ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পতেঙ্গা সৈকতে প্রতিমা বিসর্জন

বিজয়া দশমীতে পূজা অর্চনা শেষে সিঁদুর রাঙা উৎসব

প্রকাশিত: ০৪:৫৩, ২০ অক্টোবর ২০১৮

 বিজয়া দশমীতে পূজা অর্চনা শেষে সিঁদুর রাঙা উৎসব

সমুদ্র হক ॥ হৃদয়ের ভক্তিতে ইন্দ্রিয়কে শুদ্ধ। অসুর শক্তির বিনাশে সুরশক্তির জয়ধ্বনী। বিজয়ার তিথিতে দেবীর চরণ ছুঁয়ে আশীর্বাদ নিয়ে, নারীদের শাখা-সিঁদুর অক্ষুন্ন রাখার প্রত্যয়ে শেষ হলো শারদীয় দুর্গা উৎসব। শুক্রবার বিজয়া দশমীর দিনে সর্বস্তরের মানুষের স্রোতধারায় পরিণত হয়েছিল মিলনমেলা। ষষ্ঠী থেকে দশমী, মিলনের পাঁচটি দিন যে কিভাবে ফুরিয়ে গেল! বিজয়া দশমীর সকালে মন্ডপগুলোতে ঢাকের বাদ্যি বেজে ওঠার সঙ্গেই ভেসে আসে বিসর্জনের সুর। পূজা শেষে সর্বজনীন উৎসবে নারীরা মেতে ওঠে সিঁদুর খেলায়। দেবীর চরণে সিঁদুর অর্পণের পর কৌটার সিঁদুর একে অপরের সিঁথি-গালে মেখে রাঙিয়ে দেয়। এর তাৎপর্য : শাখা-সিঁদুর অক্ষুণ্ণ রেখে পরিবারের মঙ্গল কামনা। একই সঙ্গে দেবীকে পুনরায় আগমনের আমন্ত্রণ। এদিন ম-পগুলো নারী, পুরুষ, শিশুদের আগমনে ছিল মুখরিত। দর্শনার্থী ও পূজারীদের ছিল হৃদয়ের গভীরের ভক্তি নিবেদন। বগুড়ার চেলোপাড়া পূজাম-পের ঠাকুর বললেন, পূজা ভাব-ভক্তি অর্থ ইশ্বরকে ভালবাসা। এর মাধ্যমেই সর্বজনীনতার উন্মেষ ঘটে। অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সুন্দরের আহ্বান জানানো হয়। ষষ্ঠী থেকে দশমী, পূজায় ব্যবহারের কয়েকটি পদ থাকে। পঞ্চপল্লব, পঞ্চশস্য, পঞ্চগব্য, ফুলফল, দূর্বা, তুলসী ইত্যাদি। রামায়ণে আছে- রামচন্দ্র দুর্গাপূজায় দেবীকে ১শ’ ৮টি নীলপদ্ম অঞ্জলি দেয়ার সময় একটি কম পড়লে তিনি (রামচন্দ্র) নিজের চোখ তুলে নিতে উদ্যত হন। দেবী মুগ্ধ হয়ে তাকে রক্ষা করেন। সেই থেকে সুন্দর চোখকে পদ্মের সঙ্গে তুলনা করা হয়। পূজায় থাকে নবপত্রিকা। এর অর্থ নয়টি গাছের উপকরণ। যে গাছের কাছে দেবী দুর্গা আশ্রয় নিতেন। এই নবপত্রিকা বসুন্ধরার প্রতীক। শারদীয় উৎসবের বিজয়া দশমীকে বলা হয় চিত্ত শুদ্ধের মিলনমেলা। উৎসবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঘরে বয়ে যায় আনন্দধারা। তারা সকল ধর্মের মানুষকে নিমন্ত্রণ জানায়। গড়ে ওঠে সম্প্রীতির এক মেলবন্ধন। এ ক্ষেত্রে সুনামগঞ্জের সাধক বাউল শাহ আব্দুল করিমের গান উদাহরণ হয়ে আসে। তিনি গেয়েছেন ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম, গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদী গাইতাম...।’ শারদীয় উৎসব তার এই গানের মতোই সম্প্রীতির এক চিরন্তন বাঁধন। বিজয়ার তিথিতে বেনারসি শাড়ি পরিহিতা দেবী দুর্গার রেশ ধরে মেয়েরা পরেছিল বেনারসি শাড়ি। কারও পরনে ছিল ঝলমলে রঙিন শাড়ির সঙ্গে কোমরে বিছা, নাকে নথ, পায়ে নূপুর। দশমীতে হিন্দু বিবাহিত নারী মেতে উঠেছিল সিঁদুর খেলায়। তরুণীরা আনন্দের চোখে দেখছিল। হৃদয়ে ছিল উচ্ছ্বাস। মনে প্রতীক্ষা- কবে বিয়ে হবে! কোন বিজয়ায় তারাও মেতে উঠবে এমন খেলায়। ছেলেদের পরনে ছিল বাহারি পাঞ্জাবি ও কুঁচি দেয়া গরদের ধুতিসহ নানা রঙের ধুতি। নিমন্ত্রণের পালায় লুচি, লাবড়া, নারিকেলের নাড়ু, বুন্দিয়া, খিচুড়ি, ফিরনি, পায়েসসহ কত কি! ম-পে ধূপের ধোঁয়ার আরতিকে মনে হয়েছিল মেঘের মধ্যে দেবী দুর্গার পরিবার। ডান পাশে লক্ষ্মী ও গণেশ। যথাক্রমে ঐশ্বর্য, সম্পদ ও সিদ্ধিদাতা গণঐক্যের প্রতীক। বাম পাশে জ্ঞানের প্রতীক সরস্বতী ও শৌর্য-বীর্যের প্রতীক কার্ত্তিক। পুরাণে বর্ণনা আছে, দুর্গা : হিমালয় ও মেনকা দম্পতির কন্যা এবং শিবের পতœী। দুর্গার আরেক নাম উমা। দেবী উমা থাকেন কৈলাসে পতিগৃহে। সিংহের পিঠে চড়ে বিশ্বব্রহ্মা-ে বাবা-মায়ের ঘরে আসেন। মর্ত্যে আগমনের প্রতীক্ষায় মা মেনকার সে কি ব্যকুলতা। তারপর বিশ্বভুবনে মায়ের বাড়িতে দুর্গা তার পরিবারসহ কয়েকদিন থাকার পর ফিরে যান কৈলাসে। বিজয়া দশমী সেই ফিরে যাওয়ার ক্ষণ। এই ক্ষণ ছিল উৎসবমুখর। মার্কেন্ডেয় পুরাণে ৮১ থেকে ৯৩ পর্যন্ত তেরোটি অধ্যায় নিয়ে আছে দুর্গা মাহাত্ম্য। মহামায়া দেবী মাহাত্ম্য অংশে মন্ত্র সংখ্যা ৭শ’। এই গ্রন্থকে সপ্তশতীও বলা হয়। অনেক নামে দুর্গার পূজা হয়। যেমন দুর্গা, মহিষমর্দিনী, শূলিনী, পার্বতী, কালিকা, ভারতী, আম্বিকা, গিরিজা, বৈষ্ণবী, কৌমারি, বাহারী, চন্ডী, উমা, হৈমবতি, কমলা, শিবানী ও যোগনিদ্রা। সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠায় মহাশক্তি নিয়ে বিশ্বভুবনে আবির্ভাব মহামায়া দুর্গার। পৃথিবীর মঙ্গল কামনায় দশভুজা শক্তিরূপী দেবী দুর্গা এবার কৈলাস থেকে পিতৃগৃহ মর্ত্যালোকে আগমন ঘোড়ায় চড়ে। বিজয়া দশমীতে একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ার আহ্বান জানিয়ে স্বর্গালোকে ফিরলেন দোলায় (পালকি) চেপে। পতেঙ্গা সৈকতে প্রতিমা বিসর্জন ॥ চট্টগ্রাম অফিস জানায়, চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে নামে কিশোর থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকল বয়সী মানুষের ঢল। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে প্রতিমা বিসর্জনের আয়োজন সম্পন্ন হয়। মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন নিজেই সমুদ্র সৈকতে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া কর্ণফুলী নদীর অভয়মিত্র ঘাটসহ বিভিন্ন পয়েন্টে দুর্গার প্রতিমা বিসর্জন হয়। শুক্রবার দুপুরের পর শুরু হয় পতেঙ্গা সৈকতে প্রতিমা বিসর্জন কার্যক্রম। ট্রাকযোগে নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে পুণ্যার্থীরা প্রতিমা বহন করে নিয়ে যায়। এ সময় বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে উচ্চারিত হয় ধর্মীয় স্লোগান। নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে অত্যন্ত সুন্দর পরিবেশে প্রতিমা নিয়ে যাওয়া হয় সৈকতে। সেখানে পূজা উদযাপন পরিষদের নেতৃবৃন্দ এবং সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলররা উপস্থিত ছিলেন। সনাতন ধর্মাবলম্বী ছাড়া ভিন্ন ধর্মাবলম্বী উৎসুক মানুষের উপস্থিতিও পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ চট্টগ্রাম জেলা সভাপতি শ্যামল কুমার পালিত জানান, বিভিন্ন পূজামন্ডপ থেকে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় দুর্গার প্রতিমা নিয়ে পতেঙ্গা সৈকতে গেছেন পূজারিরা। কোথাও কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। অত্যন্ত সুন্দর পরিবেশে শারদীয় এ উৎসব সম্পন্ন হয়েছে। সিএমপির পতেঙ্গা থানা পুলিশ জানায়, নগরীর ৪১টি ওয়ার্ড থেকে প্রতিমা এসেছে পতেঙ্গায়। সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে বিসর্জনের সময় নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এর মধ্যেই কার্যক্রম শেষ হয়েছে। কোন ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি যেন সৃষ্টি না হয় সে জন্য যথাযথ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাড়তি ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে। পূজা উদযাপন পরিষদ সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামের ১৫টি উপজেলায় এবার ১ হাজার ৮২৫টি মন্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। নগরীতে পূজাম-প হয়েছিল ২৫৫টি। এর মধ্যে নগরীর বেশিরভাগ প্রতিমা পতেঙ্গা সৈকতে বিসর্জন হলেও কাট্টলি সৈকত, পারকি সৈকত এবং কর্ণফুলী নদীর কালুরঘাট, সদরঘাট, ফিরিঙ্গীবাজারসহ বিভিন্ন পয়েন্টে প্রতিমা বিসর্জন হয়েছে। নগরী ও জেলার কোথাও কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। রাঙ্গামাটি ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, নানা আয়োজনে কাপ্তাই হ্রদের স্বচ্ছ জলে প্রতিমা বির্সজনের মধ্য দিয়ে সনাতন ধর্মাম্বলীরা শেষ করল শারদীয় দুর্গোৎসব। বিজয়া দশমী দিন শুক্রবার বিকেলে শহরের সকল পূজাম-পের প্রতিমা নিয়ে শহরে বর্ণাঢ্য আনন্দ শোভাযাত্রা বের করা হয়। শোভাযাত্রাটি সারা শহর ঘুরে কাপ্তাই হ্রদে দুর্গাদেবী বিসর্জন দেয়। এই সময়ে কাপ্তাই হ্রদের তীরে সকল বয়সী নর-নারীর ঢল নামে। নীলফামারী ॥ স্টাফ রিপোর্টার জানান, জেলায় ৮৫৭টি পূজা ম-পে বিজয়া দশমীর মধ্য দিয়ে শুক্রবার সকালে শেষ হয়েছে সনাতন হিন্দু ধর্মের শারদীয় দুর্গাপূজা। তবে বিকেলে ভক্তদের ভিড় জমে জেলা শহরের কেন্দ্রীয় কালিবাড়ি প্রাঙ্গণে। বিসর্জনের ঢোল, ঢাক, সিদুর খেলা আর পূজা অর্চনার মন্ত্রপাঠে মুখরিত হয়ে উঠে এলাকা।
×