ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যের জনপদ সুসং দুর্গাপুর

প্রকাশিত: ০৪:৩১, ১ ডিসেম্বর ২০১৮

 মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যের জনপদ সুসং দুর্গাপুর

আঁকাবাঁকা পথ, সবুজ পাহাড়, টিলা আর নদী-ছড়াবেষ্টিত এক প্রাচুর্যময় জনপদ সুসং দুর্গাপুর। ভারত সীমান্তের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা নেত্রকোনার এক রতœগর্ভা উপজেলা এটি। মেঘালয় রাজ্যের পাদদেশে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যম-িত এ জনপদকে ঘিরে রয়েছে পর্যটন শিল্পের উজ্জ্বল সম্ভাবনা। কিন্তু উন্নত যোগাযোগ আর সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বিরাট এ সম্ভাবনাটি আজও উপেক্ষিত। নানা প্রতিবন্ধকতায় গারো পাহাড়ের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য অবলোকন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ-বিদেশের ভ্রমণ পিপাসুরা। নেত্রকোনা জেলা শহর থেকে মাত্র দেড় ঘণ্টার পথ পেরোলেই দুর্গাপুর। গারো, হাজং, কোচ, বানাই ও অন্যান্য আদিবাসী অধ্যুষিত এক পাহাড়ী জনপদ। একটু দূর থেকে দেখলে মনে হয়- এক খ- ঘন কালো মেঘ যেন সেই কবে থেকে আকাশ-মাটির সঙ্গে মিতালী করে আছে। বিরূপ প্রকৃতির সঙ্গে ক্ষুদ্র ও নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বিরামহীন সংগ্রাম চলছে এ জনপদে। কথিত আছে, গহীন জঙ্গল আর জীব-জানোয়ারদের সঙ্গে মিতালী করে একসময় গারো আদিবাসীরা বসবাস শুরু করেছিল বলেই এর নাম হয় গারো পাহাড়। ‘সোমেশ্বর পাঠক’ নামে এক ধর্মযাজক প্রথম দুর্গাপুরে সুসং রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর বংশ পরম্পরায় রাজত্ব করেন আরও অনেকে। গারো বিদ্রোহ, হাজং বিদ্রোহ, টঙ্ক আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন ও হাতিখেদা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বহু বিপ্লব-বিদ্রোহের নীরব সাক্ষী হয়ে আছে এককালের এই সুসং পরগনা। দুর্গাপুরের সৌন্দর্য শুধু পাহাড়েই সীমাবদ্ধ নয়। ঘন সবুজ পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে আছে সাদা, লাল ও বেগুনী রয়ের চিনামাটি (সাদামাটি)। বিজয়পুরের এ খনিজ সম্পদ দেশের সিরামিক শিল্পে প্রধান কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহৃত হয়। বিশাল এলাকা জুড়ে এই চিনামাটির আহরণ প্রক্রিয়াও মনোমুগ্ধকর। কাছে গেলে চোখ এড়ানো যায় না। আইনী বাধায় কয়েক বছর ধরে বন্ধ আছে চিনামাটির আহরণ। কিন্তু কাছাকাছি গিয়ে এর সৌন্দর্য অবলোকনে কোন বাধা নেই। এদিকে পাহাড় থেকে নেমে আসা সোমেশ্বরী ও আত্রাইখালি নদীও যেন দুটি বিচিত্র জলধারা। পাহাড়-নদীর অপরূপ মেলবন্ধন সেখানে। বর্ষায় এ নদীগুলো রাক্ষুসী রূপ ধারণ করে। ভাসিয়ে নেয় বিস্তীর্ণ জনপদ-ফসল। শুকনো মৌসুমে নদীর বুক জুড়ে জমে থাকে বিশাল বালিরাশি। সিলিকা (কাঁচ বালি) নামের এই বালিও নির্মাণ শিল্পের উপাদান। নদীর বুকে দিগন্তজোড়া বালিরাশি দেখে মনে হয়Ñ এ যেন আরেক এক সমুদ্র সৈকত। ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির অসংখ্য উপাদান-উপকরণও ছড়িয়ে আছে দুর্গাপুরে। সুসং রাজবাড়ি, কমরেড মণি সিংহের বাড়ি, টঙ্ক আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত টঙ্ক স্মৃতিসৌধ, বহেরাতলি গ্রামের রাশিমণি স্মৃতিসৌধ, কমলা রাণীর দীঘি, রানীখং মিশনসহ অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শনের সমাহার এই জনপদ। এখানকার ক্ষুদ্র ও নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি- যা পরিচয় করিয়ে