ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

পেট্রোলবোমার পর কি লাশ ফেলা শুরু?

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ৩০ অক্টোবর ২০১৮

পেট্রোলবোমার পর কি লাশ ফেলা শুরু?

বাংলাদেশের শান্তি, স্থিতি ও উন্নয়ন, এক কথায় আমরা বলে থাকি ‘সোনার বাংলা’, সেটি প্রতিষ্ঠার বিরোধী শক্তিটি দীর্ঘ আটচল্লিশ বছর যাবত নানারকম দেশবিরোধী অপচেষ্টা, অপকর্ম, দুষ্কর্মে লিপ্ত আছে। তাদের সেসব দুষ্কর্ম নির্বাচন আসলে কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়- এ কথা জাতি এখন ভাল করেই জানে। তারা প্রত্যেকবার নানারকম অপকৌশল তাদের শয়তানের কারখানা মস্তিষ্ক থেকে আবিষ্কার করে নিরীহ নিরপরাধ সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী, প্রগতিশীল লেখক, মুক্তিযুদ্ধপন্থী রাজনীতিক, কর্মী, লেখক, শিক্ষক, বিজ্ঞানমনস্ক তরুণ লেখক, ব্লগার হত্যা এদের ওপর প্রয়োগ করে থাকে। জাতিকে স্মরণে রাখতে হবে- আশ্চর্য হলেও সত্য যে, জিয়া, খালেদা জিয়া ও তারেকের উদ্ভাবিত ‘হত্যা-ফাঁসি’র মাধ্যমে যাদের টার্গেট বা শিকারে পরিণত করেছিল, তাদের মধ্যে ছিল না কোন যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার, আলবদর- দেশের প্রকৃত শত্রু, মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংস কামনাকারী, ধ্বংসকারী ও মুক্তিযোদ্ধার প্রাণহরণকারী। সেই ’৭৬ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যার পর জিয়া ক্ষমতা দখল করেই শুরু করে সেনানিবাসে মুক্তিযোদ্ধা-সেনা কর্মকর্তা হত্যা! কমপক্ষে কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধা-সেনা কর্মকর্তা জিয়া কথিত মিথ্যা ক্যুর নামে ফাঁসিতে মৃত্যুবরণ করেছিল! এরই অভিঘাতে ’৮১-এর মে মাসে একদল মুক্তিযোদ্ধা-সেনা কর্মকর্তা চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে বের হয়ে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে সে রাতে অবস্থানরত প্রেসিডেন্ট জিয়াকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। কথিত আছে, জিয়া প্রায় চার হাজার মুক্তিযোদ্ধা সেনাকে ফাঁসিতে হত্যা করেছিল! বিপরীতে সম্ভবত মুক্তিযোদ্ধা সেনারা একজন জিয়াকে হত্যা করেছিল। মনে প্রশ্ন জাগে, একি তাদের মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধক্ষেত্রের কয়েক হাজার সহযোদ্ধা, বন্ধু, স্বজনের হত্যার প্রতিবাদ ও প্রতিশোধ ছিল? আজ আর এ প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম কেউ প্রাণে বেঁচে নেই। দুঃখ, জাতি জানতে পারল না কেন কারা জিয়া হত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করেছিল। আমার ব্যক্তিগত ধারণা এর নেপথ্যে জিয়ার প্রায় চার হাজার মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তার ফাঁসিতে মৃত্যু ঘটানো এবং বিপরীতে ক্ষমতায় এসেই ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ঘোষিত শত্রু, যুদ্ধাপরাধী, দালাল-রাজাকারদের বিচার থেকে অব্যাহতি, জেল থেকে মুক্তি প্রদান, নাগরিকত্ব ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির চর্চা, যা মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনার পরিপন্থী, তার সূচনা ঘটানো জিয়া হত্যার প্রধান কারণ। মনে হয় এমন কোন শুভবোধ থাকার কারণটি মেজর জেনারেল মঞ্জুর বারবার পুলিশের কাছে গ্রেফতার থেকে জাতিকে জানিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, যা তাঁকে করতে দেয়া হয়নি। চে গুয়েভারার গ্রেফতার ও গুলিতে মৃত্যু সংঘটিত করে তাঁর মুখ চিরতরে বন্ধ করে দেয়ার ঘটনার সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। যাই হোক, খালেদা জিয়ার ’৯২-এ গণআদালত ও ’৭১-এর ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি বিরাধী এবং গোলাম আযমের নাগরিকত্ব প্রদানের কার্যক্রম, পরবর্তীতে প্রত্যেকটি উপনির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করা বলা চলেÑ ভোটারবিহীন সিল মারার মহোৎসবে পরিণত করার মূল উদ্দেশ্য ছিল গণতান্ত্রিক রীতি নির্বাচনকে বিতর্কিত, অগ্রহণযোগ্য ও হাস্যকর করে তোলা এবং পেশী ও বন্দুকের সাহায্যে ক্ষমতা দখলকে