ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কবি শাহানা পারভীন

প্রত্যয়ী এক জীবন সৈনিক

প্রকাশিত: ০৭:৪৪, ২৩ নভেম্বর ২০১৮

প্রত্যয়ী এক জীবন সৈনিক

কবি শাহানা পারভীনের রংপুর জেলার কুড়িগ্রামে জন্ম, বেড়ে ওঠা, শিক্ষা জীবন তৈরি করা থেকে শুরু করে শৈশব-কৈশোরের গুরুত্বপূর্ণ সময় অতিক্রমের পর্বটি ছিল এক আনন্দময় অভিযাত্রা। পিতা শাহ মোহাম্মদ আবদুই হাই ছিলেন সরকারী খাদ্য কর্মকর্তা। শুধু তাই নয় সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া একজন বীর সৈনিকও। যে চেতনায় শাহানা জীবনভর সমৃদ্ধ হয়েছেন। জীবনকে গড়েও তুলেছেন দেশপ্রেমের অকৃত্রিম বোধের এক অনন্য সম্পৃক্ততায়। যেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করে হৃদয় নিঃসৃত অর্ঘ্য নিবেদনে নিজেকে পূর্ণ করেছেন। সঙ্গত কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিও রয়েছে তাঁর অবিচল নিষ্ঠা। গভীর শ্রদ্ধা এবং বিশেষ দায়বদ্ধতাও। মা মিসেস জোবেদা খাতুন একজন সুগৃহিণী, দায়িত্বশীল জননী এবং পুরো সংসারের কর্ত্রী। জমিদার কন্যা হয়েও মাকে কোনদিন বিলাসবহুল জীবনযাপনে প্রলুব্ধ হতে দেখা যায়নি। সেই নির্মোই জীবন বোধ শাহানাকেও মুগ্ধ করতÑ আজও করে। ৫ ভাই-৩ বোনের মধ্যে শাহানা কনিষ্ঠতম। আদুরে সন্তান বলাই যেতে পারে। মা এবং নিজের ইচ্ছে চিকিৎসক হওয়ার হিসেবে চলার পথে মেলেনি। মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে কারমাইকেল কলেজে স্নাতক প্রথম বর্ষ (ইংরেজী) পড়া অবস্থায় বিয়ে হয়ে যায়। স্বামী শফিক রহমান একজন পুরাকৌশল বিভাগের প্রকৌশলী। বিসিএস ক্যাডার এই প্রকৌশলী পিডব্লিউডি সরকারী প্রতিষ্ঠানে তার কর্ম জীবন শুরু করেন নাটোরে। সঙ্গত কারণে শাহানাকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে শিক্ষা জীবনের পালাক্রমে চালাতে হয়। ইতোমধ্যে এক কন্যা সন্তানের মা হওয়ার কারণে মাতৃত্বের মহিমায় সবকিছুকে পেছনে ফেলে সংসারী হয়ে যান। কিছু সময় বিরতি দেয়ার পর পুনরায় বিএড ডিগ্রী অর্জন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পর্ব সমাপ্ত করেন। ছাত্রী হিসেবে খুবই মেধাবী ছিলেন। স্কুল, কলেজ এবং বোর্ড পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। বিএডের ফলাফলও ছিল প্রথম শ্রেণী। স্বামী, সন্তানসহ পারিবারিক জীবন ছিল স্বাচ্ছন্দ্য এবং গতিময়। ফলে শিক্ষার্থী হিসেবে সফলকাল হয়েও অন্য বিশেষ জগতে পদার্পণও ছিল এক সাহসিক অভিগমন। সাংস্কৃতিক আঙ্গিনা এবং রাজনৈতিক পথযাত্রা শুরু করতেও কোন ধরনের বাধা-প্রতিবন্ধকতার আবর্তে পড়তে হয়নি। সাবলীল গতিতে এগিয়ে গেছেন নিজের মতো করে পছন্দের কর্ম প্রবাহে। পারিবারিক অবাধ ও মুক্ত পরিবেশ তার সামনে চলার পথকে যে মাত্রায় অবারিত করেছে সশ্রদ্ধ চিত্তে আজও তা স্মরণ করে যান। কবিতা লেখা, আবৃত্তি করা, মঞ্চ নাটক লেখা, তৈরি করা সাংস্কৃতিক পথপরিক্রমায় এক অনবদ্য পর্যায়। পাশাপাশি রাজনৈতিক আদর্শে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। রবীন্দ্রভক্ত, নজরুল অনুরাগী এই বাচিক শিল্পী উপস্থিত যে