ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সীমানা মানচিত্র নিয়ে নতুন ষড়যন্ত্রে মেতেছিল মিয়ানমার

নারিকেলদিয়া নামের প্রবাল দ্বীপই আজকের সেন্টমার্টিন

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ১০ অক্টোবর ২০১৮

নারিকেলদিয়া নামের প্রবাল দ্বীপই আজকের সেন্টমার্টিন

মোয়াজ্জেমুল হক/ এইচএম এরশাদ ॥ দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনকে মিয়ানমার তাদের সীমানা মানচিত্রে দেখানোর পর প্রতিবাদের মুখে তা প্রত্যাহার করেছে পাশাপাশি ক্ষমাও চেয়ে ভুল স্বীকার করেছে। মূলত এটা কোন ভুল নয়, বরঞ্চ বাংলাদেশকে নিয়ে মিয়ানমারের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রেরই একটি অংশ বলে দাবি করা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে। এ ঘটনার বহু আগে মিয়ানমার বাংলাদেশী মালিকানার এবং খতিয়ানভুক্ত প্রায় দেড় হাজার একর জমি দখল করে নিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এ নিয়ে বহু চিঠি চালাচালি করে এ পর্যন্ত এর কোন সমাধান মেলেনি। মিয়ানমার সরকার তাদের প্রণীত নীলনক্সা অনুযায়ী লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে রাখাইন রাজ্য থেকে বাস্তুচ্যুত করে বাংলাদেশের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে। প্রত্যাবাসনের নামে এখন এক ধরনের নাটক করে যাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে আলোচিত এমন একটি ঘটনার পর মিয়ানমার বাংলাদেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিনকে তাদের মানচিত্রে প্রদর্শন করে ফল কি দাঁড়ায় তা নিয়ে একটি টেস্ট চালিয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। উল্লেখ্য, মিয়ানমারের মানচিত্রে বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন দ্বীপকে দেখানোর বিষয়টি প্রকাশ পায় গত ৫ অক্টোবর। বিষয়টি গণমাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে প্রকাশ পাওয়ার পর সরকার পক্ষে মিয়ানমারের ঢাকার রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে এর জোরালো প্রতিবাদ জানানো হয়। ব্যাখ্যা দেয়ার বিপরীতে রাষ্ট্রদূত জানান, ভুলবশত এটা হয়েছে এবং এজন্য তারা দুঃখিত। এরপরই মিয়ানমারের ওয়েবসাইটে দেয়া নিজ দেশের মানচিত্র থেকে সেন্টমার্টিনকে সরিয়ে ফেলা হয়। পরদিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে জানানো হয়, বাংলাদেশের প্রতিবাদের মুখে মিয়ানমার সরকার তাদের মানচিত্র থেকে সেন্টমার্টিনকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রসমূহ জানায়, মিয়ানমার পক্ষ রোহিঙ্গা ইস্যুর জন্ম দিয়ে বাংলাদেশের বড় ধরনের ক্ষতি ডেকে এনেছে। এ ইস্যুটির কোন সমাধান না করে নতুন করে সেন্টমার্টিনকে তাদের মানচিত্রে দেখিয়ে নতুন ইস্যু সৃষ্টির পাঁয়তারা করেছিল। তবে সরকারের জোরালো প্রতিবাদের মুখে তা নস্যাত হয়ে গেছে। ইতিহাস অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রায় ২শ’ বছর আগে নাফ নদী ছিল আরও মিয়ানমার অভ্যন্তরে। তৎকালীন বার্মা সরকার (বর্তমানে মিয়ানমার) ওই নদীর বাঁধ সোজা করে একতরফাভাবে বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলের মালিকানার দেড় হাজার একর জমি দখলে নিয়ে যায়। এ জমি টেকনাফের হোয়াইক্যং মৌজার। এ ঘটনা বহু আগে ঘটলেও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকার পক্ষে দফায় দফায় চিঠি চালাচালি করেও কোন ফল মেলেনি। সরকার এ নিয়ে আর এগোয়ওনি। বর্তমান সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, এটি বাংলাদেশী মালিকানার একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। দ্বীপটি বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ, যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। স্বাধীন একটি দেশের কোন অংশকে প্রতিবেশী কোন দেশ তাদের অংশে দেখিয়ে পরে ভুল বলে বক্তব্য দিয়ে সরিয়ে নেয়ার বিষয়টি রহস্যজনক। বিভিন্ন সূত্র মতে, এ ঘটনা মিয়ানমারের সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত। এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক কোন ষড়যন্ত্রও থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, হাজার বছর আগে টেকনাফের দক্ষিণ সাগরে