ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

হারিয়ে যাচ্ছে খেজুর গুড়

প্রকাশিত: ০৫:২০, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮

  হারিয়ে যাচ্ছে খেজুর গুড়

শীত মৌসুম এলেই কেশবপুরের গাছিরা খেজুর রসের সন্ধানে গাছ তুলতে বা গাছ কাটতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আগের মতো খেজুরগাছ এখন আর নেই। ইটভাঁটিতে খেজুরগাছ পোড়ানো, জলাবদ্ধতায়সহ নানা কারণে খেজুরগাছ কমে গেছে। সে কারণে খেজুরের রস ও গুড় এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। পেশাদার গাছির সংখ্যাও কমে গেছে। তার পরও খেজুর রসের গুড় দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি হয় বলে গাছিরা জানিয়েছেন। খেজুর রস সংগ্রহের জন্য এখন কেশবপুরের সর্বত্র গাছিরা প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গাছ কাটার কাজ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে গুড়ের ব্যবসায়ীরা কেশবপুরে এসে অবস্থান নিয়েছেন। উপজেলার ভালুকঘর, মূলগ্রাম, বেলকাটি, সাগরদাড়ি, ফতেপুর, চিংড়া, হাসানপুর, ধর্মপুর, আওয়ালগাতি, ভান্ডারখোলা, চাঁদড়া, দেউলি, বাগদাহ, সাবদিয়া, মজিদপুর, মধ্যকুল, ব্রহ্মকাটি, রামচন্দ্রপুর, ব্যাসডাঙ্গা, পাঁজিয়া, গড়ভাঙ্গা, কলাগাছি, গৌরিঘোনা, ভেরচি, মাগুরখালি, মঙ্গলকোট, বড়েঙ্গা, কন্দর্পপুর, পাথরা, কেদারপুরসহ অনেক গ্রামে গাছিরা খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ যেমন ঠিলে-খুংগি-দড়া- গাছি দা বালিধরাসহ ইত্যাদি নিয়ে গাছ কাটার কাজে ব্যস্ত রয়েছেন। শ্রমজীবী গাছিরা জানান, প্রতি বছরে খেজুরগাছ কেটে ফেলার কারণে রস ও গুড়ের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক গাছের মালিকরা খেজুরগাছ কেটে ইটভাঁটিতে বিক্রি করে। বাগদহা গ্রামের জালাল উদ্দিন জানান, এ বছরে প্রথম ১শ’ টাকা দিয়ে এক ভাড় রস কিনেছি। গত বছরে যার দাম ছিল ৭০ থেকে ৮০ টাকা। রামচন্দ্রপুর গ্রামের ভ্যানচালক শাহাবুদ্দিন জানান, আমি গরিব মানুষ হওয়ায় ২ বছর ধরে রস কিনে খেতে পারিনি। এর আগে প্রতি বছরে প্রায় ১০ থেকে ১২ ভাড় রস কিনতাম। তখন প্রতি ভাড় রসের দাম ছিল ৩০ থেকে ৪০ টাকা। মধ্যকুল গ্রামের শামীম রেজা জানান, গত বছর আমার এলাকায় জলাবদ্ধতা থাকার কারণে অনেক খেজুরগাছ মরে গেছে। এ বছর জলাবদ্ধতা না থাকায় আমার এলাকায় রস পাওয়া গেলেও দাম অনেক চড়া। খেজুরগাছের মালিকরা জানান, আগের মতো পেশাদার গাছি (শ্রমিক) এখন নেই। অনেকে বৃদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। সারা গ্রামে এখন একজন গাছিও পাওয়া যায় না। সে জন্য একজন শ্রমিককে খেজুরগাছ তুলতে প্রায় ২ থেকে ৩শ’ টাকা করে দিতে হয়। গাছের পরিমাণ ও গাছির সংখ্যা কমে যাওয়া খেজুর রস ও গুড়ের দাম ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়া আগে প্রতিটি গাছে এক কাটায় এক ভাড় করে রস হতো। কিন্তু এখন