ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাচীন শিল্প কামারশালা চোখে পড়ে আজও

প্রকাশিত: ০৪:৩৭, ৫ নভেম্বর ২০১৮

প্রাচীন শিল্প কামারশালা চোখে পড়ে আজও

সমুদ্র হক ॥ তবু আজও চোখে পড়ে কামারশালা বা কামারের বাড়ি। কেউ বসে হাটখোলায়। কেউ হাটের কাছে রাস্তার ধারে। হাপর আর হাম্বলের প্রাচীন পেশার এই শিল্প। গৃহস্থালি, লোহার জিনিসপত্র এবং কৃষক-শ্রমিকের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম টিকিয়ে রেখেছে। নিরাপত্তার উপকরণ বানায় কামার সম্প্রদায়। তারা গ্রামীণ ও নগর জীবনে ধরে রেখেছে অর্থনীতির অন্যতম বলয়। প্রস্তর যুগের পর দূর অতীতে এই শিল্প ছিল রাজাদের নিয়ন্ত্রণে। কামারশালায় রাজ্য ও রাজপ্রাসাদ রক্ষায় অস্ত্র বানানো হতো। অনগ্রসর নৃগোষ্ঠীরাই ছিল কর্মী। ১৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিসরে কামারশিল্প সম্প্রসারিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় মিসর সম্রাজ্ঞীর সর্বশেষ সপ্তম ক্লিওপেট্রা এবং রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার কামারশালাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যান। বিশ্ব সভ্যতার আগমনে কামার শিল্প থেকেই উত্তোরণ ঘটে ফাউন্ড্রি এবং লোহার ভারি শিল্পের। তারপর যন্ত্রযুগে পৃথিবীর এগিয়ে চলা। আজও হাটের বড় বৈশিষ্ট্য এই কামারশালা। কামারের কর্মস্থল ছোট্ট একটি ঘর। বেশিরভাগই উন্মুক্ত। কোনটির উপরে টিনের চালা। চারদিকে ফাঁকা। কোনটির উপরে চালাও নেই। প্রধান উপকরণ হাপর। শক্ত চামড়া গোলাকৃতি ত্রিকোণা করে নির্দিষ্ট মাপে কয়েকটি ভাঁজে তৈরি। এই হাপর মাটির ওপর দৃশ্যমান। হাপরের নিচে পাইপ বসিয়ে তা মাটির ভেতরে রেখে টেনে নেয়া হয় ৪/৫ ফুট দূরে। হাপরের দুই ধারে বাঁশের সঙ্গে যুক্ত লম্বা ছোট বাঁশ; যা সামনের দিকে টেনে নেয়া হয়। সেখানে লিভারের মতো উপর-নিচ টানার ব্যবস্থা থাকে। তারপর লিভার টেনে হাপরের বাতাস পাইপ দিয়ে পৌঁছানো হয় মাটির ওপর স্থাপিত ছোট্ট চুল্লিতে। এই চুল্লিতে থাকে কাঠকয়লা। তাতে আগুন ধরিয়ে লিভার টেনে হাপরের বাতাসে তাপ নিয়ন্ত্রণ ও উস্কে রাখা হয়। এই চুল্লিতে লোহা রেখে তাপ দেয়া হয়। আগুনে তাপিয়ে লোহা আগুনের রঙে হলে বড় হাম্বল দিয়ে পিটিয়ে নানা আকৃতির জিনিস বানানো হয়। আগুনে লোহা পেটানোর জন্য কামারের সহযোগী থাকে এক বা দু’জন। তাপে লোহা পেটানোর উপযোগী হওয়ার সঙ্গেই হাম্বল দিয়ে দ্রুত পেটাতে হয়। তাপ কমে গেলে মাপমতো বাঁকানো যায় না। যে পণ্য বা জিনিস বানানো হবে পেটানোর পর তার টেম্পার (শক্তিমান) বেশি রাখতে পানির ভেতর ধীরগতিতে প্রবেশ করিয়ে হালকাভাবে শীতল করতে হবে। তারপর ফিনিশিং। অতি প্রাচীন এই কামার শিল্পের কদর এখনও হারিয়ে যায়নি। যদিও লেদ মেশিনে এখন অনেক কিছুই তৈরি হচ্ছে। তারপরও লৌহজাত দ্রব্যাদি কামাররাই তৈরি করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দ্রব্য হলো : গৃহস্থালি বঁটি, খুন্তি, পাছুন, কৃষকের কাস্তে, নিড়ানি, খন্তি, কোদাল, লাঙলের ফলা, শ্রমিকের কুঠার, শাবল, দা, বড় চাকু (দা, বড় চাকু, ছোরা বেশি ব্যবহার করে মাংস ব্যবসায়ী কসাই)। এ ছাড়া আদিবাসী সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার বর্শা, ধনুকসহ নানা কিছু তৈরি করে এই কামার। নিকট অতীতে চৌকিদার, পাহারাদার, ডাক হরকরাদের (রানার) কাছে থাকত বর্শা (লাঠির আগায় ফলা বসানো)। আরও দূর অতীতে রাজাদের প্রহরীর হাতে থাকত বর্শা। এই বর্শা ও অস্ত্র তৈরির জন্য রাজা কামারদের পৃষ্ঠপোষকতা দিত। বর্তমানে দেশে কামারের সংখ্যা একেবারে কম নয়। সাধারণত এদের দেখা যায় শহরে ও গ্রামের হাটে। গৃহস্থালি পণ্য তৈরি করে কামার সম্প্রদায়। এর বাইরে উন্নত যে গৃহস্থালি পণ্য বড় ফ্যাক্টরি থেকে আসে তার দাম বেশি। এ ধরনের পণ্য আমাদের দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী ব্যবহার করে না। বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার গুজিয়ায় রাস্তার ধারে দেখা গেল একজন কামারকে। তার নাম নির্মল কর্মকার। বয়স ৫০ পেরিয়েছে। বংশপরম্পরায় তারা কামার। তবে পরিচিতি কর্মকার। তাদের লৌহকারও বলা যায়। বললেন, চার পুরুষের ব্যবসা তাদের। এক সময় জমজমাট ছিল। গুজিয়া হাটে তাদের বড় কামারশালা ছিল। এখন অন্যরা দখলে নিয়েছে। বগুড়ানগরীর বকশি হাটখোলায় আছেন ক’জন কামার। বললেন, গৃহস্থালি মাঝারি বঁটি তৈরি করে বিক্রি করেন তিন শ’ থেকে সাড়ে তিন শ’ টাকায়। এ ছাড়া দা, খন্তি বানান। চন্দন কুমার বললেন, তাদেরও কয়েক পুরুষের ব্যবসা। এখন বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে তারা। গ্রামাঞ্চলে এরা বেশি থাকে। কারণ, গ্রামে এখনও কামারের তৈরি জিনিসের কদর আছে। তার মতে, টিকেও থাকবে এই শিল্প। প্রতিটি ঘরেই কামারের তৈরি গৃহস্থালি দ্রব্য আছে। এগুলো মেরামত করতেও কামারের কাছেই যেতে হয়। প্রাচীন এই কামার শিল্প আজও ঐতিহ্যের ধারা ধরে রেখেছে।
×