ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

ডুবতে বসেছে ১৩ আর্থিক প্রতিষ্ঠান

প্রকাশিত: ০৪:১৪, ২৫ নভেম্বর ২০১৮

ডুবতে বসেছে ১৩ আর্থিক প্রতিষ্ঠান

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ আমানত, তারল্য, মুনাফা, সম্পদের মূল্য নিয়ে এক প্রকার সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করা অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা লিজিং কোম্পানিগুলো। অবস্থা এতটাই খারাপ যে, ৩৪টি অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৩টিকে বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগই গ্রাহকদের আমানত ফেরত দিতে পারছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। আমানত ফেরত দিতে ব্যর্থ হওয়ায় গ্রাহকদের আস্থাও হারাচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে আমানত সংগ্রহ করতে না পারায় দেখা দিচ্ছে নগদ অর্থের সঙ্কট। কলমানি ও মেয়াদী আমানত নিয়েও সঙ্কট থেকে বের হতে পারছে না কিছু প্রতিষ্ঠান। আবার কিছু অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের কাছ থেকে নেয়া আমানত ও তার সুদ পরিশোধ করতে পারছে না। সার্বিক পরিস্থিতি এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে যে, বেশিরভাগ অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানই ধুঁকছে। দেশে কার্যক্রম চালানো ৩৪টি অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ২৩টি। প্রতিষ্ঠানগুলোর সিংহভাগই ধুঁকছে। তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে লোকসানের কবলে পড়েছে ছয়টি, মুনাফার দেখা পেলেও আগের বছরের তুলনায় কমেছে ১০টির, পরিচালন নগদ প্রবাহ বা ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে ১১টির, সম্পদের মূল্য কমেছে আটটির এবং একটির সম্পদের মূল্য ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। চলতি বছরের নয় মাসের হিসাবে মুনাফা, সম্পদের মূল্য এবং ক্যাশ ফ্লো- এ তিনটি সূচকের কোনটিতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি তালিকাভুক্ত মাত্র দুটি অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের। বাকি ২১টি প্রতিষ্ঠানের মুনাফা, সম্পদের মূল্য অথবা ক্যাশ ফ্লো- এ তিনটির এক বা একাধিক সূচকে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফসি)। প্রতিষ্ঠানটি নগদ অর্থ সঙ্কটের পাশাপাশি লোকসানে নিমজ্জিত রয়েছে। এমনকি ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে সম্পদের মূল্য। বাকিগুলোর মধ্যে লোকসানের পাশাপাশি সম্পদের মূল্য কমেছে চারটির। এর মধ্যে দুটির অর্থ সঙ্কটও আছে। মুনাফায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তিনটির মুনাফা ও সম্পদের মূল্য আগের বছরের তুলনায় কমেছে। এছাড়া মুনাফা কমে যাওয়ার পাশাপাশি অর্থ সঙ্কটে পড়েছে তিনটি প্রতিষ্ঠান। আবার মুনাফা কিছুটা বাড়লেও অর্থ সঙ্কটে পড়েছে চারটি প্রতিষ্ঠান। নিয়ম অনুযায়ী, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে প্রতি তিন মাস পরপর আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হয়। এরই আলোকে তালিকাভুক্ত ২৩টি অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২২টি চলতি বছরের প্রথম নয় মাস শেষে জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের পাশাপাশি জানুয়ারি-সেপ্টেম্বরের প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে। আর ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) শুধু জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকাশিত ওই আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধিকাংশ অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর গ্রাহকের আস্থা নেই। ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক আমানত না পাওয়ায় প্রতিনিয়ত কলমানি মার্কেটে ধরণা দিতে হচ্ছে। তারল্য সঙ্কটের কারণে গ্রাহকের আমানত ফেরত দিতে অনেকে সমস্যায় পড়ছে। আবার ব্যাংক খাতও খুব একটা ভাল অবস্থায় নেই। ব্যাংকের ব্যবসাও অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাবও আর্থিক খাতে রয়েছে। যে কারণে অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিবেদনে এমন সঙ্কটের চিত্র দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অব্যাংকিং আর্থিক প্রতষ্ঠানগুলো তারল্য সঙ্কটে রয়েছে। ম্যানেজমেন্টেরও সমস্যা আছে। প্রধানত এ প্রতিষ্ঠানগুলো কলমানি থেকে ধার করে এবং ফিন্যান্সিয়াল সোর্স খুবই সীমিত। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের আমানত ফেরত দিতে পারছে না। সার্বিকভাবে অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা খারাপ। এছাড়া তাদের ভাল লোকবলেরও অভাব আছে। তিনি বলেন, বর্তমানে ব্যাংকের অবস্থাও ভাল নয়। এরও একটি নেতিবাচক প্রভাব অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর আছে। ব্যাংক খাতে এখন অনেকে লোন নিতে চাচ্ছেন না, কারণ এক ধরনের অনিশ্চয়তা আছে। সুদের হারও বেশি। আবার অনেকগুলো অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও অভিযোগ আছে। একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করে বলেন, অনেক লিজিং কোম্পানি এখন আমানত পাচ্ছে না। এ খাতে এক ধরনের ইমেজ সঙ্কট তৈরি হয়েছে। কস্ট অফ ফান্ড বেড়ে যাওয়ায় কিছু প্রতিষ্ঠান লোকসানের মুখে পড়েছে। এখন আমাদের সবাইকে সিঙ্গেল ডিজিটে লেন্ডিং (ঋণদান) করতে হচ্ছে। আবার ব্যাংকগুলো এ্যাগ্রেসিভ ফাইন্যান্স করছে। খেলাপী ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। এসব কারণে আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো কিছুটা সমস্যার মধ্যে আছে। এদিকে চলতি বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিআইএফসির পাশাপাশি বে-লিজিং, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, পিপলস লিজিং এবং প্রাইম ফাইন্যান্স মোটা অঙ্কের লোকসানে রয়েছে। লোকসানের পাশাপাশি প্রাইম ফাইন্যান্স ও পিপলস লিজিংয়ের সম্পদের মূল্যও আগের বছরের তুলনায় কমে গেছে। সেই সঙ্গে ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে ক্যাশ ফ্লো। ক্যাশ ফ্লো বা পরিচালন নগদ প্রবাহ ঋণাত্মক হয়ে পড়ার অর্থ হলো নগদ অর্থের সঙ্কট তৈরি হওয়া। শেয়ার প্রতি ক্যাশ ফ্লো যত বেশি ঋণাত্মক হবে নগদ অর্থের সঙ্কটও তত বাড়বে। এ অবস্থা তৈরি হলে চাহিদা মেটাতে চড়া সুদে টাকা ধার করতে হতে পারে। তাতে খরচ বেড়ে যায় এবং আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়া অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে- ফাস ফাইন্যান্স, আইসিবি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, আইপিডিসি, মাইডস ফাইন্যান্স, প্রিমিয়ার লিজিং, ইউনাইটেড ফাইন্যান্স এবং উত্তরা ফাইন্যান্স। এছাড়া আগের বছরের তুলনায় সম্পদের মূল্য ও মুনাফা কমে যাওয়ার তালিকায় রয়েছে- বিডি ফাইন্যান্স ও ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স। আর ক্যাশ ফ্লো ও সম্পদের মূল্যে নেতিবাচক প্রভাব না পড়লেও মুনাফা কমে যাওয়ার তালিকায় রয়েছে- জিএসপি ফাইন্যান্স, আইডিএলসি, লংকাবাংলা ফাইন্যান্স এবং ফিনিক্স ফাইন্যান্স। অধিকাংশ অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান খারাপ অবস্থায় থাকলেও ইউনিয়ন ক্যাপিটাল ও ইসলামিক ফাইন্যান্সের মুনাফার পাশাপাশি সম্পদের মূল্য বেড়েছে এবং ক্যাশ ফ্লো পজেটিভ রয়েছে। এর মধ্যে ইউনিয়ন ক্যাপিটাল জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ১০ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ঋণাত্মক দুই টাকা ৮ পয়সা। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি সম্পদের মূল্য দাঁড়িয়েছে ১৪ টাকা ২ পয়সা, যা আগের বছরের ডিসেম্বর শেষে ছিল ১৩ টাকা ৯২ পয়সা। আর ইসলামী ফাইন্যান্স জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে এক টাকা ৮ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৯৬ পয়সা। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি সম্পদের মূল্য দাঁড়িয়েছে ১৩ টাকা ৭৬ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৩ টাকা ১৫ পয়সা।
×