ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

খোদাকে ওয়াস্তে হামে বাংলাদেশ বানাদো

প্রকাশিত: ০৭:১১, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮

 খোদাকে ওয়াস্তে হামে বাংলাদেশ বানাদো

১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয়ের ৪৭তম বছর উদ্যাপন করেছি। লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই প্রিয় দেশ। ১৯৭১ সালের এই ডিসেম্বরে বিশ্বের মানচিত্রে নতুন একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্থান করে নেয় বাংলাদেশ। পাকিস্তানের আগ্রাসী থাবা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নের পথে এগোতে থাকে সদ্য জন্ম নেয়া দেশটি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির প্রধান লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানো। ঘরে ঘরে শোকের মাতম বইছে আর অপরদিকে রাস্তাঘাট, রেলপথসহ অবকাঠামো নষ্ট হয়ে সে যেন এক ধ্বংসস্তূপের বাংলাদেশ। ব্যাংক ও শিল্পখাতের একই অবস্থা। অর্থাৎ সবকিছু পেছনে ফেলে নতুন করে শুরু করার প্রত্যয়ে এগিয়ে যেতে হবে বাংলাদেশকে। এমনই এক চ্যালেঞ্জ সামনে। সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মাত্র ৪৭ বছরে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দরবারে এক মডেল হিসেবে পরিচিত। সম্প্রতি দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি তুলনা তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশকে শোষণ-নিপীড়নে নিষ্পেষিত করতে চেয়েছিল যে দেশটি, এখন অনেক কিছুতেই তারা পিছিয়ে রয়েছে। গত ৪৭ বছরের অগ্রগতিতে বাংলাদেশের মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) পরিমাণ এখন পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশে মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ ১ হাজার ৫৩৮ ডলার। সেখানে পাকিস্তানের তা ১ হাজার ৪৭০ ডলার। উন্নতি হয়েছে মাথাপিছু আয়েরও। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের বার্ষিক মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৬৭১ টাকা। বর্তমানে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ১ লাখ ২৮ হাজার ৮০০ টাকা বা ১ হাজার ৬১০ মার্কিন ডলার। পাকিস্তানের ইমরান খান ক্ষমতায় আসার পর তার দেয়া প্রতিশ্রুতির সমালোচনা করতে গিয়ে দেশটির সাংবাদিক জাইঘাম খান বাংলাদেশের প্রশংসা করেছিলেন। তিনি ইমরান খানের প্রতিশ্রুতি পূরণের দরকার নেই মন্তব্য করে বলেছিলেন, ‘খোদাকে ওয়াস্তে হামে বাংলাদেশ বানাদো’ অর্থাৎ আল্লাহর দোহাই লাগে আমাদের বাংলাদেশ বানিয়ে দাও। আর এবার স্বয়ং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানই বাংলাদেশের উন্নতির তুলনা করে বড় আক্ষেপের সঙ্গে বলেছেন-‘পূর্ব পাকিস্তান যখন পৃথক হলো তখন অনেককে বলতে শুনেছি, আমাদের ওপর একটি বোঝা হিসেবে ছিল পূর্ব পাকিস্তান, পৃথক হওয়ায় ভালই হয়েছে। এসব কথা আমি নিজ কানে শুনেছি। আজ সেই পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ সকল ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে। এর কারণ হলো, সেখানের নীতি-নির্ধারকরা দূরদর্শী। ২০১৮ সালের ৫ ডিসেম্বর দেয়া তার এই বক্তব্যের ভিডিও এখন সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল। বাংলাদেশের উন্নতি নিয়ে প্রশংসার ঝড় বইছে পাকিস্তানের মিডিয়াগুলোতে। বাংলাদেশের উন্নতি নিয়ে মুখ খুলতে বাধ্য হচ্ছেন পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী এবং অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, আমাদের দেশে এক্সপোর্ট হয় সবচেয়ে বেশি টেক্সটাইল বিভাগ থেকে। টেক্সটাইলের বিষয়টি দেখুন, এমন একটি দেশ, কোন এক যুগে টেক্সটাইলে যে দেশ আমাদের চেয়ে অনেক পেছনে ছিল, তারা এখন আমাদের চেয়ে বহুগুণ অগ্রসর হয়ে গেছে। এটি কোন দেশ? আর সে দেশে কি টেক্সটাইলের কাঁচামাল আছে? দেখুন! সেখানে হয়তো কাঁচামাল আছে, তবে সে দেশে কার্পাস তুলার একটি চারাগাছও জন্মায় না। সে দেশের নাম হলো, বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ট্রেক্সটাইলের দিক থেকে আমাদের দেশের তুলনায় কেবল সম্মুখে অগ্রসর হয়েছে তাই নয় বরং আমাদের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর হয়ে গেছে। তারা আমাদের তুলনায় এত বেশি উন্নতি করছে যে, যদি পিটিআই সবকিছু ঠিকও করে নেয় তবুও বাংলাদেশের মতো হতে আমাদের আরও দশ বছর সময় লাগবে। তাদের উন্নতির দৌড় দেখুন, শতকরা ৭ শতাংশ আর আমাদের ৫ দশমিক যা আরও নিচে নামার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশ ৪০ বিলিয়ন ডলার এক্সপোর্ট করে, সেক্ষেত্রে আমরা করি ২২ বিলিয়ন ডলার। উন্নতির দৌড়ে আমাদের চেয়ে তাদের গতি অনেক বেশি। আপনারা যদি বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করেন সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের লোকসংখ্যা আমাদের চেয়ে বেশি আর এক্সপোর্ট আমাদের তুলনায় কম ছিল কিন্তু এখন তারা এক্সপোর্টে আমাদের তুলনায় অনেক অগ্রসর হয়ে গেছে। বাংলাদেশের বিদ্যুত বিল ৮/৯ টাকা প্রতি ইউনিট কিন্তু পাকিস্তানে আপনাকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য ১৪ রুপি গুনতে হবে আর বিদ্যুত পাওয়াও তো যায় না। আর পেলেও তা উচ্চমূল্যে কিনতে হয়। পাঁচ বছর পূর্বে বাংলাদেশের এক্সপোর্ট আমাদের সমান ছিল, আমরা ২৫ থেকে ২০-এ চলে এসেছি আর তারা ২৪/২৫ থেকে ৪০-৫০-এ পৌঁছে গেছে। কী কারণ, বাংলাদেশ আজ থেকে ৪৭ বছর পূর্বে স্বাধীন হয়েছে অথচ তারা অর্থনৈতিকভাবে আমাদের চেয়ে অগ্রসর হয়ে গেছে। আপনাদের স্মরণ আছে! বাংলাদেশকে আমরা একবার যখন তা ইস্ট পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল তখন আমরা তাকে বাস্কেটকেস বলতাম। আজ বাংলাদেশের এক্সপোর্ট ৩৭ বিলিয়ন ডলার আর আমরা বিশ বিলিয়ন ডলারের ওপর যেতেই পারছি না।’ বাংলাদেশের এই যে, উন্নতি, অগ্রগতি এর কারণ কি? এর মূল কারণ হলো, বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে সকল ধর্মের মানুষ স্বাধীনভাবে তার ধর্মকর্ম পালন করতে পারে। শুরু থেকেই এদেশ ছিল ধর্মান্ধ উগ্রমোল্লা বিরোধী। অপরদিকে পাকিস্তান নামক দেশটিতে ধর্ম ব্যবসায়ীদের প্রভাব ও দাপটে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে উগ্রতা যার ফলে আজ এই উগ্রধর্মান্ধ গোষ্ঠীর হাতে পাকিস্তানের সাধারণ নিরীহ মানুষ থেকে নিয়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই যেন জিম্মি হয়ে আছে। প্রতিদিন ধর্মান্ধদের হাতে সেখানে মানুষ মারা পড়ছে। আজ পাকিস্তানের পুলিশ হেড কোয়ার্টার্স, স্কুল, মসজিদ, অন্যান্য ধর্মের উপাসনালয় এবং সেনানিবাসগুলোও ধর্মান্ধদের আক্রমণ থেকে নিরাপদ নয়। ধর্মের নামে অধর্মের নজিরবিহীন হাজারো ঘটনা প্রতিনিয়ত পাকিস্তানে ঘটেই চলেছে। মৌলবাদী এ দেশটিতে ধর্মের নামে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করার ইতিহাস রয়েছে। ১৯৫৩/৫৪ সালে তারা এ দেশে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের সদস্যদের ওপর বার বার আক্রমণ চালিয়ে সহস্রাধিক সদস্যকে হত্যা করেছে। ব্লাসফেমি আইনের আওতায় এনে হত্যা করা হচ্ছে। ২০১৪ সালের এই ডিসেম্বর মাসেই পাকিস্তানের পেশোয়ারে সেনাবাহিনী পরিচালিত আর্মি পাবলিক স্কুল এ্যান্ড কলেজে উগ্রধর্মান্ধরা নিরীহ শিশুদের ওপর হামলা চালিয়ে হত্যা করেছিল অন্তত ১৫০ জনকে, যাদের মধ্যে ১৪২ জনই ছিল শিশু। এমন বর্বরোচিত হামলার ঘটনা অচিন্তনীয়। যদিও পাকিস্তানে প্রায় প্রতিদিনই জঙ্গি হামলায় হতাহতের ঘটনা ঘটছে কিন্তু শিশুদের ওপর এমন হামলা তা কোনভাবেই সহ্য করার মতো ছিল না। পাকিস্তান আজ আন্তর্জাতিকভাবে জঙ্গী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত। আল কায়েদা-তালেবানসহ সব জঙ্গীদের আশ্রয় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে দেশটি। আল কায়েদাপ্রধান লাদেনের অবস্থানও ছিল এ দেশটিতে। এখনও দেশটির কিছু এলাকা তালেবান নিয়ন্ত্রিত। মোল্লাদেরকে মাথায় তুলে পাকিস্তান আজ সন্ত্রাসী জন্মদানের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে আর অপরদিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবসম্পদ উন্নয়ন, গড় আয়ু বৃদ্ধি, খাদ্যশস্যে উন্নতি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, মাতৃ ও শিশুমৃত্যু হ্রাস, সামাজিক উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি বিষয়ে বাংলাদেশের অগ্রগতি অনেক বেশি। বাংলাদেশ সরকার যদিও জঙ্গী দমনে কঠোর প্রদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তারপরও মনে করি, এ ব্যাপারে আরও সতর্ক হতে হবে। আজ আমরা কেউ বলতে পারি না যে, আমরা নিরাপদ। তাই সব সময় আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, কারণ, ধর্মান্ধদের নেই কোন ধর্ম, নেই বিবেক। শেষে এ কথাই বলব, বাংলাদেশের উন্নতির পিছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ধর্মান্ধদের নিয়ন্ত্রণে রাখা। লেখক : সাংবাদিক [email protected]
×