রীতিতে পরিণত করা! খালেদার সময় হিন্দু ভোটারদের পাড়ায় পাড়ায় গু-া-মস্তান দিয়ে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার পথ বন্ধ করে রাখা নিয়মে পরিণত হয়, যার সর্বোচ্চ উদাহরণ ২০০১-এর খালেদা-নিজামী-তারেক জোটের নির্বাচনের ফল দখল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার দখল এবং সোয়া কোটি ভুয়া ভোটার ব্যবহারের পাশাপাশি হিন্দুদের ওপর চরম নির্যাতন, হত্যা, লুট, ধর্ষণ, গৃহত্যাগে বাধ্য করার মধ্যে প্রকাশ লাভ করে। এরপর খালেদা জিয়া এবং জামায়াত ও তারেকের পরিকল্পনায় ২০০৪-এর ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনাকে সঙ্গে অন্য সব বড় নেতাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে জন্ম নেয়া জঙ্গী দলের সাহায্যে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী দলের অস্তিত্ব ধ্বংস করার লক্ষ্যে বর্বর গ্রেনেড হামলা চালিয়ে নেত্রী আইভি রহমানসহ তেইশ কর্মীকে হত্যা করে। এই পাঁচ বছরে জঙ্গীদের দ্বারা আহসানউল্লাহ মাস্টার, শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ প্রায় বিশ হাজার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে হত্যা করে। পৃথিবীর কোন গণতান্ত্রিক দেশে হত্যার মাধ্যমে বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করার এমন উদাহরণ দুর্লভ। ২০০১-এর আগে থেকে মৌলবাদী জঙ্গীরা জামায়াত-বিএনপির প্রশ্রয়ে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, যা তাদের বহু বোমা, গ্রেনেড হামলায় প্রমাণিত হয়েছে। এরপর ২০১৪-১৫ সালে খালেদা-তারেকের পরিকল্পনায় খালেদার প্রত্যক্ষ নির্দেশে যে পেট্রোলবোমা হামলা দ্বারা নিরীহ বাস, ট্রাক, গাড়িচালক ও নারী-পুরুষ-শিশু যাত্রী হত্যা করেছে, তার নিমর্মতা পৃথিবীর কোন দেশে কেউ দেখেনি! মানুষ হত্যা, বিশেষত মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চাকারী, বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ এবং গাড়িচালক ও বাসযাত্রীদের মতো সাধারণ মানুষও এদের হত্যা পরিকল্পনার বাইরে থাকেনি। তাই বর্তমানে যখন সংবাদপত্র সূত্রে জাতি দেখতে পাচ্ছে নিরীহ কৃষক, শ্রমিক, চালক, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের মফস্বলের ছোট মাপের কর্মী-সমর্থক খুন হচ্ছে, লাশ পাওয়া যাচ্ছে খুব সাধারণ নিম্নবিত্তের তরুণদের, তখন জাতি আরও একবার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। কেননা এবারও একটি নির্বাচন এগিয়ে আসছে। তদুপরি, খালেদা-তারেকের রাজনীতির নামে হত্যার অপরাজনীতির নানা রূপ দেখতে পেয়েছে জাতি। এ দুজন নির্বাচন ও ভোটের মাধ্যমে শান্তি, ক্ষমতার পরিবর্তনে একেবারেই বিশ্বাসী নয়। অপরদিকে এরা ধর্মচর্চায় শেখ হাসিনার মতো আন্তরিক না হলেও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির নামে যারা হত্যার অপরাজনীতি করে, তাদের মিত্র গণ্য করে ! সরকার এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে অতি দ্রুত এই নতুন লাশ ফেলার খেলা বন্ধ করতে হবে। ‘পুলিশের তুলে নিয়ে যাওয়া’র যে অভিযোগ উঠেছে সেটিকে মিথ্যা প্রমাণ কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনীকেই করতে হবে। নতুবা জনগণের কাছে মিথ্যা প্রচারটি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠবে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মহাজোট সরকারের ভাবমূর্তি মলিন হবে। তারেক সম্ভবত দুটো পথে খেলতে পারে প্রথমটি ড. কামাল হোসেনকে ব্যবহার করে নতুন একটি ‘ক্লিন ইমেজ’ লাভ করে বিএনপি বেশি ভোট পেতে পারে। দ্বিতীয়টি- সাধারণ, নিরীহ মানুষের লাশ ফেলে সরকারের এবং নিরাপত্তা বাহিনীর ভাবমূর্তি মলিন করে আওয়ামী ঘরানার জোটের ভোটে ধস নামানোর চেষ্টা করা। জঙ্গীদের নতুন করে হত্যাযজ্ঞে নামানোর চেষ্টাও চলছে- তা জনগণ দেখতে পাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে সরকারকে কারা লাশ ফেলার অপতৎপরতা শুরু করেছে তা অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে এবং জাতির সামনে তাদের মুখোশ উন্মোচন করে দিতে হবে। তা করতে হবে এখনই, অতিদ্রুত। লেখক : শিক্ষাবিদ
×