এর অর্ধেক রস হচ্ছে। আবহমান বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে শীত এলেই খেজুর রস ও গুড় নিয়ে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদেরও ব্যস্ততা বেড়ে যায় দ্বিগুন। মৌসুমের শুরুতে আলতো শীতের সোনালি সূর্যের রোদেলা সকালে গাছিরা বাঁশের ডগা দিয়ে নলি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করে। কেউবা আবার পাটের আঁশ দিয়ে দড়া তৈরিতে মগ্ন। বেলা বাড়তেই ঠিলে-খুংগি-দড়া- গাছি দা বালিধরা নিয়ে গাছিরা ছুটে চলে খেজুর রস সংগ্রহের জন্য গাছ কাটতে। আবার ভোরে উঠে রস নামাতে কুয়াশা ভেদ করে চড়ে বেড়ায় এক গাছ থেকে আরেক গাছে। এরপর ব্যস্ততা বাড়ে মেয়েদের সকাল থেকে দুপুর অবধি সেই রস জ্বালিয়ে গুড় তৈরিতে। এ্যালমুনিয়ামের কড়াইতে রস জালিয়ে গুড় তৈরি করতে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সময় লাগে। জিরেন রস দিয়ে দানা গুড়, ছিন্নিগুলা, পাটালি তৈরি করা হয়। ঘোলা রস দিয়ে তৈরি হয় ঝোলা গুড়। নলেন রসের পাটালি খেতে খুব সুস্বাদু হয় বলে বাজারে এর কদর অনেক বেশি। কেশবপুর তথা যশোরে খেজুরের রসের খ্যাতি বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। কেশবপুর উপজেলা থেকে তাজা খেজুরের রসের তৈরি গুড় বাংলাদেশের প্রত্যেক অঞ্চলের চাহিদা মিটিয়ে থাকে। পাশাপাশি বিদেশেও কেশবপুরের খেজুরের গুড়ের ব্যাপক কদর রয়েছে। যশোর তথা কেশবপুরকে সারা পৃথিবীতে পরিচিত করেছে যে কয়টি বিষয় তার মধ্যে যশোরের কেশবপুরের খেজুরের রস অন্যতম একটি। শীত এলেই আবহমান বাংলার ঘরে ঘরে শুরু হয় উৎসবের আমেজ। প্রতি ঘরে ঘরে শুরু হয় হরেক রকমের পিঠা তৈরির আয়োজন। পিঠা তৈরির জন্য ঢেঁকিতে চাউলের গুড়া তৈরির মহোৎসব পড়ে যায়। বাংলার প্রতিঘরে ঘরে সন্ধ্যা হলেই একদিকে শুরু হয় কবি গান, অন্য দিকে সন্ধ্যে রস দিয়ে শুরু হয় বিভিন্ন প্রকার পিঠাপুলিসহ পায়েস তৈরির ধুম। কেশবপুর শহরে শীত মৌসুমে গুড় ব্যবস্যা চলে জাঁকজমকভাবে। গুড় ব্যবসায়ীরা তাদের আড়তে বিভিন্ন এলাকা থেকে গুড় সংগ্রহ করে মজুদ করে রাখেন। কেশবপুর ও তার আশপাশের উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজার থেকে ব্যবসায়ীরা গুড় ক্রয় করে থাকেন। এর মধ্যে কলারোয়া উপজেলার খোর্দ বাজার, মনিরামপুর উপজেলার রাজগঞ্জ বাজার, কেশবপুরের সরসকাটি বাজারসহ প্রতিটি এলাকার হাটবাজারে কৃষকদের কাছ থেকে গুড় কিরে কেশবপুর শহরে আড়তে রাখা হচ্চে। এখান থেকে ট্রাক ভরে নিয়ে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন শহরে। চট্টগ্রামে বাঁশখালী এলাকার ব্যবসায়ীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে গুড় ব্যবসায়ীরা এরই মধ্যে কেশবপুরে বরাবরের মতো এবারও জড়ো হয়েছেন। কেশবপুরের গুড় নিয়ে ব্যবসায়ীরা দেশে ও বিদেশে পাঠাচ্ছেন বলে গুড় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। -কবির হোসেন, কেশবপুর থেকে
×