জেগে ওঠে একটি চর। টেকনাফের মূল ভূমির অংশ ছিল এই চর। সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের করাল গ্রাসে এই চরটি টেকনাফের মূল ভূখ- থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সময় গড়িয়ে এতে শুরু হয় বসতি। প্রথম দিকে এর নামকরণ হয় ‘নারিকেলদিয়া’। আরও পরে নামে পরিবর্তন আসে। নামকরণ হয় নারিকেল জিঞ্জিরা। শুরুতে চরটির চতুর্দিকে প্রচুর নারিকেল গাছ রোপণ করা হয়। নারিকেল গাছে ভরপুর হওয়ায় এটির নাম দেয়া হয়েছিল নারিকেল দ্বীপ। এ দ্বীপে আরব বনিকদের আগমনের বিষয়টিও ইতিহাস স্বীকৃত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক কার্যক্রমে আরব বনিকরা এ দ্বীপে বিশ্রাম নিতেন। তখন আরব বনিকরা এ দ্বীপের নাম দেয় ‘জাজিরা।’ এরপর এটি নারিকেল জিঞ্জিরা নামে পরিচিতি পায়। আরও বহু বছর পর খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী পাদ্রী মার্টিনের নাম অনুসারে এর নামকরণ হয় সেন্টমার্টিন দ্বীপ। মূলত মার্টিন ছিলেন চট্টগ্রামের ওই সময়ের জেলা প্রশাসক। ব্রিটিশ শাসনামলে অর্থাৎ ১৯০০ সালে ভূমি জরিপের সময় এই দ্বীপকে বার্মার অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। যদিও ওই সময়ে বার্মা ব্রিটিশ শাসনের আওতায় ছিল। ব্রিটিশ শাসকরা এটিকে ভারতের সীমানায় রেখে দেয়। এরপর সময় গড়িয়ে ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারত ও পাকিস্তান জন্ম নেয়। এ দ্বীপটি তখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সীমানায় অন্তর্ভুক্ত থাকে। এ নিয়ে কখনও মিয়ানমারের কোন ধরনের তৎপরতা দেখা যায়নি। আরও পরে সমুদ্রসীমা বিভাজনে আন্তর্জাতিক আদালতের রায় বাংলাদেশের পক্ষে আসে। অনুরূপভাবে ভারতের সীমানা অভ্যন্তর থেকে বেশ বড় একটি অংশও আদালতের রায়ে বাংলাদেশের মালিকানায় চলে আসে। মিয়ানমার ও ভারত সমুদ্র সীমানা নিয়ে কখনও প্রতিবাদ করেনি, বরঞ্চ স্বাগত জানিয়েছে। ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল প্রদত্ত এই রায় বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের একটি অর্জন। সমুদ্রসীমা বিভাজনের বিষয়টি চূড়ান্ত হওয়ার প্রেক্ষাপটে সেন্টমার্টিন দ্বীপসহ ২শ’ নটিক্যাল মাইল একান্ত অর্থনৈতিক জোন আর মহীসোপানের অধিকার পেয়েছে বাংলাদেশ। সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে দক্ষিণে ২শ নটিক্যাল মাইল এলাকা পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরের জলসীমায় বাংলাদেশের সীমানা চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত হয়ে গেছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, সেন্টমার্টিন দ্বীপটি উত্তর-দক্ষিণে সাড়ে তিন মাইল, পূর্ব-পশ্চিমে পৌনে দুই মাইল। দ্বীপে বর্তমান জনসংখ্যা সাড়ে ৮ সহস্রাধিক। ভোটার সংখ্যা সাড়ে তিন হাজার। পরিবার রয়েছে ১ হাজার ৪৫৪। সেন্টমার্টিন টেকনাফের ৬ নম্বর ইউনিয়ন। ওয়ার্ড সংখ্যা ৯। আর এ পর্যন্ত হোটেল, কটেজ প্রতিষ্ঠা হয়েছে ৮৪টি। এ দ্বীপে ৬৮ প্রজাতির প্রবাল, ১৫১ প্রজাতির শৈবাল, ১৯১ প্রজাতির মৌলাক্স বা কড়িজাতীয় প্রাণি, ৪০ প্রজাতির কাকড়া, ২৩৪ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪ প্রজাতির উভচর প্রাণি, ২৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ১২০ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণি ছাড়াও রয়েছে ১৭৫ প্রজাতির উদ্ভিদ এবং ২ প্রজাতির বাদুড় ও ৫ প্রজাতির ডলফিন। সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত ॥ সরকারের সর্বশেষ নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী বছরের (২০১৯) ১ মার্চ থেকে সেন্টমার্টিন ভ্রমণে যেতে অনলাইনে নিবন্ধন করতে হবে। পর্যটকরা শুধু দিনের বেলায় ভ্রমণে যেতে পারবেন। এ সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়েছে গত ২৩ সেপ্টেম্বর সেন্টমার্টিন দ্বীপ রক্ষায় গঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে। এ দ্বীপকে রক্ষার স্বার্থে সেখানে পর্যটকদের রাত যাপনে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। দ্বীপের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ছেঁড়াদ্বীপ ও গলাছিপা অংশে পর্যটকদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
×