ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষার মান উন্নয়নের পাশাপাশি অনেক সমস্যা দূর হবে

কুমিল্লা ও জাহাঙ্গীরনগর ভার্সিটির উন্নয়নে ৩১শ’ কোটি টাকার প্রকল্প

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ১২ নভেম্বর ২০১৮

  কুমিল্লা ও জাহাঙ্গীরনগর  ভার্সিটির উন্নয়নে ৩১শ’ কোটি টাকার প্রকল্প

ওয়াজেদ হীরা ॥ শিক্ষার মানোন্নয়নে বিশেষ দৃষ্টি রয়েছে বর্তমান সরকারের। আর তারই ধারাবাহিকতায় উচ্চ শিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গবেষণার স্বার্থে নেয়া হয়েছে উন্নয়ন প্রকল্পও। ইতোমধ্যেই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সভায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও কুমিল্লা বিশ^বিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়নের জন্য তিন হাজার এক শ’ কোটি ৮৬ লাখ টাকার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সরকারী অর্থায়নেই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন হবে। একনেক চেয়ারপার্সন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে চলতি অর্থবছরের ১১তম সভায় এই অনুমোদন দেয়া হয়। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে আরও অনেক পরিবর্তন আসবে বলেও মত সংশ্লিষ্টদের। জানা গেছে, রাজধানীর কাছে সাভার উপজেলায় গুরুত্বপূর্ণ জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়টি ৭০০ একর জমির ওপর স্থাপিত। ১৯৭১ সালে ১৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে এই বিশ^বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে ৩৪টি বিভাগের অধীনে প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছেন। দিন দিন এই শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বাড়ছে। ফলে শিক্ষার্থীদের আবাসন, একাডেমিক সুযোগ-সুবিধাসহ অন্যান্য সুযোগ নিশ্চিত করতে অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৪৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে। প্রকল্পের কাজ চলতি বছরের অক্টোবরে শুরু হয়ে ২০২২ সালের মার্চে শেষ হবে বলেও জানা গেছে। পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল প্রকল্প বিষয়ে জানান, দুটি বিশ^বিদ্যালয়ের উন্নয়নের স্বার্থে এই প্রকল্পগুলো অনুমোদন দিয়েছে একনেক। এর ফলে একাডেমিক, আবাসিক এবং অন্যান্য সুবিধা সম্প্রসারণের মাধ্যমে শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং গুণগত ও মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য উপযুক্ত শিক্ষাদান ও শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং শিক্ষা ও গবেষণা উপকরণ সরবরাহের মাধ্যমে প্রযুক্তিগত শিক্ষার মানোন্নয়ন হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক জনকণ্ঠকে বলেন, এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান যেমন বাড়বে তেমনি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আবাসন সঙ্কট দূর হবে। গবেষণার ক্ষেত্রে এসব সুবিধা অনেক প্রয়োজন বলেও মনে করেন শিক্ষকরা। এই প্রকল্প পাসের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জানান বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য। শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের ডিন, বিভিন্ন হলের প্রভোস্ট, শিক্ষক সমিতি, কর্মকর্তা-কর্মচারী সমিতি, সাংবাদিক সমিতি, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট ও সাংস্কৃতিক জোটসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন উপাচার্যকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। জানা গেছে, এই প্রকল্পের আওতায় ১০ তলা করে ছাত্র-ছাত্রীদের ছয়টি আবাসিক হল, ১০ তলা করে শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের জন্য পাঁচটি এবং কর্মচারীদের জন্য তিনটি আবাসিক ভবন নির্মাণ, একটি লেকচার থিয়েটার ও পরীক্ষার হল, একটি প্রশাসনিক ভবন, সাত তলা বিশিষ্ট একটি নতুন লাইব্রেরি ভবন ও একটি স্পোর্টস কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হবে। এছাড়া বিদ্যমান ভবনগুলোর মধ্য থেকে পাঁচটি ভবনের আনুভূমিক ও উর্ধমুখী সম্প্রসারণসহ একটি পিকআপ, একটি মিনিবাস ও দুইটি এ্যাম্বুলেন্স কেনার কথা রয়েছে। এদিকে, ‘কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন’ নামে একই সভায় যে প্রকল্প পাস হয় তার মধ্যে কুমিল্লা বিশ^বিদ্যালয়ের উন্নয়ন করা হবে। কুমিল্লা বিশ^বিদ্যালয়ের প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ১৬৫৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা। প্রকল্পটি চলতি বছরের নবেম্বর হতে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা রয়েছে। এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে উচ্চ শিক্ষার জন্য উন্নততর শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আবাসন সঙ্কট হ্রাস করা। জানা গেছে, ২০০১ সালে সংসদে কুমিল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় আইন পাস হয়। পরে এই আইনটি রহিত করে ২০০৬ সালে কুমিল্লা বিশ^বিদ্যালয় আইন করে এই নামে প্রতিষ্ঠিত হয় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০৭ সালে ২৮ মে ৬ বিভাগে ৩০০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে বিশ^বিদ্যালয়টি যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে ১৯ বিভাগে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয় হাজার। এছাড়াও শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা ৫ শতাধিক। প্রফেসর ড. ইমরান কবীর চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, শিক্ষার উন্নয়নে প্রকল্প বরাদ্দ দেয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন শিক্ষাকে বাণিজ্য হিসেবে না দেখে বিনিয়োগ হিসেবে নিতে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষা ক্ষেত্রে আরও ভাল অবদান রাখতে পারব। আমরা আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য ভাল পরিবেশ দিতে পারব। নানা সমস্যারও সমাধান হবে আশা করছি। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প নিয়ে জানা গেছে, প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যক্রমগুলোর মধ্যে রয়েছে ভূমি অধিগ্রহণ (২০০.২২ একর), ভূমি উন্নয়ন (১০০ একর), একাডেমিক ভবন নির্মাণ চারটি (প্রতিটি ১০ তলা), প্রশাসনিক ভবন একটি (৬ তলা), ছাত্র-ছাত্রী হল নির্মাণ দুটি করে মোট চারটি (প্রতিটি ১০ তলা), উপাচার্যের বাসভবন নির্মাণ একটি (২ তলা), শিক্ষকদের আবাসিক ভবন নির্মাণ একটি (১০ তলা), ডরমিটরি ভবন নির্মাণ একটি (১০ তলা), কর্মচারীদের একটি ১০ তলা আবাসিক ভবন নির্মাণ, ৬ তলা বিশিষ্ট একটি স্কুল বিল্ডিং নির্মাণ, ৫ তলা ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র নির্মাণ একটি, অডিটোরিয়াম নির্মাণ একটি ৩ তলা, ৬ তলা বিশিষ্ট একটি ইন্টারন্যাশনাল কমপ্লেক্স নির্মাণ, মেডিক্যাল সেন্টার নির্মাণ, অভ্যন্তরীণ রাস্তা, লেক খনন, কেন্দ্রীয় মসজিদ নির্মাণসহ কয়েকটি কার্যক্রম। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেগাপ্রকল্প একনেক সভায় অনুমোদন দেয়ায় পর প্রধানমন্ত্রী ও পরিকল্পনা মন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ক্যাম্পাসে আনন্দ মিছিল করেছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগসহ শিক্ষার্থীরা। তবে ইতোমধ্যেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অখন্ড ক্যাম্পাসের দাবি করছেন, ক্যাম্পাস খন্ডিত হওয়ার আশঙ্কায় আন্দোলন করেছেন। জানা গেছে, তৈরি করা প্রকল্পের নক্সা অনুযায়ী ভূমি অধিগ্রহণের স্থানটি কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার লালমাইয়ের রাজার খোলা গ্রামে পড়ে যা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ক্যাম্পাস (সালমানপুর) থেকে দুই কিলোমিটারেরও বেশি দূরে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই স্থান নির্বাচনকে ‘ক্যাম্পাস সম্প্রসারণ’ যৌক্তিক ব্যাখ্যা করলেও সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের দাবি তারা ‘অখন্ড ক্যাম্পাস’ চান। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তীব্র ক্ষোভ এবং সমালোচনা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মরিয়ম আক্তার সোনিয়া অখন্ড ক্যাম্পাসের দাবিতে লিখেছেন, ‘বুঝতে পারছি না বারবার কেন আমাদের অস্তিত্ব নিয়েই টানাটানি করা হয়। একবার নাম নিয়ে তো আরেকবার অন্যকিছু নিয়ে। এবার তো শেকড়ই উপড়ে ফেলতে চাচ্ছে। ক্যাম্পাসের আশপাশে প্রচুর জায়গা থাকা সত্ত্বেও কেন এখানেই সম্প্রসারণ করা যাবে না?’ ইংরেজী বিভাগের শিক্ষার্থী নাছির উদ্দিন লিখেছেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, উন্নয়নের নামে আমাদের কোন শাখা ক্যাম্পাস লাগবে না। আমি অখন্ড ক্যাম্পাস চাই।’ এছাড়াও অসংখ্য শিক্ষার্থী অখ- ক্যাম্পাসের দাবিতে নিয়মিতই সমালোচনা করছেন ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে। বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং ছাত্রলীগ নেতাদের নিয়ে সভা করেছেন পরপর। এদিকে অভিযোগ উঠেছে যে, জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা করা হয়েছে সেই জমি প্রকল্প অনুমোদন হওয়ার আগেই প্রভাবশালী একটি মহল কিনে রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে চড়া মূল্যে বিক্রির জন্য।
×