কোন কবিতাকে শ্রোতার সামনে হাজির করতে পারেন নিঃসঙ্কোচে। একজন সফল আবৃত্তিকার হিসেবেও তার কৃতিত্ব কোন অংশে কম নয়। এক সময় তিনি তার দুই সন্তানসহ স্বামীর সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার চলে যান। সেই ১৯৯৭ সালে ডিঙি লটারি পাওয়ার পর তাদের প্রবাসী জীবন শুরু হয়। প্রায় ২০ বছরের সেই নতুন জীবনকে মানিয়ে গুছিয়ে নেয়ার প্রয়োজনীয় সময়েও মাতৃভূমি, মাতৃভাষা, আবহমান বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্যকে কখনই ভুলে যাননি। যাপিতজীবনে সাংস্কৃতিক চর্চা অব্যাহতই রাখেননি রাজনৈতিক সচেতনতায় প্রবাসের দিনগুলোকে ভরিয়েও তুলেছেন আর তাই কারমাইকেল কলেজের ছাত্রলীগের এক সময়ের কর্মী কবি শাহানা পারভীনকে প্রবাস জীবনে দেখা যায় ক্যালিফোর্নিয়ায় মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করতে। শুধু তাই নয় লস এ্যাঞ্জেলসে শিশু-কিশোরদের বাংলা পড়তে ও লিখতে শেখাতেন এই বাঙালী নারী, রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকান্ডের পাশাপশি পারিবারিক দায়িত্বও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেছেন। মেয়ে আনিকা এবং ছেলে অনিককে যথার্থ মানুষ করতে তাদের শিক্ষা ও প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন বিষয়কেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছেন। আনিকা আমেরিকার বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকৌশলী হিসেবে নিজেকে তৈরি করে পেশাগত জীবন শুরু করেছে। ছেলে অনিকও প্রকৌশলীতে পড়াশোনা করছে। দুই সন্তানকে জীবনের একটি পর্যায়ে পৌঁছে দিতে যে সময়টুকু লেগেছে তার চেয়ে বেশি দিন আমেরিকায় থেকে যাওয়ার কোন আগ্রহ মানেই আসেনি। সে তাড়নায় এক সময় নিজের দেশে ফিরেও আসলেন। শস্য-শ্যামলা মাতৃভূমিতে ফিরে এসে নবোদ্যমে আবারও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা অনুভব করলেন। ঢাকা সিটি কলেজের প্রভাষকের দায়িত্ব নিয়ে কিছুদিন তার কর্মজীবনকে চালিত করেন। বর্তমানে ঢাকার বাংলাদেশ ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশনের এম্বাসেডর হিসেবে নিযুক্ত আছেন। কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা কখনও কমেনি। বরং দিনে দিনে বেড়েছে। নিজ গ্রাম-কুড়িগ্রামকে আধুনিক বাংলাদেশের পর্যায়ে উন্নীত করতে বিভিন্ন কর্মপ্রক্রিয়ার সঙ্গে নিজের অংশীদারিত্বকে জোরদার করেছেন। সেই পরিসর আরও ব্যাপক আর সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে আগত সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে নিজের অবস্থানকে আরও শক্ত করতে চান। তবে নারীদের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে সংসদে যোগ্য প্রার্থীর আসনে বসা সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনে আবশ্যক। শুধুমাত্র সংরক্ষিত আসন দিয়ে অর্ধাংশ নারীর স্থান পূরণ হওয়ার নয়। বিগত ১৮ বছর ধরে সরকারপ্রধান হিসেবে নারীরা যেভাবে দাপটের সঙ্গে শাসনকার্য পরিচালনা করেছেন সেই দৃষ্টান্ত তো এখন সমগ্র নারীর সামনে।
×