দেয় ব্যতিক্রম জীবনধারার সঙ্গে। তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও চর্চার কেন্দ্র হিসেবে দুর্গাপুরের বিরিশিরিতে রয়েছে সুদৃশ্য কালচারাল একাডেমি। এটিও একটি পর্যটন স্পট হিসেবে পরিচিত। এ ছাড়াও আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে রয়েছে- কারুকার্যমন্ডিত ধর্মীয় মন্দির, গির্জা ও উপাসনালয়। বিজয়পুর সীমান্তে গড়ে উঠেছে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ স্থল শুল্ক বন্দর। ভারতের কিছু এলাকারও দেখা মিলবে দুর্গাপুর ওই সীমান্তে দাঁড়ালেই। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আঁকাবাঁকা এসব পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে পাড়ি দিতে হয় স্বচ্ছ জলের অসংখ্য ছড়া (পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনার মতো জলধারা)। দুর্গাপুরের নৈসর্গিক সৌন্দর্য সারা বছরই দর্শনার্থীদের হৃদয় কাড়ে। তবে পিকনিকের স্পট হিসেবে শীত মৌসুমে সেখানে ভ্রমণ বিলাসীদের ভিড় উপচে পড়ে। তাই শীত এলেই পাহাড় কন্যা দুর্গাপুর খুঁজে পায় পুরনো অতিথিদের সঙ্গে নতুন নতুন মুখ। অনেক বিখ্যাত পর্যটকরাও উপভোগ করে গেছেন দুর্গাপুরের সৌন্দর্য। দৃশ্যবন্দী করেছেন দেশ-বিদেশের চিত্র নির্মাতারা। একটু কাছে গেলেই এর প্রকৃতি হাতছানি দিয়ে ডাকে আগন্তুকদের। ভাবিয়ে তুলে ভ্রমণ বিলাসী, প্রকৃতিপ্রেমিক, কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীদের। কিন্তু বলাবাহুল্য, উন্নত যোগাযোগ আর সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে দুর্গাপুর এখনও এক উপেক্ষিত জনপদ। নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে সৌন্দর্যের টানে ছুটে আসা দূর-দূরান্তের ভ্রমণবিলাসীদের এখানে কিছুটা বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। ঢাকা, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনাসহ দেশের যে কোন প্রান্ত থেকে দুর্গাপুরে যেতে হয় নেত্রকোনার শ্যামগঞ্জ-বিরিশিরি সড়কের ওপর দিয়ে। কিন্তু সংস্কার কাজ চলায় ওই সড়কটি বর্তমানে চলাচলের অনুপযোগী। তাই এখন যেতে হয় নেত্রকোনা শহরের ওপর দিয়ে। জেলা শহরের দুদিক থেকে দুটি সড়ক গেছে ডেওটুকুন ঘাটে। সেখানে যাওয়ার জন্য সিএনজি, অটোরিক্সা বা ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল পাওয়া যায়। ঘাট পাড়ি দিয়ে আবার একই ধরনের যানবাহন নিয়ে সোজা পৌঁছা যায় দুর্গাপুর সদরে। ওদিকে দুর্গাপুর সদর থেকে বিজয়পুর সাদামাটির (চিনামাটির) খনি এলাকায় যেতেও পাড়ি দিতে হয় শিবগঞ্জ-ডাকুমারার মাঝামাঝি সোমেশ্বরী নদী। সেখানেও নির্মাণ করা হয়নি পাকা সেতু। তাই খেয়া নৌকাই ভরসা। নদী পাড়ি দেয়ার পর মিলবে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল, সিএনজি বা অটোরিক্সা। পর্যটনের উপযোগী উন্নতমানের হোটেল-মোটেল এখনও গড়ে উঠেনি দুর্গাপুরে। তবে কয়েকটি এনজিওর ডরমেটরি এবং বাণিজ্যিক হোটেলে আগে বুকিং দিয়ে রাখলে রাতযাপন করা যায়। স্থানীয়রা মনে করেন, আদিবাসীদের বৈচিত্র্যময় জীবনধারা, ঐতিহাসিক নির্দশন ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মিলে দুর্গাপুর মানেই এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার ছকে আনলেই এটি হয়ে উঠতে পারে আকর্ষণীয় এক পর্যটন কেন্দ্র। আর তা সমৃদ্ধ করতে পারে জাতীয় আয়কে। অথচ বলাই বাহুল্য, অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি দুর্গাপুরকে আজও পর্যটন এলাকা হিসেবেই ঘোষণা করা হয়নি। -সঞ্জয় সরকার, নেত্রকোনা থেকে
×