণাঙ্গ রূপদান করে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার চলে গেলেন। তাঁর খলিফা কে হবেন এ নিয়ে নানা প্রস্তাব উত্থাপিত হতে লাগল। অতঃপর হযরত ওমর (রা)-এর শক্ত যুক্তির কাছে সবাই ঐকমত্য প্রকাশ করল। অতঃপর একে একে সবাই হযরত আবু বকর (রা) কাছে এসে আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করল। হযরত আবু বকর (রা) ইসলামের প্রথম খলিফা নির্বাচিত হয়ে তিনি সকলের উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে বললেন : আপনারা আমাকে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা)-এর খলিফা নির্বাচিত করেছেন। যদিও আমি এর জন্য নিজেকে উপযুক্ত মনে করি না। আমি আপনাদের পরামর্শে আমার দায়িত্ব পালন করতে সচেষ্ট হব। আমি যদি কোন ভুল করি তা আপনারা শুধরিয়ে দেবেন। আল্লাহ ও তার রাসূলের বিধান অনুযায়ী আামি মদিনা রাষ্ট্র পরিচালনা করব ইনশাআল্লাহ্। হযরত আবু বকর (রা) আড়াই বছরের খেলাফাতকালের সবচেয়ে বড় ঘটনা হচ্ছে ভ- নবীদের কঠোরহস্তে দমন। তার আমলে মদিনা রাষ্ট্রের বিস্তার ঘটে। ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দের ২৩ আগস্ট ৬১ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। ইন্তেকালের পূর্বে তিনি মদিনার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে পরামর্শ করে হযরত ওমর (রা)কে পরবর্তী খলিফা হিসেবে মনোনয়ন দান করে যান। হযরত ওমর (রা) খলিফাতুন মুসলিমীন ও আমীরুল মুমিনীন হিসেবে দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। তার আমলে তিনি মজলিশূর শূরা বা পরামর্শ সভার কায়েম হয়। তিনি দীওয়ান ব্যবস্থার মাধ্যমে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সম বণ্টন নিশ্চিত করেন। তার আমলে মদিনা রাষ্ট্রের বিস্তার ঘটে সুদূর কাশগড় পর্যন্ত। তিনি রাষ্ট্রকে ৩৪টি প্রদেশে বিভক্ত করেন। অর্ধ জাহানের খলিফা হিসেবে তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তিনি যে নজির স্থাপন করেছিলেন তা আজও অনুকরণীয়, হযরত ওমর (রা) খেলাফতকালে বাংলাদেশে ইসলামের প্রচার কার্যে ব্যাপকতা লাভ করে। তিনি হিজরী সনের প্রবর্তন করেন এবং কাবা শরীফের সম্প্রসারণ ঘটান। ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে আবু লুলু নামে এক খ্রীস্টান ক্রীতদাসের, অস্ত্রের আঘাতে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। শেষ নিশ্বাস ত্যাগের পূর্বে তিনি ছয় সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটির হাতে তাঁর পরবর্তী খলিফা মনোনীত করার দায়িত্বভার দিয়ে যান। এই কমিটিতে ছিলেন হযরত ওসমান (রা) হযরত আলী (রা) হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা) সাদ বিন আবি ওয়াজ্জাসা (রা) তালহা (রা), জুবায়ের (রা)। তিনি তার পুত্র আবদুল্লাহ ইবনে ওমরকে সমন্বয়কারী হিসেবে নিযুক্ত করেন। তিনি ৬১ বছর বয়সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি যে কমিটি গঠন করে যান, এই কমিটি বৈঠকের পর বৈঠক করে হযরত ওসমান (রা)কে খলিফা হিসেবে মনোনীত করেন। তার ১২ বছর স্থায়ী খেলাফতকালে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় রয়েছে। তাঁকে উৎখাত করার জন্য ব্যাপক ষড়যন্ত্র পরিচালিত হয় এবং খারেজী সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে হজের মৌসুমে খারেজীদের একটি কুচক্রী দল সন্তর্পণে মদিনায় প্রবেশ করে। ১৭ জুন গভীর রাতে তারা হযরত ওসমান (রা) দ্বিতল বাসভবনে দেয়াল টপকিয়ে উপরে উঠে যায়। এই আক্রমণকে প্রতিহত করার জন্য হযরত ইমাম হাসান (রা) ইমাম হোসাইন (রা) হযরত তালহা (রা) হযরত জুবায়ের (রা) প্রাণপণ চেষ্টা করেন। অনুপ্রবেশকারীরা হযরত ওসমান (রা) শয়ন কক্ষে ঢুকে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এই সময় তিনি কোরান শরীফ তেলাওয়াত করছিলেন। তার স্ত্রী হযরত নায়লা পাশে বসা ছিলেন। তিনি হাত দিয়ে ঠেকানোর চেষ্টা করেন। এতে তার একটি আঙ্গুল কেটে যায়। ৮২ বছর বয়সে হযরত ওসমান (রা) শহীদ হন। মদিনা মনোয়ারায় বহিরাগত খারেজী সদস্যদের তা-বলীলা চলে। মদিনার বিশিষ্ট সাহাবীগণ হযরত আলী (রা)কে অনুরোধ করেন এই করুণ অবস্থা থেকে জাতিকে রক্ষার জন্য খেলাফতের দায়িত্বভার নিতে, হযরত আলী বাধ্য হয়ে জনগণের অনুরোধে খেলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের ফলে মদিনা নগরী অরাজকতা থেকে রক্ষা পায়। তিনি মদিনা থেকে ইরাক সীমান্তে কুফা নামক স্থানে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। ৬৬১ খ্রি, ২৪ জানুয়ারি কুফার মসজিদে ফজরের সালাত আদায়কালে আবদুর রহমান ইবনে সুলজ্জম নামক এক খারেজী আঁততায়ীর বিষাক্ত ছুরিকাঘাতে তিনি ঢলে পড়েন এবং তিন দিন পরে তিনি শাহাদাত লাভ করেন। তাঁর শাহাদাতের মধ্যে দিয়ে খোলাফায়ে রাশেদীনের ৩১ বছরের গৌরবোজ্জ্বল খেলাফতের অবসান ঘটে। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়ারপুর শরীফ
×