ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিদ্যুত খাত সম্প্রসারণ করেছে দ্রুত

জ্বালানির উন্নয়নে আরও মনোযোগ দেয়ার আহ্বান

প্রকাশিত: ০৬:২০, ৬ জানুয়ারি ২০১৯

জ্বালানির উন্নয়নে আরও মনোযোগ দেয়ার আহ্বান

রশিদ মামুন ॥ নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণে বিদ্যুতে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলেও জ্বালানিতে সফল বলা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৪ সালে নির্বাচনী ইশতেহারের সঙ্গে গত পাঁচ বছরের কর্মকাণ্ড এবং বর্তমান পরিস্থিতি সমন্বয় করে এই চিত্র পাওয়া গেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন জ্বালানিতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ছিল। যা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকে বিলম্বিত করেছে। দ্রুত কাজ করতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন অনেক ক্ষেত্রেই তা গ্রহণ করা হয়নি। অন্যদিকে বিদ্যুতে দলগত কাজের অভিজ্ঞতা ভাল ছিল। যার ফলে এই খাত দ্রুত সম্প্রসারণ হয়েছে। কিন্তু জ্বালানির স্বয়ংসম্পূর্ণতা ছাড়া সাশ্রয়ী দরে বিদ্যুত পাওয়া কঠিন হয়ে ওঠে। সঙ্গত কারণে জ্বালানির উন্নয়নে আরও বেশি মনোযোগ দিতে আগামী সরকারকে আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অনুপস্থিত থাকলেও ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে অগ্রগতি এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশের কথা চিন্তা করা হয়েছিল। বিদ্যুত এবং জ্বালানিখাতের পরিকল্পনাই তার বড় উদাহরণ বলে মনে করা হয়। সেসময় আগামী পাঁচ বছরে প্রত্যেকের ঘরে ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে দেয়ার অঙ্গীকার করা হয়েছিল। একই সঙ্গে দেশের জ্বালানিখাতের উন্নয়নে বিদেশ নির্ভরতার বদলে দেশীয় কোম্পানিকে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা উল্লেখ ছিল। স্থলভাগের সীমানা ছাড়িয়ে বিশাল সমুদ্রে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের প্রতিশ্রুতি ছিল। যা বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণের পরিমাণ ছিল সীমিত। আওয়ামী লীগ ২০১৪তে যে নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছিল তাতে বলা হয়েছিল ২০১৬ সালনাগাদ বিদ্যুত উৎপাদন ১৬ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত হবে। ২০২১ সালে বিদ্যুত উৎপাদনের নির্ধারিত লক্ষমাত্রা ছিল ২০ হাজার মেগাওয়াট থাকলেও তা বৃদ্ধি করে ২৪ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করা হয়। শিল্পায়ন ও ক্রমবর্ধমান বিদ্যুত চাহিদা সামাল দিতে পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনার কথা বলা হয়। ইশতেহারে বলা হয় বর্ধিত বিদ্যুত চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রতিবেশী ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক, ত্রিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে বিদ্যুত উৎপাদন-বণ্টনের ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়। এই সময়ে বড় প্রকল্পগুলোর মধ্যে রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের নির্মাণ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার কথা উল্লেখ ছিল। কয়লাসম্পদের যথাযথ অর্থনৈতিক ব্যবহার করে বাংলাদেশের বিদ্যুত ও জ্বালানি সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের কথা বলা হয়। এক হাজার ৩০০ মেগাওয়াটের কয়লা চালিত বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ এবং কয়লা আমদানির কথা উল্লেখ করা হয়। ২০৩০ সালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদনের পরিমাণ ৫০ শতাংশ হবে বলে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া গ্রামীণ এলাকায় ৩০ লাখ সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করে গ্রিড নেই এমন মানুষের ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে দেয়ার কথা বলা হয়। বিদ্যুতের ক্ষেত্রে রামালের খুব একটা অগ্রগতি না থাকলেও সেই সংকট পূরণ হয়েছে পায়রাতে। পায়রা নিয়ে সরকারের খুব একটা প্রচার না থাকলেও বিদ্যুত কেন্দ্রটির অর্ধেকের বেশি কাজ এরমধ্যে শেষ হয়েছে। আগামী বছরই কেন্দ্রটি উৎপাদনে আসবে। অন্যদিকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রটিও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। রূপপুর বিদ্যুত কেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক ড. শওকত আকবর জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা প্রত্যেক বছর ধরে কাজের পরিমাণ নির্ধারণ করছি। বছরের মধ্যেই তা শেষ করা হচ্ছে। এতে করে আমরা আশা করছি ২০২৩ সালে আমাদের যে নির্ধারিত সময় রয়েছে তার মধ্যেই বিদ্যুত কেন্দ্রটি উৎপাদনে আসবে। কয়লা চালিত বিদ্যুত কেন্দ্রের পরিকল্পনাতে কাটছাঁট করেছে বিদ্যুত বিভাগ। উৎপাদন মহাপরিকল্পনা ২০১৬ তে কয়লা চালিত বিদ্যুতের উৎপাদন মোট উৎপাদনের ৩৫ শতাংশ করা হয়েছে। দেশে কয়লা আমদানি এবং পরিবহনে এখনও কোন অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে তরল জ্বালানির ওপর নির্ভর করা হচ্ছে। ইশতেহার অনুযায়ী ২০২১ এর মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা অর্জনের কথা রয়েছে। ধারাবাহিকভাবে কেন্দ্র নির্মাণ করে আসায় এখন দেশের মোট উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে ২১ হাজার ৪৭৫ মেগাওয়াট। এরমধ্যে দুই হাজার ৮০০ মেগাওয়াট ক্যাপটিভ পাওয়ার এবং এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট আমদানি করা হচ্ছে। অংশ হিসেবে সরকারী-বেসরকারী সব মিলিয়ে ৩৩টি বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। এগুলো নির্মাণ শেষ হলে বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা বা ৪ হাজার ৩৪০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ ২০২১ এর অনেক আগেই উৎপাদন ক্ষমতা ২৪ হাজার মেগাওয়াট অতিক্রম করবে। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বিদ্যুত আমদানিতে সব থেকে বড় সমস্যা ছিল ভারতের নীতি ভারত তার নীতিতে নিজেদের ভূখ- ব্যবহার করলে তাদের কোন কোম্পানির মাধ্যমে আমদানির শর্ত দিয়েছিল। সম্প্রতি ওই শর্ত তুলে দিয়েছে। এখন এই খাতে অগ্রগতি হবে বলে মনে করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে নেপালের সঙ্গে সরকার সমঝোতা স্মারক সই করেছে। ভুটানের সঙ্গেও সমঝোতার আলোচনা চলছে। এর বাইরে ভারত নিজের দেশ থেকে সরাসারি বিদ্যুত ক্রয়ের অনুমোদন দিয়েছে। বিদ্যুতখাতের সব চেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে ঘরে ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে দেয়া। এর মধ্যে ৯৪ ভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে গেছে। অন্যদিকে জ্বালানিতে সাফল্য আসেনি একেবারেই। গত পাঁচ বছরে জ্বালানিখাত শুধু মাত্র আমদানির প্রক্রিয়া চালিয়ে গেছে। দেশীয় কোম্পানি বাপেক্সকে বসিয়ে রেখে কাজ দেয়া হয়েছে বিদেশী কোম্পানিকে। নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৪ তে বলা হয়েছিল গ্যাসের যুক্তিসঙ্গত উত্তোলন ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে আরও শক্তিশালী করার নীতি অব্যাহত থাকবে। গ্যাস ও তেল অনুসন্ধান এবং উত্তোলনে বাপেক্সের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আরও রিগ এবং আধুনিক সাজ-সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি সংগ্রহ করা হবে। নতুন গ্যাস ও তেলক্ষেত্র আবিষ্কারে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। বাংলাদেশের উপকূল ও গভীর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রেখে অন্যান্য দেশ ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতার প্রচেষ্টা জোরদার করা হবে। দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের অবশিষ্ট জেলা জেলায় গ্যাস সরবরাহের উদ্যোগ অব্যাহত রাখা হবে। বিদ্যুত ও গ্যাস ব্যাবস্থাপনার দক্ষতা বৃদ্ধির মাধমে অপচয় হ্রাসের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। গ্যাসের মজুদ সীমিত বিধায় ইতোমধ্যে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানির যে প্রক্রিয়া চলছে তা সম্পন্ন করা হবে এবং এজন মহেষখালি দ্বীপে এলএনজি টার্মিনালসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। ইশতেহারের এই ঘোষণার বাস্তবায়ন হয়নি খুব একটা। দেশের অভ্যন্তর এবং সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধান খুব একটা জোরালো অবস্থানে দেখা যায়নি পেট্রোবাংলাকে। গত পাঁচ বছরের চার বছরেরও বেশি সময় বাপেক্স অনেকটা বসেই ছিল। উল্টো তাদের গ্যাস ক্ষেত্রে তিনগুণ বেশি দামে কূপ খনন করেছে বিদেশী ঠিকাদার কোম্পানি। এসব বিষয়ে বাপেক্সের কর্মকর্তাদেরও ক্ষোভ রয়েছে। তারা বলছেন তাদের রিগ বসিয়ে রেখে বিদেশী ঠিকাদার দিয়ে একের পর এক কূপ খনন করা হয়েছে। অপেক্ষাকৃত কম সম্ভাবনার যায়গাতে বাপেক্সকে দিয়ে কূপ খনন করা হয়েছে। আর বিদেশী ঠিকাদারকে সম্ভাবনাময় এলাকা দেয়া হয়েছে। জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক হোসেন মনসুর বলেন, গ্যাস সেক্টরে নীতির কারণে চাইলেই অনেক কাজ করা সম্ভব হয় না। এজন্য এইখাতের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। তিনি মনে করেন তেলের আন্তর্জাতিক বাজার দর কমে যাওয়াতে গভীর সমুদ্রে বিদেশী কোম্পানি বিনিয়োগ করতে অহিনা প্রকাশ করেছে। যে কারণে সাগরে তাদের আকৃষ্ট করা সম্ভব হয়নি। তবে এককভাবে দেশী কোম্পানিকে বসিয়ে রেখে বিদেশী কোম্পানিকে গ্যাস কূপ খনন করতে দেয়া উচিত নয় বলে মনে করেন তিনি। তবে আমদানির আগেই অবৈধ সংযোগ বন্ধ করা উচিত। এজন্য সরকারকে রাজলনতিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে অবৈধ সংযোগ তারা বন্ধ করবে। নইলে বেশি দামে আমদানি করার কোন মানে হয় না। বিদ্যুত জ্বালানি খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সম্প্রতি বলেছেন জ্বালানির সাফল্যর ওপর নির্ভর করে বিদ্যুতেন সাফল্য। কাজেই তাদেরও অনেক সাফল্য রয়েছে। তবে সাগরে সেভাবে আমরা নিজেদের সম্প্রসারিত করতে পারেনি। এজন্য একটি মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে (তেল গ্যাস অনুসন্ধান জরিপ) করার কথা ছিল তা আমরা করতে পারেনি। নতুন করে সরকার গঠনের পর এই জরিপ করা জরুরী বলে মনে করেন তিনি। তবে জ্বালানিতে সব থেকে বড় সাফল্য ধরা হয় এলএনজি আমদানির জন্য এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করা। গত বছর শেষের দিকে টার্মিনালটি গ্যাস সরবরাহ শুরু করেছে।
×